একদিন প্রতিদিন

আজ রকিবের দেরি হয়ে গেছে। মায়ের কাশি বেড়েছে। সারা রাত হাঁসফাঁস করে মা সকালে ঘুমিয়ে পড়ে। তখন পাশের দোতলা বিল্ডিং থেকে রেডিওয় বিবিসির প্রভাতি খবর ভেসে আসছিল। রাতে সেও ভালোমতো ঘুমাতে পারেনি। মায়ের কাতর অবস্থায় বিছানা থেকে উঠে পড়ে। সর্ষে তেলে রসুনের দুটো কোয়া ফেলে গরম করে। মায়ের হাত-পায়ের তালুতে মেখে দেয়। মা বলে-

‘থাক বাবা আপনি সেরে যাবে। তুই ঘুমো।’

‘থাকবে কেন মা? আমি ছাড়া তোমার কে আছে? আমি যদি তোমার সেবা না করি তো কে করবে?’

‘তুই বড্ড জেদি রকি। তোর বাবার মতো হয়েছিস।’

মায়ের মুখে অত কষ্টেও হাসি ফুটে ওঠে। সে হাসি লণ্ঠনের টিমটিমে আলোয় ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে। তারপর দু’হাত বাড়িয়ে আদরে আদরে রকিবের এলোমেলো চুল আরও ছড়িয়ে দেয়। তখন মন বিষণ্ন হয়ে পড়ে। বাবার কথা মনে আসে।

‘মা বাবা কেমন ছিল?’

‘আবার সেই কথা? কত আর বলব? ফরসা এক রাজা। রাসভারী কণ্ঠস্বর। চেহারায় সবসময় হাসি। চকচকে দু’চাখ। কাজ ছাড়া কিছু বুঝত না।’

‘আমাকে কোলে নিত? আদর করত?’

‘শোনো কথা, কাজ শেষে ঘরে ফিরে এসে আগে তোকে নিয়েই তো লোফালুফি। তখন তুই কচি শিশু। আমি ভয়ে আঁতকে উঠি। আর তোরা দুই বাপবেটা হি হি করে হাসতি।’

‘যাহ্ তাই বুঝি! আচ্ছা মা বাবার কী হলো? বাবা আসে না কেন? আমাকে কোলে নেবে না?’

‘সে অনেক কথা বাবা। দুঃখের কথা।’

মা বেশ জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। লণ্ঠনের সলতে কেঁপে কেঁপে তরঙ্গ ঢেউ। ঘরের গুমোট বাতাস উদাস বিষণ্ন। রকিব একটু একটু বোঝে। মায়ের মুখ ঘুরিয়ে চোখ মোছা যে ভোলার নয়। তবু মন জানতে চায়। বাবা থাকলে তাদের দুঃখ থাকত না। শ্বাসকষ্টের এ শরীরে মাকে অন্যের বাসায় কাজে ছুটতে হতো না। তার কচি মনে দুঃখ জোরালো হয়ে বাজতে থাকে। তার কি কিছু করার নেই? সে একদিন বলে-

‘মা আমি তোমার সাথে কাজ করব। তুমি অসুস্থ শরীরে কাজ করো আমার কষ্ট হয়।’

মা হাসে। সে হাসি কত মধুর। পৃথিবীর সব মায়ের হাসি বুঝি এমন মধুর। কিন্তু সে হাসি ভোলার নয়। বাবা নেই, সে কাজ করবে। তার কাজ করা হয় না। মন বিষাদে ভরে থাকে।

‘তুই বড় হলে কাজ করবি বৈকি বাবা। এখন এই ছোট্ট দুটি হাতে আমাকে জড়িয়ে ধর।’

মা কথা বলতে বলতে তাকে জড়িয়ে ধরে। কেন জানি খুব কাঁদে। কেঁদে যায়। মায়ের মনে কোনো ব্যথা জেগে উঠে থাকবে। তার সব অজানা।

‘এই হাতে কত কিছু রান্না করি বাপ, তোর জন্য একটু আনতে পারি না। দুর্ভাগ্য আমার পেছন পেছন ঘুরে বেড়ায়।’

সেদিন রাতে মা আবার কাঁদে। রকিব জানে না। পরদিন বুঝেছিল। মায়ের চোখ-মুখ লাল। ফুলে উঠেছে। তার ফরসা চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। সে দুঃখ পায়। বুকে খুব কষ্ট বাজে। তবু কিছু বলেনি। বলতে পারে না। একদিন সে সত্যি কাজে নামবে। পয়সা রোজগার করবে। হোক সামান্য... তবু তো উপার্জন।

মাকে তার আশ্চর্য রকম অদ্ভুত লাগে। তার প্রথম উপার্জনের ক’খানি টাকা হাতে নিয়ে সরকারি কলতলার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। ঠিক ওদিকে নয়, যেনবা দৃষ্টি অনেক দূর চলে যায়। চোখ দুটো অশ্রুসজল... অনেক অনেক ভেজা। আজও রকিবের সে কথা মনে পড়ে।

‘ও মা, তোমার ভালো লাগছে না? আজ আমি কত্ত টাকা এনেছি।’

‘হ্যাঁ রে বাপ, তুই যে বয়সে খেলবি সে সময়ে কিনা...!’

‘মাগো আমি টাকা জমিয়ে ক্রিকেট খেলা শিখব। বুঝলে, এমন ব্যাট হাঁকাব যে বল আর ফিরে আসবে না। বাবার মতো আর ফিরে আসবে না।’

‘রকিব!’

মা কেমন অদ্ভুত চিৎকার দিয়ে ওঠে। রকিব এমন আর্তনাদ কোনোদিন শোনেনি। সে বিহ্বল হয়ে পড়ে।

‘বাবা কেন আসে না মা? ও মা, বাবার কাছে চলো। আমাদের খুব কষ্ট। আজ কত দূর ঘুরেছি... কত্ত দূর।’

‘তোর বাবা যে অনেক দূর চলে গেছে বাপ। অনেক দূর। সেখান থেকে কেউ ফেরে না... কেউ না।’

রকিব ফেরা না ফেরার কথা বোঝে। সেদিন মায়ের গলা জড়িয়ে খুব কাঁদে। তারপর আবার কাজ। মা কয়েক দিন ধরে বিছানায়। কাজে যেতে পারে না। যে বাসায় কাজ করত, তারা নুতন লোক রেখেছে। তারপর কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। মা আবার অন্য বাসায় কাজ করে। শুকনো কাশি বুকে চেপে চুপচাপ খেটে যায়। এখন রকিব মায়ের সঙ্গে কথা বলে। সে কথা শুধু কাজের কথা। কাজ নিয়ে দুজনে হাসে। জীবনের ছোট ছোট টুকরো কথামালায় অনেক হাসি অনেক কান্না। কোনোদিন সেসব কথা হালকাভাবে শুরু হয়ে দীর্ঘশ্বাসে শেষ যবনিকা।

রকিব আজ ভোরবেলা ঝুপড়ির দুয়ার টেনে বের হয়। পেছন থেকে মা ডেকে ওঠে। অস্পষ্ট ভাঙা কণ্ঠে জানতে চায়, সে এখনই যাচ্ছে কিনা। রকিব ভরসা পায় না। এত লোকের দুনিয়ায় মা ছাড়া আর কে আছে? সে মোড়ের মাথায় গিয়ে মায়ের জন্য একটি পাউরুটি কেনে। তারপর ফিরে এসে খুব আগ্রহে ডাকে। মা এ ক’দিনে বেশি বুড়িয়ে গেছে। এলোমেলো চুল। দু’হাতের আঙুলে ময়লার দাগ। শুধু দু’চোখে দুষ্টুমির হাসি।

‘বোকা ছেলে একদিন জ্বরে একটু কাবু হয়েছি, অমনি বড়লোকের খাবার কিনে নিয়ে এসেছে। টাকাগুলো খামোখা খরচ করলি?’

‘এ রকম বলবে না তো! আমার তো একটাই মা। মা, এখন কি ভালো লাগছে?’

‘হ্যাঁ বাবা। ভালো না লেগে উপায় আছে। আমার রকিব আছে যে!’

‘তবে আমি স্কুলে যাই।’

রকিব স্কুলে এসেছে। আজ তার বেশ দেরি হয়ে গেল। মিতুল ওকে দেখে কাছে এসে দাঁড়ায়।

‘আজ দেরি করলি যে বড়!’

‘কী করব বল, মায়ের অসুখ। সারা রাত ছটফট করেছে। একটুও ঘুমায়নি। ভোরবেলা পাউরুটি কিনলাম। মা আর আমি খেয়েছি। খুব স্বাদের জানিস?’

‘তুই না ব্যাট কিনবি বলে টাকা জমাচ্ছিলি? সেটা খরচ করলি?’

‘দুদিন দেরি হবে এই তো!’

‘তোর মা খুব ভালো। আমার নতুন মা খুব রাগি। অল্প কিছুতেই মারতে আসে।’

‘আপন মা কখনো মারে না। তোর নতুন মাকে আপন করে নেয়ার চেষ্টা করিস।’

‘আপন করা কী এতই সহজ? আমি তো চুপচাপ থাকি। তার পরও... বাবা যে কেন আবার বিয়ে করল?’

রকিবের মনজুড়ে বাবার কথা আসে। ঠিকমতো মনে পড়ে না। বাবা দেখতে কেমন ছিল? সে আকাশের দিগন্তে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ভাবনার পাখা মেলে দেয়। থই পাওয়া যায় না। ফাল্গুনের সূর্যের আলো আর তাপ অনেক তীব্র। কখনো আবার মেঘে মেঘে আলোছায়া। ভালো লাগে। হঠাৎ বাউরি বাতাসে গাছের পাতা থির থির ঝরে যায়। ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তায় ধুলো ওড়ে। বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে বুকে কান্নার ঢেউ জাগে। আজ বাবা বেঁচে থাকলে কষ্ট হতো না। মায়ের কষ্ট সহ্য হয় না। সেও ঠিকমতো স্কুলে আসত। পড়ালেখায় অনেক এগিয়ে যেত। ভাবতে ভাবতে দু’চোখ উদাস হয়ে পড়ে।

আজ রকিবের দেরি হয়ে গেছে। তাই প্রতিদিন যে জায়গায় বসত, সেখানে সুযোগ পায়নি। সে অন্য এক কোণে গিয়ে বসে। সেখান থেকে পরিচিত জায়গায় দৃষ্টি ছুড়ে দেয়। অন্য একজন বসেছে। আজ তার সত্যি দেরি। এতগুলো বাদাম বিক্রি করতে পারবে তো?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //