ক্রীড়াঙ্গনে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা

বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে অনেক মানুষের সংগ্রাম, বীরত্ব আর আত্মত্যাগের মাধ্যমে। এ দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষকে স্পর্শ করেছে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এমন সুসময় আর আসেনি। এমন দুঃসময় কখনো আসেনি। ইতিহাসের সেই শ্রেষ্ঠ সময়ে বাঙালি হয়ে ওঠে অজেয় ও অপরাজেয়। 

এই শ্রেষ্ঠ সময়ে সব পেশাশ্রেণির পাশাপাশি ক্রীড়াবিদরাও পিছিয়ে ছিলেন না। এই সংগ্রামে তাদেরও রয়েছে অবিস্মরণীয় ভূমিকা। মিছিলে, সভায়, আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার পাশাপাশি অনেক ক্রীড়াবিদ খেলার মাঠ থেকে সরাসরি সশস্ত্রযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। লড়াই করেন জীবন বাজি রাখেন। 

তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- ফুটবলার মেজর (অব.) হাফিজ, নূরুন্নবী, ইনু, প্যাটেল, শেখ কামাল, ক্রিকেটার  রকিবুল হাসান, তান্না, মাসুদ ওমর, হকির হাবিবুল, হাফিজউল্লাহ, বাস্কেটবলের কাজী কামাল, কুস্তিগির খসরু, ভলিবলের কবীর, সাঁতারু এরশাদুন্নবী প্রমুখ। খেলার মাঠের মতো যুদ্ধের মাঠেও তারা দেখিয়েছেন অসীম সাহসিকতা।

স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন ক্রিকেটার জুয়েল, ফুটবলার মজিবর, সারোয়ার, কুটুমনি, বাবুল, সোহরাওয়ার্দী, মিজান, অ্যাথলেট মিরাজ, তপন চৌধুরী, শাহেদ আলী, দাবার কাসেদ, সাদিক, হকির মীরু। 

শুধু ক্রীড়াবিদরা নয়, এই মহান যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন দৈনিক অবজারভারের ক্রীড়া সম্পাদক ও ক্রীড়া সংগঠক আবদুল মান্নান লাড়ু, আজাদ বয়েজ ক্লাবের ক্রিকেট সংগঠক মুশতাক, নোয়াখালীর ক্রীড়া সংগঠক ভুলু।

পাকিস্তান আমলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের মতো বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনও ছিল উপেক্ষিত। এ অঞ্চলের ক্রীড়াবিদরা প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে সাফ্যল্যের দুয়ারে পৌঁছতে না পারে, সেজন্য কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়া হতো। তাদের তাচ্ছিল্য ও পক্ষপাতিত্বের অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো ক্রীড়াক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ। জনসংখ্যার অনুপাতে বাজেট বরাদ্দের কথা থাকলেও চরম বৈষম্য প্রদর্শন করা হতো।

অবহেলা ও বঞ্চনা ছাপিয়ে ব্যক্তিগত নৈপুণ্য ও ক্রীড়াশৈলী দেখিয়ে সাফল্য দেখালেও তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ ও স্বীকৃতি দেয়া হতো না। কিংবদন্তি সাঁতারু ব্রজেন দাস ১৯৫৬ সালের অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে অলিম্পিক গেমসে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে ছিলেন প্রধান দাবিদার; কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই তাকে সুযোগ দেয়া হয়নি। তার পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সাঁতারু পাঠানো হয়। সেই আক্ষেপ  থেকেই অনুপ্রাণিত ব্রজেন দাস ছয়বার ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। 

এক কথায় শুধু সাঁতার নয়; এ অঞ্চলের ক্রীড়াবিদরা যাতে পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসতে না পারে, পাকিস্তানিরা সর্বদা সেই চেষ্টাই করতো। 

বঞ্চিত বাঙালির ক্ষোভের আগুন জ্বলতে থাকে। তার প্রতিফলন দেখা যায় খেলার মাঠেও। একাত্তর সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা স্টেডিয়ামে চারদিনের ক্রিকেট ম্যাচ হচ্ছিল পাকিস্তান ও কমনওয়েলথ একাদশের মধ্যে। ম্যাচের শেষদিন ১ মার্চ দর্শকরা খেলা উপভোগ করার সময় বেতারে দুপুর ১টার খবরে বলা হয়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান স্থগিত করে দিয়েছেন জাতীয় পরিষদ অধিবেশন। ওই অধিবেশনে সরকার গঠন করার কথা ছিল জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের। অধিবেশন স্থগিত করার অর্থ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোটে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বাংলার মানুষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি করা। স্বাধীকারের চেতনায় ঢাকা স্টেডিয়ামের দর্শকরা মুহূর্তেই গানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে ও পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা।

দেশের অস্বাভাবিক অবস্থাকে বিদেশি পর্যটক ও সাংবাদিকদের কাছে স্বাভাবিক বোঝাতে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ঢাকায় ‘আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট’ আয়োজনের ঘোষণা দেয়। পাকিস্তানিদের এই কৌশলের পাল্টা চ্যালেঞ্জ হিসেবে ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত ও তহবিল গড়ে তোলার জন্য ভারতের মাটিতে খেলা অনুষ্ঠানকে একটি মিশন হিসেবে নিয়ে ১৯৭১ সালের জুন মাসে গঠন করা হয় ‘বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি’। 

বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির উদ্যোগে প্রতিবেশী ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনী ফুটবল খেলেন বাংলার দামাল ফুটবলাররা। তাদের চোখে ছিল অন্যরকম স্বপ্ন। বুকে ছিল বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশের প্রতি অপার ভালোবাসা। ফুটবল খেলার মাধ্যমে তারা গড়ে তোলেন অভূতপূর্ব জাগরণ। স্বাধীনতার মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত মুক্তিকামী এই ফুটবলারদের খেলা দেখার জন্য মাঠে দর্শকদের বাঁধ ভাঙা জোয়ার নামে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গড়ে ওঠে জনমত। খেলা থেকে অর্জিত অর্থ জমা দেওয়া হয় প্রবাসী সরকারের তহবিলে।

‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ বিশ্বের ক্রীড়া ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। সাঁতারু কানাইলাল শর্মা ও অরুণ নন্দী একটানা সাঁতার কেটে বিশ্বরেকর্ড গড়ে দারুণ সাড়া জাগাতে সক্ষম হন। এ থেকে অর্জিত অর্থ জমা দেয়া হয় মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে। মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে আয়োজিত হতো ক্রিকেট ম্যাচসহ অন্যান্য খেলা। 

খেলাকে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার করা যায়, বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত বিরল।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //