বাণিজ্য উত্তেজনা ও মন্দার শঙ্কা

এশিয়াজুড়ে ব্যবসায়িক চুক্তিতে শ্লথগতি

যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পরস্পরের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত। আমদানিকৃত পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের মধ্য দিয়ে এ বাণিজ্যযুদ্ধের সূচনা। এরইমধ্যে চীনের ৩৬০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পণ্যে শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে, পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ওয়াশিংটনের ১১০ কোটি ডলারেরও বেশি মূল্যের পণ্যে শুল্ক বসিয়েছে বেইজিং। বিশ্বের প্রথম ও দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ দুটির এ বাণিজ্যযুদ্ধের আঁচ অনুভব করছে পুরো বিশ্ব। ব্যতিক্রম নয় এশিয়াও। চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের সামনে নতুন সংকট হিসেবে সামনে এসেছে অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কা। এশিয়া অঞ্চলের সামগ্রিক আমদানি-রফতানিসহ এ অঞ্চলের ব্যবসায়িক চুক্তিতেও প্রভাব ফেলছে এই বাণিজ্য উত্তেজনা ও মন্দার শঙ্কা। শিকাগোভিত্তিক আইনিসেবা প্রতিষ্ঠান বেকার ম্যাকেনজির প্রতিবেদনে এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পন্ন ‘গ্লোবাল ট্রানজেকশন ফোরকাস্ট ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে- চলতি বছর এশিয়া অঞ্চলে একীভবন ও অধিগ্রহণ (মার্জারস অ্যান্ড অ্যাকুইজিশনস- এমঅ্যান্ডএ) কার্যক্রম প্রায় ১৮ শতাংশ কমে ৬৩৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। পরবর্তী বছরে যা আরও কমে হবে ৫২৯ বিলিয়ন ডলার। অবশ্য ২০২১ সালে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হওয়ার আভাস রয়েছে।

বেকার ম্যাকেনজির গ্লোবাল ট্রানজেকশনাল গ্রুপের চেয়ারম্যান আই আই ওং মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসিকে বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, মিশ্র অর্থনৈতিক আউটলুক ও বাণিজ্য অস্থিরতা এমঅ্যান্ডএ-এর কার্যক্রমে অব্যাহতভাবে কালো ছায়া ফেলবে।’

প্রসঙ্গ চীন
চলতি বছর এশিয়া অঞ্চলে যে কয়েকটি কারণে ব্যবসায়িক চুক্তি কার্যক্রম শ্লথ হয়ে পড়েছে তারমধ্যে অন্যতম চীন। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে এক বছরেরও বেশি সময় আগে বাণিজ্য নিয়ে দ্বন্দ্বের শুরু হয়। কিন্তু উভয় দেশ পরস্পরের চেয়ে আমদানিকৃত কোটি কোটি ডলারের পণ্যে আরও বেশি শুল্ক আরোপ করায় এই বিবাদমান সম্পর্ক ইদানীং আরও তিক্ত হয়ে উঠেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে পড়ায় পুঁজির বহির্গমনে লাগাম টেনে ধরেছে বেইজিং। আর এ কারণেই চীনা বিনিয়োগকারীরা দেশের বাইরে অর্থলগ্নির ক্ষেত্রে চাপের মধ্যে রয়েছে।

লন্ডনভিত্তিক আর্থিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান দেয়ালজিকের তথ্যানুযায়ী, পরিমাণের দিক থেকে বহির্মুখী এমঅ্যান্ডএ-এর ক্ষেত্রে চীন হচ্ছে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম উৎস। আর্থিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইওয়াই-এর তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে চীনা বিনিয়োগকারীদের মার্কিন কোম্পানি অধিগ্রহণ প্রায় ৯৫ শতাংশ কমে মাত্র তিন বিলিয়ন ডলারে দাড়িয়েছে। অথচ এর মাত্র দুই বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৬ সালে এ ধরনের অধিগ্রহণের আর্থিক পরিমাণ ছিল ৫৫.৩ বিলিয়ন ডলার। গত আগস্টে প্রকাশিত ইওয়াই-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন থেকে আসা বিনিয়োগও অন্য দেশের সরকারের কড়া নজরদারির বৈতরণী অতিক্রম করতে হয়। এই কঠোর নজরদারির পেছনে কিছু কারণও রয়েছে। বাণিজ্যযুদ্ধকে কেন্দ্র করে জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যুটি এর মধ্যে অন্যতম। মূলত কোনো দেশই চায় না বিবাদমান দেশগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ করতে।

এশিয়ায় কিছু সম্ভাবনাময় অঞ্চল 
যেখানে এশিয়ায় সার্বিকভাবে এমঅ্যান্ডএ কার্যক্রম কমে যাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে, সেখানে সম্ভবত জাপানকে ব্যতিক্রম বলা যায়। বেকার ম্যাকেনজির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরও বেশি বিদেশি কোম্পাানি অধিগ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের পরিধি সম্প্রসারণ করতে চাইছে জাপানের কোম্পানিগুলো। জাপানের নীতিনির্ধারকরা বিদেশি কোম্পানি অধিগ্রহণ ও জাপানি পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির নতুন কৌশল আবিষ্কারে স্থানীয় কোম্পাানিগুলোকে উৎসাহী করছেন। এ ধরনের নীতিতে অস্ট্রেলিয়াও বেশ উপকৃত হচ্ছে। গত সপ্তাহেই অস্ট্রেলিয়ার প্যাকেজিং কোম্পানি অরোরার ফাইবার আর্ম ১.৭২ বিলিয়ন ডলারে কিনে নিয়েছে জাপানের নিপ্পন পেপার।

আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান শাউ অ্যান্ড পার্টনারসের জ্যেষ্ঠ বিনিয়োগ উপদেষ্টা অ্যাডাম দেওয়াস বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার সম্পদে জাপানিদের আগ্রহ রয়েছে। চীন, আমেরিকা ও ব্রেক্সিট নিয়ে কি ঘটে চলেছে তা কোনো বিষয় নয়। আমার মতে, ব্যবসা সম্প্রসারিত করতেই হবে।’

বেকার ম্যাকেনজির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামও উপকৃত হতে পারে। কারণ এ দেশগুলোর অন্তবর্তী এমঅ্যান্ডএ কার্যক্রম খুবই শক্তিশালী এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে এসব দেশ এখনো তাদের আকর্ষণ ধরে রেখেছে। 

২০২১ সালের পর বাড়বে এমঅ্যান্ডএ কার্যক্রম
এশিয়ায় ব্যবসায়িক চুক্তি কার্যক্রম কমে যাওয়ার বিভিন্ন কারণের মধ্যে বড় অংশজুড়ে রয়েছে বিশ্বে চলমান পরিস্থিতি। বেকার ম্যাকেনজির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ‘পাহাড়সম অনিশ্চয়তার’ কারণে চলতি বছর বৈশ্বিক এমঅ্যান্ডএ কার্যক্রম কমে ২.৯ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে, যা ২০২০ সালে আরও কমে হবে ২.১ ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু এরপর পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। 

বেকার ম্যাকেনজির গ্লোবাল ট্রানজেকশনাল গ্রুপের চেয়ারম্যান আই আই ওং বলেন, ‘এই সময়ের পর বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আবার স্থিতিশীলতা আসতে থাকবে। আরও অধিগ্রহণ চুক্তির জন্য ব্যবসায়িক পরিবেশ আরও সহায়ক হয়ে উঠবে।’ প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, ২০২১ সালের দিকে ব্যবসায়িক চুক্তি সম্পাদনের চাহিদা আবার বাড়বে, যা এমঅ্যান্ডএ-এর পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির শর্ত তৈরি হবে। বেকার ম্যাকেনজির পৃথক এক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ঘাটতিও এমঅ্যান্ডএ বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। কারণ প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতার কারণে অনেক কোম্পানিই প্রতিযোগিতায় থাকতে পারছে না। এ অবস্থায় ডিজিটাল সক্ষমতা সম্পন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণে আগ্রহ দেখাবে কোম্পানিগুলো। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পেই প্রবৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবে এখনো অধিগ্রহণ কার্যক্রম তার অবস্থান ধরে রেখেছে। প্রযুক্তিগত সক্ষমতা তৈরির তাগিদেও এ ধরনের চুক্তির পরিমাণ বাড়ছে।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //