দগ্ধ সূর্য

অনেক দূর থেকে একটা সাইরেনের শব্দ ভেসে এলো। আর অন্য কেউ শুনতে পেয়েছে কি না জানি না, আমি শব্দটা শুনতে পেলাম- শব্দটা শুধু কানে এলো না, শব্দটাকে আমি ঠিকঠাক বুঝতেও পেরেছি। শব্দটা অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন, অ্যাম্বুলেন্সটা আসছে আমার জন্য। আমি বেরিয়ে আসি। কোনো প্রকার যুক্তি বা দোহাই এক্ষেত্রে কাজে লাগবে না; ওপর তলায় ব্যাপারটা স্থির হয়ে গেছে: আমার অসুখ, তাই আমার চিকিৎসা দরকার।

কয়েক মুহূর্ত পরে ধীরে ধীরে অ্যাম্বুলেন্সটা এসে থেমে গেল। একটু ক্ষণের মধ্যেই আমার কাছে এসে দাঁড়ালো অ্যাম্বুলেন্সটা। থামলো। যে কারণে অপেক্ষা করছিলাম তা হলো না, বদলে গাড়ি থেকে দু’জন লোক নেমে এলো। তারা আমার সঙ্গে একটা কথাও বললো না; কিন্তু তাদের মুখ আর হাবভাব দেখেই ব্যাপারটা আমি পরিষ্কার বুঝে যাই। ফলে দ্রুত পায়ে আমি অ্যাম্বুলেন্সটার দিকে এগিয়ে গেলাম, এবং ভেতরেও ঢুকে পড়লাম। আমার পিছু-পিছু দু’জন লোকও অ্যাম্বুলেন্সে ওঠে, একজন আমার মাথার কাছে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিল। দরজা বন্ধের শব্দ শুনে ড্রাইভার লোকটি আমার দিকে এক পলক তাকায়। তার কালো দাঁতের ফাঁকে সাদা সিগারেট চকমক করে। আমার গলায় কি যেন আটকে যায়, আমি ঢোকও গিলতে পারি না। 

হিমশীতল রাস্তার ওপর দিয়ে চাকাগুলো পাক খেতে থাকে। আর কেউ খেয়াল করেছে কি না বলতে পারব না; কিন্তু চাকাগুলোর ঘূর্ণনে একটা বোঁ-বোঁ শব্দ হচ্ছিল। কী ঘটেছে বা ঘটতে চলেছে কিছুই আমি বুঝতে পারছি না,- তারা একটা কথাও বলছে না। জিজ্ঞেস করার মতো সাহসও আমার নেই। তাদের ওপর আচমকা আমার চোখ পড়তে মনে হলো, কত যুগ ধরে যেন আমি তাদের দেখছি। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল, মাঝে মাঝে তারা যেন গভীর কোনো চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ছে।

ড্রাইভার নিশ্চয়ই জানতো, কোথায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে; আর তাই এক সময়ে গাড়িটা থেমেও গেল। উঠে বসবার চেষ্টা করতেই তারা আমার দুবাহু আঁকড়ে ধরল, তারপর নির্দিষ্ট স্থানাভিমুখে আমাকে নিয়ে চলল। অতঃপর নিজেকে আমি আবিষ্কার করি অন্ধকার একটি সেলের মধ্যে, সেখানে মাত্র একটা বেড। ভগবান জানেন, সেই বিছানায় কী যেন একটা বিছানো ছিল। সেই বেডে পৌঁছে দেখি সেটা একটা কম্বল। লাল, যেন রক্তে ভেজা লাল রঙের সাদা রঙের একটা কঠিন দেয়াল।

কেন যে দেয়ালটার রঙ সাদা, তা আমি বুঝতে পারিনি- হয়তো ঘরটা কিছুটা আলোকিত হবে বলেই; কিন্তু তাহলে বাতি কোথায়? সেলটায় তো জমাটবাঁধা নিকষ অন্ধকার। তবে দেয়াল সাদা কেন? ইচ্ছে হলো, জিজ্ঞেস করি; কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করব? কোনো লোকই তো নেই। আর যদি লোক থাকতও, আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারতাম? তখন একটানা একটা আশ্চর্য শব্দ কানে আসে- টিপ-টিপ-টিপ।

এই শব্দে আমার মধ্যে কী যেন ঘটে যায়। আমার ভাঙাচোরা অন্তঃস্থল যেন কাঁপতে থাকে।... এই দীর্ঘস্থায়ী টিপ-টিপ শব্দ আর কাঁপুনি কতক্ষণ ধরে চলবে? এই প্রকোষ্ঠে- এই পরিবেশে আমিই বা কত সময় থাকব? কোনো কিছুই আমার কাছে বোধগম্য হচ্ছে না। বাইরে কি ঝলমলে রোদ? না কি বৃষ্টি হচ্ছে? আজ যদি আকাশটা নির্মেঘই হবে তবে এই টিপ-টিপ শব্দই বা কোত্থেকে আসছে? আর যদি তুষারপাত হয় তবে তো কোনো শব্দই হওয়ার কথায়। মনে মনে ভাবি, ভাবি নয় শুধু, ইচ্ছা করি,- দেয়ালটা- ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাক, দেয়ালটা সরে গেলে আমি বাইরে তাকে পারবো, দেখতে পাবো বাইরে কী হচ্ছে।

এই সেলের মধ্যে আমি কতকাল ধরে রয়েছি? জানি না, কিছুই জানি না। প্রথম দিকে কোনো গুঞ্জন শুনিনি, মাঝখানে কোনো একটা সময় থেকে তা শোনা যেতে থাকে। এই গুঞ্জন ধ্বনি কি কখনো থামবে? এতকাল তো আমি শান্ত নির্দোষ জীবন কাটিয়েছি, আমাকে কেন তবে ওরা পাগল বানিয়ে রাখবে? কেন আমার জীবনের পরিবেশটা ওরা বদলে দেবে? স্থান বদলেই কি কোনো দিন কোনো মানুষের অসুখ সারে? এ কেমন নিদান!...

এই প্রকোষ্ঠে আমি অনেক দিন ধরে আছি। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই তো সবে এসেছি; আবার কখনো মনে হয়, বছরগুলো যেন গুনে গুনে শেষ করা যাচ্ছে না। চূড়ান্ত পরিণতিটা কোনো দিন কল্পনায়ও আসেনি আমার। আর সত্যি কথা বলতে কি, চিরকালই তো আমি প্রতীক্ষায় থাকি এমন কিছুর, যা কোনো দিন ঘটে না, ঘটবে না।

আমাকে তারা যে দেয়াল দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়েছিল সেই দেয়াল ভেদ করেই যেন তারা দু’জন ঢুকে এল, আর ঢুকেই তারা আমার দিকে এগিয়ে আসে। তারা কোনো কথা বলছিল না। তাদের একজন বেড থেকে লাল কম্বলটা তুলে দিল। আমি সাদা চাদরটার দিকে তাকাই, তারপর সাদা দেয়ালের দিকে, তারপর আমি চোখ তুলে তাকাই তাদের মুখের দিকে। দেয়ালগুলো সাদা কেন?-এই ভাবনাটা আমার মস্তিষ্কে খেলে যায়। আবার এটাও সত্য, তাদের কাছে এই প্রশ্নটা করবার মতো সাহস আমার ছিল না।

নিঃসন্দেহে তারা আমার চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান, চালাক-চতুর- আমার মুখের দিকে তাকিয়েই তারা আমার মনের কথাটা বুঝে নিয়েছিল; দু’জনার একজন বললো, ‘মৃত্যু ঘটার আগেই মৃত্যুর সঙ্গে পরিচয় থাকা দরকার, তাই দেয়ালগুলো রুক্ষ সাদা।’ তারা আমার দখল নিয়ে নিল। চিৎ করে তারা আমাকে সাদা চাদরে শুইয়ে দিল। তারপর কিছু ধারালো যন্ত্রপাতি দিয়ে আমার মুখটা তারা দু’ফালি করে কেটে ফেলল। একাংশজুড়ে রইল দেহ কাঠামোর সঙ্গে, বাকি অংশটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হলো।

একজন একখন্ড কাপড় নিয়ে এসে সেই কাপড়খন্ডের আমার বিচ্ছিন্ন মুখের অংশটা মুড়ে ফেলল; তারপর সেই পুঁটলিটা আমার চোখের আড়ালে কোনো নিরাপদ স্থানে রেখে দেওয়া হলো। ব্যাপার-স্যাপার কিছুই বুঝতে পারছিলাম না আমি,- শুধু চারদিকে মৃত্যুর নীরবতা। তারা কোনো কথা বলছে না; কিন্তু জিজ্ঞেস করতেও আমার সাহসে কুলোচ্ছে না। অতঃপর, একটা লকেট ঝুলছে, সেই লকেটটায় একটা সংখ্যা খোদাই করা। সেই সংখ্যাটা পড়বার আপ্রাণ চেষ্টা করি; কিন্তু কিছুতেই পারি না।

ঘটনা হলো, মুখের যে অংশটা কেটে ফালি করা হয়েছিল সেই বিচ্ছিন্ন অংশেই ছিল আমার চোখ দুটো। তাহলে আমি পড়ব কী দিয়ে?... তারপর যে পথ দিয়ে আমাকে সেলে ঢোকানো হয়েছিল সেই পথ ধরেই আমাকে বার করে নিয়ে আসা হলো। বেরিয়ে আসতেই সেই দু’জনার একজন আমাকে বলে দিল, ‘যান, এবার আপনি মুক্ত। কোনোদিন আর অ্যাম্বুলেন্স দেখতে পাবেন না, এখানেও আর আপনাকে নিয়ে আসা হবে না।’

কাশ্মীরি ভাষার ধ্রুপদী সাহিত্যের এই গল্পটি ভাষান্তর করেছেন- রায়হান মুনতাসির

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //