শ্বাস প্রশ্বাস

সে পাশ ফিরল ও বিস্মিত হলো : ‘এ কেমন ধরনের মৃত্যু? মানুষ অসুস্থ হয় এবং মৃত্যুর ঠিক আগে তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় বা তারা অসাড় হয়ে পড়ে; কিন্তু কী আশ্চর্য, আমি যে অনায়াসে পাশ ফিরতে পারলাম পুরোপুরি! আমার জিভও অসাড় হয়ে যায়নি। অদ্ভুত ব্যাপার তো!’ পাশ ফেরার সময় সে তার গায়ের জোরের পরিচয় পেয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করল।

পাশের ঘরে শুয়ে আছে তার স্ত্রী,- কিছুক্ষণ আগে খুন হয়েছে সে। ‘কয়েক মুহূর্ত বাদে আমিও আর থাকব না,- থাকবে না আমাদের বংশধারার কোনো পরিচয়। কিছুক্ষণ বাদে আমিও মারা যাব।’ নিজের পোশাকে রক্তের গন্ধ, সেই গন্ধে সে কেমন বিপর্যস্ত বোধ করে। আর গন্ধটাকে সে সাব্যস্ত করে অশুভ লক্ষণ হিসেবে।

মৃত্যুর আগে সে চাইল স্ত্রীর মৃতদেহের দিকে শেষবারের মতো তাকাতে। সে উঠে দাঁড়াল, শোবার ঘরে যাবার পথে দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে সে ভাবতে লাগল, মৃত্যুকে প্রতিরোধের এই দৃঢ় প্রত্যয় সে কোথা থেকে পেয়েছে।

এই তো কিছুক্ষণ আগে সে তার স্ত্রীকে বলেছিল তার গায়ের পোশাকগুলো খুলে ফেলতে। স্ত্রীর সঙ্গে শোবার সময়ে কৌতূহলে বা কামনার তাড়নে সে নিজে প্রায়ই স্ত্রীর পোশাক খুলে ফেলত। আজ কিন্তু সে তাকেই আদেশ করল তার পোশাক খুলতে। সে তার স্বামীর দিকে সহাস্যে তাকায় এবং তারপর একে একে পোশাক-পরিচ্ছদ খুলে ফেলতে থাকে,- শেষে শুধু অন্তর্বাস পরিহিতা এক নগ্নিকার মতো স্বামীর সামনে এসে দাঁড়ায়। লোকটি তার স্ত্রীর দিকে এগোয়, এক ঝটকায় শেষ অন্তর্বাসটাও খুলে ছুড়ে ফেলে দেয়। তারপর সে তার স্ত্রীকে শুয়ে পড়তে আদেশ করে। তখনো স্ত্রীর মুখে মৃদু হাসির ঝিলিক, আবেগে চোখ দুটি তার অর্ধনিমিলিত। লোকটির হাত, হাতের আঙুল তার স্ত্রীর নিরাবরণ দেহে খেলা করে- লোকটি খুলে ফেলে স্ত্রীর প্যান্টিটাও, আর সেই স্পর্শসুখে স্ত্রীর রক্তে পুলকের শিহরণ খেলে যায়।

স্ত্রী শুয়ে আছে,- চোখ বোজা, হাত-পা শিথিল- স্বামী সম্ভোগে প্রতীক্ষারত। লোকটি তখনই হাতটা সোজা করে একটা ধারালো ছুরি স্ত্রীর ধবল পেটের মাংসপিণ্ডের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয়, সিলিঙে ছিটকে গিয়ে লাগে, মেঝেতে পড়ে। সেই রক্ত ঝরনার ফোঁটা ফোঁটা দাগ লোকটির পোশাকে, সারাদেহে।

মৃত স্ত্রীর ঠোঁটের কোণে তখনো হাসি, হাত-পা প্রসারিত- লাস্যে প্রতীক্ষারত যেন। আপাতদৃষ্টে পরিবর্তন একটাই, ছুরির আঘাতজনিত যন্ত্রণায় তার আয়ত চোখ দুটি স্ফীত,- যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। হাস্যময় সে-মুখে যেন বেদনাক্লিষ্ট এক রহস্যময়তা।

 লোকটি স্বগত বলতে থাকে : ‘এই তো সেদিন আমাদের শাদি হলো, আর আজই তুমি নিহত। বিস্ময়কর ঘটনা আরও ঘটবে- কয়েক মুহূর্ত বাদে আমিও আর থাকব না। মনে রেখ, তুমি খুন হওনি, তুমি জীবিত ছিলে না বলেই মারা গেছ।’

এর পর নিজের দণ্ডায়মান দেহের চলৎশক্তি দেখে সে যেন কিছুটা হতাশ হয়। সে ঘরে ঢোকে; দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবিতে একটি শিশু পরীদের সঙ্গে খেলা করছে,- ভারাক্রান্ত মনে সে ছবিটা দেয়াল থেকে খুলে নামিয়ে ফেলে। তারপর সে-ঘর থেকে বেরিয়ে হামাগুড়ির ভঙ্গিতে গিয়ে বিছানায় ওঠে। স্ত্রীর মৃতদেহ লুকোনোর কোনো ভাবনা তার মস্তিষ্কে আসে না; তার মধ্যে বিন্দুমাত্র ভয়ভীতি নেই। শুধু একটাই দুঃখ তাকে কিছুটা পীড়িত করে : তার মৃত্যুর পর তার মা সম্পূর্ণ একা হয়ে যাবেন, তাঁকে দেখার আর কেউ থাকবে না।

তার মা কাঁদতে শুরু করেছেন, তাঁর আর্তবিলাপ শোনা যাচ্ছে : ‘ওরে বাছা, তুই আমার জীবনে কী সব্বোনাশ ঘটালি! তোকে ছাড়া আমি কী করে থাকব? কার কাছে তুই আমাকে রেখে যাচ্ছিস?’

এসব কথা শুনে তার চোখে জল এলো; সে বুঝতে পারে, তার সংকল্পে ফাটল ধরছে। হ্যাঁ, কথাটা সত্য, তার মৃত্যুর পর তাদের পরিবারের নাম-পরিচয় বহনের আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। কয়েক মুহূর্ত বাদে সে মারা যাবে, বয়স হলে মাও আর থাকবেন না,- পরিবারটির অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাবে। মনে মনে সে আশ্বস্ত হতে চায়, নিশ্চয়ই এরকম এক আতঙ্ক তার মাকে আত্মহননে প্ররোচিত করবে না।

 কোনো উত্তরসূরি না রেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার দুঃখ-হতাশা তার মনকে ভারাক্রান্ত করল, হয়তো তার মাকেও। অতঃপর তার স্থিরদৃষ্টি ধীরে ধীরে পরিক্রমণ করে দেয়ালগুলো, হয়তো সেই দৃষ্টি খুঁজে ফিরছিল তেলরঙে আঁকা পূর্ণাবয়ব প্রতিকৃতিগুলো। বস্তুত, ওইসব প্রতিকৃতিই কক্ষটিকে শোভিত করে রেখেছিল বহ্নিশিখার ঔজ্জ্বল্যে। যে কোনো অভ্যাগতের কাছে চিত্রগুলোর পরিচয় দিতে গিয়ে কী আত্মগরিমাই না বোধ করত সে! তার বুক গর্বে ভরে উঠত। এখন তো সেই সব চিত্র মিনি সাইজের ফটো হয়ে অ্যালবামে সাঁটা। শেষ ছবিটাও হয়তো মা সাঁটবেন অ্যালবামে, কদিন বাদেই; কিন্তু মায়ের পর? মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের ছবি অ্যালবামে সাঁটার জন্য আর কেউ থাকবে না এই বংশে।

তার আর একবার দেখতে ইচ্ছে করে অ্যালবামটা, সে অ্যালবামটা খোঁজে; কিন্তু পায় না। নিশ্চয়ই মা সেটা নিয়ে গেছেন তাঁর ঘরে। মা তাঁর ঘরে বসে দেখছেন অ্যালবামের ছবিগুলো, একটার পর একটা; তাঁর চোখ থেকে অঝোরে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু, সেই অশ্রুর ফোঁটা পড়ছে ছবিগুলোর ওপরেও।

-‘আমাকে একবার অ্যালবামটা দেবে মা? শেষবারের মতো ছবিগুলো একবার দেখি, দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে।’

মা যখন অ্যালবামটা নিয়েছেন,তখন তাঁর চোখের জল শুকিয়ে গেছে, তাঁর খরচোখ দুটি আকাশের মতো উজ্জ্বল। তার মায়ের হাতে একগ্লাস শরাব, সামনে শরাবপাত্র। শরাবপাত্রের গায়ে বাষ্পের বুদ্বুদ। দেখে তার মনে হলো, মাকে পাগলামিতে পেয়েছে বোধহয়, চোখেমুখে হিংস্রতা, খর চাহনি। আর শরাবের গ্লাসটার গায়ে তার নিহত স্ত্রীর রক্তের ছিটে,- দেখে সে খুবই বিচলিত হয়, আঁতকে ওঠে। মাকে সে এবার আদেশের ভঙ্গিতে বলে গ্লাস সরিয়ে নিতে।

তার মা বলেন, ‘না। সম্ভবত তোমার স্ত্রী নির্দোষ ছিল। তোমার কি মনে আছে যে আজকের তারিখেই আমি মা হয়েছিলাম, আর আজকেই আমাদের বংশধারা লোপ পেয়ে যাবে তোমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে। বলো, মনে পড়ছে কি?’ উন্মাদিনীর মতো এক ঢোকে গ্লাসের অর্ধেকটা শরাব গিলে ফেললেন তিনি, তারপর বাকিটা এনে ছেলের ঠোঁটের কাছে ধরলেন। শেষ কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি যেন নিজের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সম্বন্ধে নতুন করে সচেতন হয়ে উঠেছেন। আর শেষে, নিজেরই পোশাক-পরিচ্ছদ ফালি ফালি করে ছিঁড়ে ছেলের কাছে নিজেকে আহুতি দিলেন।

মূল কাশ্মিরী থেকে ভাষান্তর করেছেন : শায়েখ মাহমুদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //