নিম্নমানের জ্বালানি তেল বিক্রি করছে বিপিসি

দেশে মানহীন জ্বালানি তেল বাজারজাত করছে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। বাধ্যবাধকতা থাকলেও পেট্রোল, অকটেন এবং ডিজেলের মান সনদ গ্রহণ করছে না সংস্থাটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভেজাল ও নিম্নমানের তেল নিয়ে ভোক্তাদের ভোগান্তি ও অসন্তোষ দীর্ঘদিনের।

উৎপাদন, পরিশোধন থেকে শুরু করে পেট্রোল পাম্পে বিক্রি পর্যন্ত নানা পর্যায়ে ভেজাল মেশানোর ঘটনাও পুরনো। বিপিসি এবং সরকারি বিপণন কোম্পানি, তেল পরিশোধনকারী কোম্পানি এবং পেট্রোল পাম্পের মালিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশ নানা পর্যায়ে তেলে ভেজাল মেশানোর সঙ্গে জড়িত। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ও উত্তরণে  বিভিন্ন সময় মানহীন ও ভেজাল তেল বিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে সরকার।

কিন্তু এ খাতের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রীয় সংস্থাই যদি মান পরীক্ষা না করে তেল বাজারজাত করে, তবে দেশের জ্বালানি তেলের বাজারে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে না।

দেশে ব্যবহৃত প্রধান তিনটি জ্বালানি হলো- অকটেন, পেট্রোল এবং ডিজেল। এর মধ্যে চাহিদার চেয়েও বেশি পেট্রোল দেশেই উৎপাদিত হয়। অকটেন চাহিদার পুরোটুকুও মেটানো হয় দেশীয় উৎস থেকে। কিন্তু দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে প্রাপ্ত গ্যাসের উপজাত (কনডেনসেট) পরিশোধন করে পাওয়া এ দুই জ্বালানির একটিও আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় মানদ-ে উত্তীর্ণ নয়। নিম্নমানের এ দুই জ্বালানির পাশাপাশি আমদানিনির্ভর ডিজেলেও খুচরা পর্যায়ে ভেজাল মেশানো হয়। আর এর খেসারত দিচ্ছে গাড়ি ও সেচ পাম্প ব্যবহারকারীরা। ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের।

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) সূত্র জানায়, মানসম্পন্ন জ্বালানি তেল সরবরাহ করা বাধ্যতামূলক। তাই বাজারজাত করার আগেই পেট্রোল, অকটেন এবং ডিজেলের মান পরীক্ষা করে সনদ নেওয়ার বাধ্যবাধ্যকতা রয়েছে। কিন্তু   বিপিসি কখনোই এ মান পরীক্ষা করায়নি, সনদও নেয়নি। এ প্রসঙ্গে বিএসটিআইর পরিচালক (মান) মো. সাজ্জাদুল বারী বলেন, ‘দেশে ১৮১টি পণ্য বাজারজাতের আগে গুণগতমানের লাইসেন্স নিতে হবে।

এর মধ্যে এই তিন জ্বালানি পণ্যও রয়েছে। কিন্তু বিপিসি এগুলো কখনো পরীক্ষার জন্য দেয়নি। বিএসটিআই নিজ থেকে তাদের কাছে চেয়েও তা পায়নি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মানরক্ষা না করলে এবং মান সনদ না নিলে পণ্য বাজারজাত করতে পারে না।’ 

বিএসটিআইর অপর এক পরিচালক বলেন, ‘মান পরীক্ষা না করে পণ্য বাজারজাত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু এটি সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় বিএসটিআই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না। তবে কয়েকবার চিঠি চালাচালি হয়েছে।’ জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বিপিসি নিজেই বুঝতে পারছে- মানদ- রক্ষিত হচ্ছে না। তাই মান পরীক্ষা করতে স্যাম্পল বিএসটিআইকে দিচ্ছে না।’ 

এ প্রসঙ্গে বিপিসির চেয়ারম্যান মো. সামছুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি আমার কাছে নতুন। আমি এটি আগে খোঁজ নেইনি। শিগগিরই খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’ তেলে ভেজাল মেশানোর পরিস্থিতি এবং প্রতিরোধ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দেশে প্রায় দুই হাজার ১০০টি তেলের পাম্প রয়েছে। গত মাসে ১৩২টি পাম্পে সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে বিপিসির তদন্ত দল। এর মধ্যে ১২৯টি মানসম্মত অকটেন সরবরাহ করছে। বাকি তিনটি করছে না। আর ১৫-২০টি মানসম্মত পেট্রোল বিক্রি করছে না বলে প্রমাণ পেয়েছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’ 

দেশে পেট্রোল বাজারজাতকরণে জ্বালানি তেলটির অন্তর্জাত উপাদান অকটেন নাম্বার অন্তত ৮৭ মাত্রায় রাখা বাধ্যতামূলক নির্ধারণ করেছে বিএসটিআই। কিন্তু এটি ৮০’র বেশি থাকে না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে চট্টগ্রামের একটি পাম্প থেকে পেট্রোল সংগ্রহ করে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে পরীক্ষা করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ওই স্বাধীন পরীক্ষার রিপোর্টে দেখা যায়, সংগ্রহকৃত পেট্রোলে অকটেন নাম্বার ৭৯ দশমিক ২। একইভাবে আদর্শ অকটেন তেলে অকটেন নাম্বার অন্তত ৯৫ থাকতে হবে। কিন্তু ফ্র্যাকশনেশন প্ল্যান্ট বা পাম্প অথবা অন্য কোনো পর্যায়ে ভেজাল মেশানোর কারণে ঠকছেন ক্রেতারা। 

বিপিসির এক কর্মকর্তা জানান, সরকারি খাতের তিনটি ও বেসরকারি খাতের ১৩টি রিফাইনারি (কনডেনসেট ফ্র্যাকশনেশন প্ল্যান্ট) পেট্রোবাংলার কাছ থেকে কনডেনসেট গ্রহণের পর প্রক্রিয়াজাত করে পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল, সলভেন্ট, মোটর স্প্রিট, কেরোসিন সুপিরিয়র অয়েল, মিনারেল তারপেনটাইনসহ বিভিন্ন পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন করে। বেসরকারি পেট্রোল রিফাইনারিগুলোর কয়েকটির বিরুদ্ধে নিম্নমানের পণ্য উৎপাদন, ভেজাল মেশানো এবং অবৈধভাবে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। কয়েকটির কার্যক্রম সরকার স্থগিতও করেছিল। কিন্তু পরে তা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বেসরকারি প্ল্যান্টগুলো শুধু ফ্র্যাকশনেশন (উপজাত থেকে জ্বালানি পণ্য) করছে। কিন্তু নির্দিষ্ট মানদ- রক্ষা করে পরিশোধনের ক্ষমতা এগুলোর নেই। এ জন্য যে আধুনিক প্রযুক্তির মেশিনারিজ ব্যবহার করা দরকার সেগুলো কোনটিতেই নেই। ফলে নিম্নমানের তেল আসছে বাজারে।

ঢাকা, কুমিল্লা ও গাজীপুরের বিভিন্ন পেট্রোল পাম্পে কাজ করছেন এমন কয়েকজন কর্মী জানান, পেট্রোলের নিম্নমানের কারণে গ্রাহকরা অকটেন কেনার ব্যপারে আগ্রহী। কিন্তু অনেক পাম্পেই অকটেনের সঙ্গে পেট্রোল মিশিয়ে কিংবা পরিশোধন না করেই অকটেন বিক্রি করে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন, ‘এই ভেজাল ও নিম্নমানের তেল ব্যবহার করায় গাড়ির ইঞ্জিন দ্রুত নষ্ট হয়। সার্বিকভাবে গাড়ির জীবনসীমা কমে যায়। বেশি তেল খরচ করে অপেক্ষাকৃত কম পথ পাড়ি দেয় ভেজাল তেল ব্যবহার করা গাড়ি। পাশাপাশি এ নিম্নমানের তেল ব্যবহার পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর।’ 

সম্প্রতি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়, দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে উৎপাদিত গ্যাসের উপজাত ও অজ্বালানি সলভেন্ট পেট্রোল ও অকটেন হিসেবে বিক্রি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। কয়েকটি বেসরকারি রিফাইনারির এই অপ্রক্রিয়াজাত ও ক্ষতিকারক জ্বালানি বিভিন্ন ফিলিং স্টেশন এবং দোকানে বিক্রি করছে। কয়েকটি বেসরকারি রিফাইনারির মালিক, ট্যাংকলরি মালিক ও শ্রমিক সমিতি, ফিলিং স্টেশন ও খুচরা ব্যবসায়ীদের একটি জোট জনস্বাস্থ্য এবং যানবাহনের জন্য ক্ষতিকর এ তেল বছরের পর বছর ধরে বিক্রি করে যাচ্ছে।

বেসরকারি রিফাইনারিগুলো পেট্রোবাংলার কাছ থেকে কনডেনসেট নিয়ে তা পরিশোধনের পর বিপিসির কাছে বিক্রি করে। কিন্তু কয়েকটি বেসরকারি রিফাইনারি কনডেনসেট প্রক্রিয়াজাত না করে সরাসরি বিভিন্ন অয়েল ফিলিং স্টেশনে ও চোরাকারবারিদের কাছে বিক্রি করে। জানা যায়, পেট্রোবাংলা রিফাইনারিগুলোতে প্রতি লিটার কনডেনসেট ৪৪ টাকায় বিক্রি করে।

প্রতি লিটার কনডেনসেট প্রক্রিয়া করে প্রাপ্ত পেট্রোলিয়াম পণ্য বিক্রিতে রিফাইনারিগুলোর মুনাফা (প্রফিট মার্জিন) ৭ টাকা। কিন্তু এই কনেডেনসেট চোরাইপথে তেল ভেজালকারীদের কাছে বিক্রি করলে তারা ২৫ টাকা পর্যন্ত লাভ করে। অন্যদিকে ফিলিং স্টেশনগুলো প্রতি লিটার তেল বিক্রি করে ৩ টাকা ৭০ পয়সা পর্যন্ত মুনাফা পায়। কিন্তু কনডেনসেট মিশিয়ে ভেজাল জ্বালানি তেল বিক্রিতে লিটারে ১৯ টাকা পর্যন্ত লাভ হয়। সবচেয়ে বেশি ভেজাল হয় অকটেন ও পেট্রোলে।

বিপিসির এক পরিচালক বলেন, ‘কনডেনসেট প্রক্রিয়াজাত করে প্রাপ্ত এই পেট্রোল ও অকটেন আন্তর্জাতিক মানদন্ডে কিছুটা নিম্নমানের। কিন্তু এর সঙ্গে ভেজাল মেশানোয় পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। আর এ কাজে জড়িত রয়েছে বিপণন কোম্পানিগুলোর একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। বরং অনেকক্ষেত্রে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ওই কর্মকর্তারা ভালো পদায়ন-পদোন্নতি পেয়ে আরও বেশি দুর্নীতি করছেন।’ 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //