দারোয়ান

সাত বছর বয়সী কন্যা সন্তান অনুলার জনক রমিজ সাহেব বিশাল বিত্তের মালিক। স্ত্রী তাকসীয়াকে নিয়ে তার সুখের সংসার। আয়া আকলিমা এবং বাড়ির নিচ তলায় গেটের পাশে দারোয়ান এন্তাজ ও তার স্ত্রী, এই ক’জনকে নিয়ে বিশাল দোতলা বাড়িটি একরকম খাঁ খাঁ করে।

গাড়ির ড্রাইভার একলাস অনুলা এবং রমিজ সাহেবকে নিয়ে সকালেই বেরিয়ে পড়ে। দুপুরে মেয়ের স্কুল ছুটি হলে রমিজ সাহেবই মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফেরেন। দুপুরে স্ত্রী কন্যাসহ খাবার শেষে রমিজ সাহেব একটু বিশ্রাম নেন। এরপর ড্রাইভারকে নিয়ে আবার অফিসে চলে যান। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। 

রমিজ সাহের তার ব্যবসায়ীক সাম্রাজ্য নিজ মেধা ও পরিশ্রমের বিনিময়ে একাই গড়ে তুলেছেন। ব্যবসায়িক কাজে তাকে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি চট্টগ্রামের অফিসেও সময় দিতে হয়। বিদেশ ভ্রমণে স্ত্রীকে সব সময় সঙ্গে পান না। মেয়ে অনুলার স্কুল থাকে তাই স্ত্রী তাকে সব সময় সঙ্গ দিতে পারেন না। মেয়েকে নিয়ে তাকসীয়া একাই বাসায় থাকেন। আকলিমা তার সঙ্গে এবং বাড়ির দারোয়ান এন্তাজ দম্পতি গেটের পাশে নিচ তলায়। এ সময়টাতে তাকসীয়া মেয়ের স্কুলে যাওয়া আসার সময় ড্রাইভারের সঙ্গে মেয়েকে সঙ্গ দেন। আকলিমা ঘর গোছায়। ড্রাইভারের বাড়ি পাড়াতেই। সে রাতে নিজ বাড়িতে থাকে। 

রমিজ সাহেব বিশাল বিত্তের মালিক হলেও তিনি যে এলাকায় বাড়ি করেছেন সে এলাকাটি তেমন উন্নত নয়। তার সমকক্ষ বিত্তশালীদের বসবাস এ এলাকায় তেমন একটা নেই বললেই চলে। এলাকাটিতে রমিজ সাহেবকে অনেকেই সমীহ করলেও পাড়ার এবং বাহিরের মাস্তানরা বেশ বেপরোয়া। তাই তিনি প্রথমে দারোয়ানের হাতে লাঠি দিলেও অল্প ক’দিনের মধ্যেই দারোয়ানের অনুরোধে একটি উন্নত মানের একনলা বন্দুক তুলে দেন। এতে কাজ হয়েছে। পাড়ার মাস্তানদের বাড়ির আশপাশে আর তেমন একটা দেখা যায় না। 

সুস্বাস্থ্যবান ও সুদর্শন গ্র্যাজুয়েট দারোয়ান এন্তাজ শুধু যে সাহসী কেবল তাই নয়, সে চৌকস এবং বুদ্ধিমান জোয়ান। স্ত্রীকে নিয়ে নিঃসন্তান এন্তাজ বাড়ির ভেতর গেটের পাশে মধ্যমাকৃতির যে কক্ষে থাকে তার একপাশে টয়লেট ও একটি কিচেন। সেখানেই তাদের রান্নাবান্না খাওয়া-দাওয়া। আকলিমা সার্বক্ষণিক তাকসীয়া ও অনুলার দেখভাল করে। তবে তাকসীয়া স্বামী-সন্তানকে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়ান। এ ব্যাপারে তার কোনো গাফিলতি নেই; এ কাজে আকলিমা তাকে সাহায্য করে।

আকলিমা তাদের সঙ্গে এক টেবিলে খায়। অল্প বয়সেই স্মার্ট উচ্চ মাধ্যমিক পাশ আকলিমা বাড়ি থেকে শহরে আসার পথে লঞ্চ দুর্ঘটনায় স্বামীসহ দু’বছরের একমাত্র সন্তানকে হারায়। সে অনুলার আন্টি এবং রাতে একই কক্ষে আলাদা বিছানায় শোয়। তাকসীয়া আকলিমাকে স্বর্ণের একজোড়া দুল বানিয়ে দিয়েছেন।

এন্তাজের হাতে উন্নতমানের অস্ত্রটি আসার পর পাড়ার মাস্তানদের কাছে তার কদর বেড়ে গেলো। মাস্তানদেরও কেউ কেউ লুকিয়ে-ছাপিয়ে দেশীয় অস্ত্র যেমন রাম-দা, কাটা রাইফেল জাতীয় অস্ত্র ব্যবহার করে। দোতলার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে তাকসীয়া লক্ষ্য করেন পাড়ার কতক মাস্তান মাঝে মধ্যে এন্তাজকে সালাম দেয়। মাঝে মধ্যে আকলিমাকেও তা দেখান। ব্যাপারটা তাকসীয়া স্বামীর কানে তুলেন।

এতে রমিজ সাহেব খুশি হয়ে এন্তাজের একনলা বন্দুকটি বদলিয়ে তাকে একটি দো’নলা বন্দুক কিনে দেন। সঙ্গে তার সাবেকী পোশাক-আশাক বদলে হালফ্যাশনের পোশাক-আশাক বানিয়ে দেন এবং তার বেতন দ্বিগুণ করে দেন। এন্তাজ খুশি হয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে কাজে মনোযোগী হয়। এতে রমিজ পরিবারে নিরাপত্তাবোধ বহুগুণ বেড়ে যায়।

এর মধ্যে হঠাৎ একটি অঘটন ঘটে গেল। এক রাতে এন্তাজ রমিজ সাহেবকে মোবাইলে জানালো তার স্ত্রী অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। রমিজ সাহেব তাকসীয়া দৌড়ে নিচে নেমে এলেন। এন্তাজ দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। রমিজ সাহেব ড্রাইভারকে মোবাইল ফোনে ডাকলেন। ড্রাইভার এলে অজ্ঞান স্ত্রীকে কোলে করে এন্তাজ গাড়িতে তুলে পেছনের সিটে বসলো।

রমিজ সাহেব একলাসের পাশে সামনের সিটে। হাসপাতালে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক এন্তাজের স্ত্রীকে মৃত ঘোষণা করলেন। মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক। এ ঘটনার পর এন্তাজ চাকরি ছেড়ে বাড়ি চলে যেতে চেয়েছিলো। বাড়িতে তার বিষয় সম্পত্তি আছে, এরই দেখভাল করবে। কিন্তু রমিজ সাহেব তাকে ছাড়লেন না। রমিজ সাহেব তাকে আবার বিয়ে করিয়ে দেবেন বলেছিলেন। কিন্তু এন্তাজ আর বিয়ে করবে না পণ করলো। সে তার মৃত স্ত্রীর পোশাক-আশাক স্বযত্নে সংরক্ষণ করেছে।

রমিজ সাহেব এন্তাজের কক্ষটি আরো সুসজ্জিত ও আরামদায়ক করে দিলেন। এবার রমিজ সাহেব তার জন্য একটি রিভলবারও কিনে দিলেন। এন্তাজ খুশি হয়ে অল্প দিনের মধেই স্ত্রী বিয়োগব্যথা ভুলে গেল। তার মাঝে এক ধরনের আভিজাত্যবোধ জন্ম নেয়। রমিজ সাহেব বোঝেন এন্তাজের অস্ত্রের নেশা আছে। রিভলবারটি কোমরে ঝুলিয়ে এন্তাজ মাঝে মাঝে গেটের বাইরে পায়চারি করে।

তাকসীয়া তা লক্ষ্য করেন এবং দেহ-মনে এক অনির্বচনীয় শিহরণ অনুভব করেন। একদিন তাকসীয়া স্বামীকে বলেন যে এন্তাজকে তো তাদের সঙ্গে সকাল দুপুর এবং রাতের খাবারটা খেতে দেয়া যায়। সে একা রেধে খায়। রমিজ সাহেব বললেন যে, আয়া আকলিমা যেহেতু তাদের সঙ্গে খায় সে ক্ষেত্রে দারোয়ান এন্তাজকে তাদের সঙ্গে খেতে দিতে তার আপত্তি নেই। এ কথা মুখে বললেও রমিজ সাহেবের মন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু এটাও ভাবলেন এন্তাজ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। এতে করে তার মনটা একটু চাঙ্গা হতে পারে। তাই তিনি আপত্তি করলেন না। 

প্রথমে এন্তাজ একটু সংকোচ ও রমিজ সাহেব অস্বস্তিবোধ করলেও অল্প ক’দিনের মধ্যেই ব্যাপারটা সবারই গা সওয়া হয়ে গেল। এরা পাঁচ জন একই টেবিলে একই সঙ্গে খায়। খাবার খেতে এন্তাজ রুচিসম্মত সিভিল ড্রেসে আসে। এন্তাজ যে এ বাড়ির দারোয়ান সেটা সকলের মাথা থেকে প্রায় মুছে গেল। খাবার খেতে এলে অনুলা এন্তাজকে আঙ্কেল বলে জড়িয়ে ধরে। সবার কাছেই ব্যাপারটা এতদিনে স্বাভাবিত হয়ে গেছে। এন্তাজ এখন আর এ বাড়ির দরোয়ান নয় অনুলার আঙ্কেল এবং এ পরিবারেরই একজন সদস্য। আকলিমা যাতে এন্তাজকে কোনো প্রকারেই উপেক্ষা বা ঠাট্টার পাত্র না করতে পারে সে দিকে তাকসীয়া সজাগ দৃষ্টি রাখেন। 

রমিজ সাহেব বাড়ির বাইরে বা বিদেশে গেলেও এ রেওয়াজের ব্যত্যয় ঘটে না। তাকসীয়া অনুলা আকলিমা ও এন্তাজ একই টেবিলে বসে সকাল দুপুর রাত তিন বেলা খায়। আকলিমা বিকেলের নাস্তাটা এন্তাজের কক্ষে দিয়ে আসে। তাকসীয়ার বিবেচনায় এ বাড়ির নিরাপত্তার জন্য রমিজ সাহেবের তুলনায় এন্তাজের গুরুত্ব ঢের বেশি। পাড়ায় তার সম্মানও বেশি। রমিজ সাহেব ব্যবসা চালান আর বাইরে বাইরে থাকেন। পাড়ার লোক তাকে গাড়ির ভেতর দেখে। এন্তাজকে সকলেই চেনে এবং তার রিভলবারটির জন্য তাকে সবাই সমীহ করে। এই দেখে বিপত্নীক এন্তাজের প্রতি তাকসীয়ার মনের গোপনে এক ধরনের মমত্ব ও শ্রদ্ধাবোধ জন্ম নিয়েছে। 

এক দুপুরের আগে আকলিমা বোনের বাড়ি বেড়াতে গেলে তাকসীয়া নিচে নেমে এসে এন্তাজের রুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। অনুলা স্কুলে। রমিজ সাহেব আসার পথে ড্রাইভারকে সঙ্গে করে অনুলাকে বাসায় নিয়ে আসবেন। দুপুরে খাবার সময় সকলে এক টেবিলে এক সঙ্গে হয়।

সেদিন খাবার টেবিলে এন্তাজকে কেমন যেন একটু অপ্রস্তুত মনে হলো। তাকে মুডে আনার জন্য তাকসীয়া রমিজ সাহেবের কাছে প্রস্তাব করলেন এন্তাজের রিভলবারটা বদলে এর চেয়ে উন্নতমানের একটা রিভলবার দেওয়া যায় কিনা। রমিজ সাহেব প্রস্তাবটি বিবেচনা করে দেখার আশ্বাস দিলেন। যেমন কথা তেমন কাজ। অল্প দিনের মধ্যেই এন্তাজকে একটি নতুন জিপি হান্ড্রেড পয়েন্ট টুটু এল আর রিভলবার দেয়া হলো। আরেক দিন এমনই পরিস্থিতিতে তাকসীয়া এন্তাজের জন্য আরো উন্নতমানের নতুন পোশাকের প্রস্তাব করলেন। এন্তাজ তাও পেল। ঘটনার পুনঃপৌনিকতায় এন্তাজ অভ্যস্ত ও স্বাভাবিক হয়ে এলো। 

মাঝে মধ্যে খাবার টেবিলে রমিজ সাহেব স্ত্রীর সঙ্গে ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনা করেন। কখনো কখনো এন্তাজকেও এ আলোচনায় টেনে আনেন। রমিজ সাহেব বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন এন্তাজ ব্যবসা ভালো বোঝে। একদিন এন্তাজকে তিনি প্রস্তাব করলেন সে যেন দারোয়ানের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়। কিন্তু তাকসীয়া বাদ সাধলেন। বাড়ির নিরাপত্তার কথা তুলে তাকসীয়া এ প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। রমিজ সাহেবও ভাবলেন কথা ঠিক। এর পরও তিনি এন্তাজের ব্যবসায়িক বুদ্ধির প্রশংসা করলেন। এন্তাজ কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল। এক পর্যায়ে তাকসীয়া বুঝল রমিজ সাহেবের ব্যবসা চালাবার জন্য এন্তাজই যথেষ্ট। এ ছাড়াও সে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ। পাড়ার মাস্তানরা তাকে শ্রদ্ধা ও ভয় করে।

রমিজ সাহেব ব্যবসার কাজে এক সপ্তাহের জন্য চট্টগ্রাম গেলেন। এক রাতে তাকসীয়া বেড রুমে শুয়ে এন্তাজের কাছে জানতে চাইলেন এটাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া যায় কীভাবে। তাকসীয়া কার কথা বলছেন, এন্তাজ বুঝল। তবে এন্তাজ কোনো জবাব দিল না। চুপ করে রইল। তাকসীয়া এন্তাজকে একই প্রশ্ন আবার করল। এন্তাজ এবারও চুপ করে রইল। আরেকবার। এন্তাজ চুপ।

এবার তাকসীয়া বিরক্ত হয়ে তার দেহের ওপর থেকে এন্তাজকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে বললো, সে যেনো রমিজ সাম্রাজ্যের মনিব বনে এ কাজ নির্বিঘ্নে তার সঙ্গে বাকি জীবন করে যেতে পারে, সে জন্যই তার কাছে জানতে চাইছে এটাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া যায় কী করে। এন্তাজ তাকসীয়ার মাথায় হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করে জানালো সেও এটাই ভাবছে। আবেগাপ্লুত তাকসীয়া এন্তাজকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। 

পরদিন বিকেলে আকলিমা এন্তাজকে নাস্তা দিতে যেয়ে আসতে দেরি করছে। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি আকলিমাকে নাম ধরে ডাকলেন। একবার। দু’বার। তিনবার। আকলিমার কোনো সাড়া না পেয়ে তিনি নিচে এসে দেখেন কক্ষের দরজা বাহির থেকে হ্যাজবোল্ট দিয়ে আটকানো। দরজা খুলে দেখেন কক্ষে কেউ নেই। এন্তাজের অস্ত্র এবং পোশাকসহ গেটের বাইরের টিপ তালার চাবি, একটি চিরকুট, আকলিমার কানের দুল ও সালোয়ার-কামিজ বিছানায় পড়ে আছে। চিরকুটটি হাতে নিয়ে তাকসীয়া পড়লেন। ‘স্যার, শেষ অনুরোধ। আমাদের খোঁজ করবেন না। ইতি এন্তাজ ও আকলিমা’।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //