ফিতরা রোজাকে করে ত্রুটিমুক্ত

ফিতরা রোজাকে করে ত্রুটিমুক্ত। পবিত্র রমজান মাসে রোজাদারের সর্বশেষ করণীয় দায়িত্ব হলো- সদকাতুল ফিতর বা ফিতরা দেয়া। 

ফিতরা দেয়ার মাধ্যমে রমজানে পালিত রোজায় কোনো ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে তা শুধরে নেয়া যায়। আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার সহজ উপায় হলো ফিতরা প্রদান করা। ফিতরা দেয়া ছোট-বড় সব নারী-পুরুষের জন্য শরিয়তের নির্দেশ।

পরিবারের যিনি অভিভাবক অর্থাৎ পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়দায়িত্ব যার ওপর, তিনি তার পরিবারের সব সদস্যের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করবেন। সমাজের এতিম, অসহায়, দরিদ্র ও গরিব নিকটাত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীরা ফিতরা পাওয়ার অধিকারী।

ফিতরার যৌক্তিকতা হচ্ছে- এক মাস রোজা পালনের পর ঈদুল ফিতর উদযাপন করা হয়। সেই ঈদে গরিব-ধনী সবাই যেন সামর্থ্যমতো অংশগ্রহণ করতে পারেন, ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন, একটু ভালো খাবারের ব্যবস্থা করতে পারেন, ভালো পোশাক সংগ্রহ করতে পারেন। সমাজের সামর্থ্যবান-ধনীরা স্বভাবতই এ ধরনের আয়োজনে সামর্থ্য হন, তারা তাদের সন্তানাদিদের নিয়ে ঈদের আনন্দ উপভোগ করেন। সেজন্যই ধনীদের প্রতি ফিতরা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হযরত মোহাম্মদ (সা.)। 

ঈদের নামাজের আগে ফিতরা পরিশোধ করা উত্তম। আগে আগে যদি ফিতরা পরিশোধ করে দেয়া হয় তাহলে গরিবরা এ থেকে কিছু মিষ্টান্নজাতীয় জিনিস কিংবা একটু ভালো খাবার অথবা কিছু পোশাকপরিচ্ছদ সংগ্রহ করতে পারবেন।

ফিতরার পরিমাণ এখন প্রায় সব মুসলিম দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা হয়। এটা অবশ্য ইসলামের নীতিমালার আলোকেই নির্ধারিত হয়ে থাকে। এই নীতিমালা হলো- গম-আটা, খেজুর, কিশমিশ, পনির, যব ইত্যাদি পণ্যের যেকোনো একটি দ্বারা ফিতরা দেয়া যাবে। গম বা আটা দ্বারা ফিতরা আদায় করলে ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম বা এর মূল্য পরিমাণ টাকা আদায় করতে হবে। খেজুর দ্বারা আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজারমূল্য, কিশমিশ দ্বারা আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজারমূল্য, পনির দ্বারা আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজারমূল্য এবং যব দ্বারা আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজারমূল্য সমপরিমাণ টাকা আদায় করতে হবে। 

মুসলমানরা নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী সদকাতুল ফিতর আদায় করবেন। প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। নাবালক ছেলেমেয়ের পক্ষ থেকে বাবাকে ফিতরা দিতে হয়। একজনের ফিতরা একজনকে দেয়া যায়, আবার অনেককেও দেয়া যায়। তদ্রুপ অনেকের ফিতরা একজনকেও দেয়া যায়। 

ঈদের চাঁদ দেখা যাওয়ার সাথে সাথে রোজাদারের উচিত ফিতরার টাকা হিসাব করে আলাদা করে রাখা এবং ঈদের নামাজ পড়ার আগেই তা বিতরণ করে দেয়া।

আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) প্রত্যেক গোলাম, স্বাধীন, পুরুষ, মহিলা, ছোট-বড় সকল মুসলমানের ওপর এক ছা খেজুর বা এক ছা যব যাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন এবং তা লোকেরা ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বেই আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। (বুখারী, মুসলিম)

আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা যাকাতুল ফিতর বের করে দিতাম এক ছা খাদ্য আথবা এক ছা যব আথবা এক ছা খেজুর আথবা ছা কিসমিস। (বুখারী) আমরা রাসুল (সা.) এর সময়ে ঈদুল ফিতরের দিনে এক ছা খাদ্য বের করে দিতাম। তখন আমাদের খাদ্য ছিল যব, কিসমিস, পনির ও খেজুর। (বুখারী) যখন মু’আবিয়া (রা.) মদীনায় আসলেন ও গমের মৌসুম আসল, তখন তিনি বললেন, আমি মনে করি এটার এক মুদ উপরোক্ত মুদের দুই মুদের সমান হবে। (বুখারী)

যে শিশু ঈদের আগের দিন সূর্যাস্তের আগে জন্ম গ্রহণ করেছে, তার পক্ষ হতে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে, সূর্যাস্তের পর জন্ম গ্রহণ করলে তার পক্ষ হতে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে না। কেউ সূর্যাস্তের পর মারা গেলে তার পক্ষ হতে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে, সূর্যাস্তের আগে মারা গেলে সাদাকাতুল ফিতর দিতে হবে না। 

নগদ অর্থ দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা যাবে কিনা- এ নিয়েও মতবিরোধ রয়েছে আলেমদের মাঝে। ইমাম শাফেঈ, ইমাম মালেক, ইমাম আহমাদ (রহ.) ও সৌদি আরবের খ্যাতনামা আলেমগণের মতে, নগদ অর্থ দেয়া বৈধ হবে নয়। কেননা হাদীসে নগদ অর্থের কথা উল্লেখ নেই। আতা, হাসান বাসরী, ছুফয়ান সাওরী, ওমর বিন আব্দুল আজিজ, ইমাম আবু হানিফা ও তার অনুসারীদের মতে, নগদ অর্থ দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা বৈধ। কেননা সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের একটি অন্যতম লক্ষ্য হলো দরিদ্র মানুষকে ঈদের আনন্দে শরীক হওয়ার সুযোগ করে দেয়া। 

এছাড়া উল্লেখিত হাদীসে মূল্যমান নির্ধারণের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, সাহাবা (রা.) সিরিয়ার দুই মুদ গম অর্থাৎ অর্ধ ছা গমকে মদীনার এক ছা খেজুরের সমান মূল্য নির্ধারণ করে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করেছেন। অতএব আমি মনে করি, এক্ষেত্রে কোনো সীমাবদ্ধতায় না গিয়ে উন্মুক্ত রাখাই শ্রেষ্ঠ, যাতে সবার জন্যই বিষয়টি সহজ হয়ে যায়। ইসলাম সহজকে পছন্দ করে যদি তাতে গোনাহ না হয়। 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা সহজ করো, কঠিন করো না।’ (বুখারী, মুসলিম)

সাদাকাতুল ফিতর কাকে দেয়া হবে

সাদাকাতুল ফিতর পাওয়ার উপযুক্ত তারাই, যারা যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত। তবে সমাজের দরিদ্র-অনাথ ও নিজের গরীব আত্মীয় ও প্রতিবেশীকে দেয়াটাই অধিক উত্তম। কেননা হাদীসে সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, দরিদ্রের খাবারের ব্যবস্থা করা।

অতএব সাদাকাতুল ফিতর একমাত্র দরিদ্র-অনাথকে দিয়ে ঈদের আনন্দে তাদের শামিল করবে ও নিজের রোজাকে ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে পরিচ্ছন্ন করবে- এটাই হবে সাদাকাতুল ফিতরের লক্ষ্য।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //