প্রতীক্ষা

আমি তখন মাধ্যমিক স্কুল পাস করে সবে কলেজে ভর্তি হয়েছি। বাড়ির একমাত্র ছেলে হিসেবে আমার চাওয়া পাওয়ার বিষয়টি অনেক গুরুত্ব দিয়ে দেখতো সবাই, না চাইতেই যেন সবই হাতের কাছে পেতাম। একবার হাতেমপুর স্কুলের সঙ্গে আমাদের দরিয়াগঞ্জ স্কুলের ফুটবল খেলা ছিল।

সেবার আমরা একেবারে থানার সেরা স্কুল ফুটবল দল ঘোষিত হবো এমন আশা করেছিলাম। কিন্তু তা হয়নি, আমাদের গোলরক্ষক জহির ভাই ছিল এর কারণ, সে আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র ছিল, একবার মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা দেওয়ার কারণে তাকে আর খেলতে দেওয়া হলো না ফাইনাল ম্যাচ। আমাদের জহির ভাইয়ের মতো অতো ভালো গোলরক্ষকও আর ছিল না। ফলে গোলরক্ষক সংকটে পড়ে গেল আমাদের দল।

আমি দলের খেলোয়াড় ছিলাম না, সবে ক্লাস নাইনে পড়ি- স্কুলের মাঠে দু-একবার খেলেছি। এইরকম বড় ম্যাচে কখনো খেলিনি। আমি সেদিন গিয়েছিলাম ফাইনাল খেলা দেখতে। গিয়ে ওই কা- দেখে মন খারাপ করে বসে আছি। এমন সময় রহমত স্যার ডাক জুড়লো, কার কাছে শুনেছে আমি ভালো গোলরক্ষক, ব্যস আমার অবস্থা খারাপ।

থানার মাঠে খেলা অত লোক দেখে এমনিই পিলে চমকানোর অবস্থা ওইখানে বল ধরব নাকি লোকের হই-হুল্লোড় শুনব। আমার অবস্থা বেগতিক দেখে বন্ধু হারুন বলল- আরে কেউ স্কুলের এই দলে চান্স পায় না চেষ্টা করেও, আর তুই চান্স পেয়ে ছেড়ে দিবি? এই সুযোগ ছাড়িসনে।

আমি বললাম- বাবা জানলে কী বলবেন? স্যার এসে বললেন- তোমার বাবাকে আমি বলব। তাছাড়া তোমার বাবা তো আমাদের স্কুল ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান। হেড স্যারও দেখলাম এগিয়ে আসছেন। আমি রাজি হয়ে গেলাম, কিন্তু আমার তো প্রয়োজনীয় জার্সি আর বুটও নেই।

রহমত স্যার বললেন- ওসব চিন্তা তোমার নয় আমি দেখছি। সব জোগাড় হলো, ভয়ে ভয়ে শেষে মাঠে নামলাম। দুটি অবধারিত গোল ফিরিয়ে দেয়ার পর আমাদের স্কুল আর এলাকার দর্শকরা আমায় হাত তালি দিয়ে অভিনন্দন দিল।

খেলা শেষ হতে বেশি আর বাকি নেই, তখন কোথা থেকে এসে বিপক্ষ দলের ফরোয়ার্ডের খেলোয়াড় জনি বল নিয়ে দ্রুত বেগে গোলে বল মারতে গেল, আর তখনি আমাদের ক্যাপ্টেন রঞ্জন এসে এমন ফাউল করল জনি ওরে বাবাগো মাগো বলে চিৎপটাং হয়ে মাঠে পড়ে চিৎকার করতে লাগল।

জনির কান্ডে দু-পাশের দর্শক ছুটে আসতে লাগল তুমুল মারধর হলো, খেলা আর হলো না। দু-দলের সমর্থকদের মধ্যে ইট পাটকেল ছোড়াছুড়ি।

রেফারি মহাদেব বিশ্বাস এত চেষ্টা করলো কোনো লাভ হলো না। শেষে পুলিশ নামলো মাঠে। কয়েকজন ধরে ফেলল। থানা নির্বাহী কর্মকর্তা এসে সব সামলে দিল। কিন্তু ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে। মাঠভর্তি আহত লোকজন। সমাধান আর হলো না। ফাইনালও আর চূড়ান্ত হলো না।

খেলা মানুষকে শেখায় ঐক্যবদ্ধ হতে, সেখানে মারামারি এ তো ভালো নয়। আর হলো সেই খেলা আমাদের স্কুলেরও আর সেরা ফুটবল দল হওয়া হয়নি। তবে আমার জীবনে সেদিন একটা নতুন ঘটনা ঘটেছিল। আমাদেরই পাশের গাঁয়ের একটি মেয়ে- থানা সরকারি গার্লস স্কুলে পড়তো, কনকলতা নাম তার।

তাকে আগে কখনো দেখিনি সে খেলা দেখতে এসেছিল। তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে আমার। দু-দলের সমর্থকদের যখন মারধর চলছে আমি তখন ভয়ে গিয়ে মেয়ে দর্শকদের গ্যালারিতে ঢুকে পড়ি। পাশেই ছিল সে। সেই-ই সেদিন আমায় মারের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। তারা যেখানে বসেছিল আমি ঠিক তাদের পেছনে লুকিয়েছিলাম, বিপক্ষ দলের দর্শকরা খুঁজেছিল আমাকে পেটাবে বলে।

কনকলতা বলেছিল, ওদের গোলরক্ষক অন্যদিকে পালিয়েছে। আমি আর কখনো ফুটবল খেলার নামও করিনি তারপর। কিন্তু কনকলতা আমার জীবনে এক আলোকবর্তিকা হয়ে এসেছিল।

আমার বাবার মৃত্যু হয় কলেজে উঠবার পর। আমার পড়ালেখা একবারে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়ে বাবার মৃত্যুতে। বাবা ছিলেন আমার সবচে বড় বন্ধু। পড়ালেখা থেকে শুরু করে বাবার সঙ্গে সবটাই আমার আলোচনা হতো। আমার দুই বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে মা-ও একা হয়ে পড়েন। গ্রামের বাড়ির সবকিছু চাচাদের দায়িত্বে দিয়ে শহরের বাড়িতে এসে মা আর আমি থাকতে শুরু করি।

এখান থেকে আমার কলেজও কাছে সেজন্যে সহজ হয় যেতে। কিন্তু কী হলো আমি ঢুকে পড়লাম একটি অসৎ পথে। কলেজেরই একটি ছেলে ছিল শহরেই ওদের বাড়ি। সে ছিল রাজনৈতিক পরিবারের ছেলে।

ওর নাম রতন। রতনের বাবা এলাকার প্রভাবশালী নেতা। এ ছাড়া রতন স্কুলজীবন থেকেই মাদকাসক্তও ছিল। আমি রতনের সঙ্গে মিশে মাদক নিতে শুরু করলাম। রাত করে বাড়ি ফিরতাম। মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতাম। একটুতেই রাগারাগি করতাম। মা আমার এমন আচরণে কষ্ট পেত। কিছুদিন চেষ্টা করেছিলেন আমাকে এসব থেকে দূরে রাখতে, গ্রামের বাড়িতে ফের ফিরে যাওযার বন্দোবস্তও করলেন কিন্তু আমি এই রঙিন দুনিয়া ছাড়তে রাজি ছিলাম না। ফলে মা আর আমার মধ্যে দেয়াল তৈরি হলো।

বলাবাহুল্য, এর মধ্যে কনকলতা ব্যস্ত ছিল তার পড়ালেখা নিয়ে। একবার পারিবারিকভাবে বিদেশে বেড়াতেও গিয়েছিল। ফলে আমার কোনো খোঁজখবরও সে জানতো না।

হঠাৎ করে একদিন শুক্রবারে সে আমাদের শহরের বাড়িতে এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমি তখন বাড়িতে ছিলাম না। মা তাকে পেয়ে আমার যত অন্যায় সব বলে দিল। কনকের বাবা ছিলেন থানার শিক্ষা কর্মকর্তা। কনক আর আমি তখন একই কলেজের শিক্ষার্থী সেইসূত্রে কলেজের একটি অনুষ্ঠানে ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয়ও হয়েছিল আমার।

মায়ের কাছে আমার বিষয়ে বিস্তারিত শুনে কনক আমাকে নিয়ে যে কী শুরু করল। আগে থেকেই আমরা দু-জন দু-জনকেই পছন্দ করতাম। সেটাও ছিল একটি কারণ হয়তো আমায় নিয়ে ওইরকম করে উঠে পড়ে লাগবার। কনক রীতিমতো আমার ওপর খবরদারি শুরু করল। ওর বাবাকে দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুলিশি অভিযানের ব্যবস্থা করল, ক্যাম্পাসে ধূমপান নিষিদ্ধ করল। অধ্যক্ষ মহোদয়ও রীতিমতো পৌরসভার ভেতরে তরুণদের মাদকের ছোবল থেকে বাঁচাতে মাদকবিরোধী কমিটিও করল।

কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো আমার। এসবের পেছনে কে বা কারা তা খুঁজতে আমার সেই ক্ষমতাবান বন্ধু নেমে পড়ল।

একটু একটু করে ওরা খোঁজ খবর করতে শুরু করল। আমার মাদক গ্রহণ বন্ধ হলো। আমি বইয়ের ভেতর ফের বন্দি হলাম। পড়ালেখায় মনোযোগী হলাম। কলেজের প্রতিটি ক্লাসে মনোযোগ দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আগের মতোই। নিয়মিত কনক সে সময় আমাদের বাড়িতে আসতো। আমরা একসঙ্গে মায়ের হাতে খেতাম। তারপর একটু সন্ধ্যে হতেই কনক আবার ফিরে যেত ওর বাড়িতে।

এভাবে বেশ চলছিল। কিন্তু একদিন একটু রাত হয়ে গেলে আমাকে মা বলল, কনককে বাড়িতে পৌঁছে দিতে। আমি ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ফিরছিলাম। মাঝপথে বন্ধু রফিক এসে আমার পথ আটকালো। আমি রফিকের মতিগতি দেখে ঠিকই বুঝেছিলাম, সে ঠিক নেই; আমাকে দু-চারটা গালাগাল দিল আমি তাতে কোনো উত্তর দিলাম না।

এতে আরো ক্ষেপে গিয়ে রফিক কনককে নিয়ে আজেবাজে কথা বরতে বলতে চলে গেলো। হুমকিও দিল দেখে নেবে আমাদের। এই ঘটনার ঠিক চারদিন পর কনকের মুখে এসিড নিক্ষেপের খবর এলো।

আমি খবরটা শোনামাত্রই হাসপাতালে পৌঁছুলাম। কিন্তু ততক্ষণে উন্নত চিকিৎসার জন্য ওকে নেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে জেলার হাসপাতালে। একবার কেবল দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম ওকে সেদিন। তারপর রফিক আর ওর দলবল সকলেই পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়।

বিচারে রফিক আর ওর সঙ্গী সাথীদের শাস্তি হয়। কিন্তু আমার কনকলতার কী হয়েছিল- তা আর জানার সুযোগ হয়নি। কেননা- কনকলতা এই শহরে আর ফিরে আসেনি। শুনেছি কনকলতা এখন ইংল্যান্ডের একটা বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষক হিসেবে পড়ায়।

আমি অনেক চেষ্টা করেছি তার খবর নিতে, তাও কিন্তু নয়। আমি জানি কনক আসবে, একদিন ঠিকই আসবে। আর আমি এখন কাজ করি একটা সফটওয়্যার কোম্পানির ডেভেলপার হিসেবে। গ্রামের বাড়ির একটা জায়গা মর্টগেজ রেখে নিজের প্রতিষ্ঠান দেব ভাবছি। কনক কী তাতে অখুশি হবে, নিশ্চয়ই নাহ!

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //