থাপ্পড়

কুয়াশা চিরে এখনো দিনের সূর্য দেখা যাচ্ছে না। সিলভিয়া আর রুবায়েত ঠাণ্ডা পুকুরের জলে ডুব দিয়ে গোসল সেরেছে। মাঠের দিকে এগোচ্ছে, মায়ের চোখের ঘুম তাড়ায়নি তখনো। তাই সকালের নাশতাটা আর করা হলো না।

চুল থেকে চুপসে যাওয়া কিছু জল এখনো সাদা স্কার্ফ ভিজিয়ে দিচ্ছে সিলভিয়ার। ঠোঁটে ভ্যাসলিনের মায়াময় গন্ধ পথকে পবিত্র করে তুলল। মুখে বাংলা-ইংলিশের খিচুড়ি পাকানো কথায় ছোট ছোট বাক্যে, অস্থির একটা ঘোর তৈরি করে তোলে শ্রবণকারীদের কানের পর্দায়।

কেননা ফাইভ পর্যন্ত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের পাঠ চুকিয়ে, দশম শ্রেণি উতরে যাওয়ার বেলায়ও অভ্যেস বদলায়নি, বরং বাড়ছে। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে মাইকে নির্মল কণ্ঠের গান... ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, বাংলার স্বাধীনতা আনলে যাঁরা...’

স্কুলমাঠে ঢুকতে দু’ধারে বিভিন্ন রঙের ত্রিকোনা কাগজ পাটের সুতলিতে লাগিয়ে। ডেকোরেশনের কাপড়ের গেটে লেখা বড় বড় অক্ষরে,

‘প্রধান অতিথি- (অমুক) মন্ত্রীর নাম...

মাঠের মাঝখানে স্থানীয় থানা পুলিশ, আনসার-ভিডিপি বাহিনীর কুচকাওয়াজ। পায়ের বুটের অস্থির দাবড়ানিতে চৈত্রের বাতাসে কচি ধানগোছার মাথা দুলছে। মাঠের মাঝখানে মেয়েদের হলুদ ড্রেসগুলো যেন সর্ষে ফুলের বাগান। মাঠের জবান খুললে নিশ্চিত যুদ্ধ লেগেই যেত!

জাতীয় সংগীতে সবাই দাঁড়িয়ে মুখে মুখ মিলাল। পুরো মাঠের মাটিও যেন দেশপ্রেমের মরমে মরমে ভীষণ আবেগে আক্রান্ত। হঠাৎ তেড়ে আসা তীরের মতো মাঠের কোনা থেকে দৌড়ে এল এক উজবুক। ঠিক যখন মন্ত্রী মহোদয় ফিতার এক মাথা টেনে টেনে পতাকা উড্ডয়ন করছে আকাশে। হঠাৎ সবার দেশপ্রেমের মুখস্থ বুলির তাল কেটে গেল, তারপর হইচই...

মন্ত্রীর এপিএস ও স্থানীয় নেতারা উজবুকটিকে অনেক টেনেহিঁচড়েও যখন নাড়াতে পারছে না, এপিএস চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘শালার বাঙ্গালি, ভদ্রতার বংশও নেই!’

হয়তো সে জানে না, মানুষটি পাগল। কোত্থেকে এসে খড়কুঠোর মতো এ মফস্বলের অলিগলিতে সারা দিন হাঁটতে থাকে ঝোলা ও হাতে লাঠি নিয়ে। মাথায় বেঁধে থাকে কাপড়, কখনো দড়ি। সারাক্ষণ ডান হাতের তর্জনী বন্দুকের নলের মতো তাক করে ‘ঠাস, ঠাস’ শব্দ করতে থাকে। কখনো কখনো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ঘুরে ঘুরে ঠাস, ঠাস...

অনেক ধস্তাধস্তির পর যা একটু সরাল। মাঠের বাইরে যতবার নিয়ে যাচ্ছে, ততবার গড়াগড়ি দিয়ে মাঠে এসে যাচ্ছে। এমন একটি দিনে পাগলটিকে মারধর না করার শপথ করেছে বুঝি। সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছলেও মাঠের এক কিনারে দাঁড় করিয়ে রাখল, নেতা নামধারীরা দাঁতে দাঁত চেপে। কয়েকজন পাগলটির মতিগতির নিবিড় নজরদারিতে বলয় করে আছে।

দুপুরবেলার শেষে দৌড়, লাফালাফি, গোলক, তীর নিক্ষেপের খেলাধুলার ইভেন্টের পরে সারা মাঠে তখন মুক্তিযুদ্ধের অভিনয় শুরু। আমগাছের ডাল পুঁতে, কাব-স্কাউটের বন্দুক উঁচিয়ে ছাত্রদের মাঠে অগ্নিমূর্তি ধারণ। এমন একটা দিন দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তা মনে পড়ে যেন আগত দর্শকদের। হাত থেকে ছুড়ে মারছে বালুভর্তি পলিথিনের ঠোঙা আর পাগলটিও এক কিনারে মুক্তিযুদ্ধ করছে, মুক্তিযোদ্ধার মতোই। কখনো মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে তর্জনী উঁচিয়ে ঠাস, ঠাস করেই যাচ্ছে। পাশের মেয়েগুলোর তাতে ঘটঘটে হাসির রোল। শেষে যখন রাজাকার পালাচ্ছে ছেঁড়া পাঞ্জাবি উঁচিয়ে, তখন পাগলটির ভোঁ-দৌড়। পিছে পাতি নেতাদের ‘ধর, ধর...।’

ধস্তাধস্তির চরমে পাগলটিকে আবার কিনারে আনা গেল। সে কিনারে মেয়েগুলোর উপচে পড়া হাসির অগ্রভাগে কালো চশমা পরিহিতা যুবতী বয়সের ম্যাডামও হাসতে হাসতে নেতিয়ে পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ ম্যাডাম নিজেকে দাঁড় করাল। নিজেকে গুছিয়ে পাগলটিকে ধমক দিয়ে চেঁচাল ‘এই রাবিশ, গেট আউট, গে...’

আচমকা পাগলের বাম হাত ঘূর্ণিঝড়ের বেগে ম্যাডামের ডান গালে সজোরে আঘাত হানে। এ যেন চৈত্রে আষাঢ়ের বজ্রপাত। গাল বেয়ে গলগল করে রক্ত বেয়ে পড়ছে। ম্যাডামের ডান হাতে রক্তের ধারাসহ একটি বড় দাঁত! ম্যাডামের কান্নাও যেন কেউ গিলে ফেলল। পাতি নেতারা এমন ঘটনার সাক্ষী, তাও টের পেল ঘটনার শেষে। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে পাগলটির ওপর কিল-ঘুষির মাধ্যমে দিবসের উদযাপন। পাগলটি সেখান থেকেও সর্বশক্তি দিয়ে স্লোগান দিচ্ছে গলা ফাটিয়ে, ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা, জ-য় বাং-লা...

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //