ফাঁকা পকেটে ভ্রমণ: তৃতীয় পর্ব

দুপুর নাগাদ আমরা সিএসপি ট্রেনিং একাডেমিতে পৌঁছলাম। সেটা তাদের খাওয়ার সময়। আমাদের এসএম হলের তৌফিক এলাহী চৌধুরী ভাইয়ের কথা মনে আছে। তিনি ছিলেন অর্থনীতির ছাত্র। তার কাছেই গেলাম। মনজুর সাহেবের পরিচিত কয়েকজনও আছেন। তারা বর্তমানে একাডেমির প্রশিক্ষণার্থী সিএসপি।

তৌফিক ভাই আমাদের ডাইনিং রুমে নিয়ে গেলেন। ডিম্বাকৃতির বিশাল ডাইনিং টেবিল। আমরা তাদের সঙ্গে খেতে বসলাম। কাঠের চোঙ্গের ভেতর সুতির সাদা তোয়ালে। প্রত্যেকের জন্য একটি। চোঙ্গের ভেতর থেকে টান দিয়ে তোয়ালে বের করে হাত-মুখ মুছতে হয়। খাওয়ার পর তাদের সঙ্গে হল রুমে এলাম।

বিরাট হল রুমটি সম্পূর্ণ লাল রঙের জমিনে সোনালি ফুলের নকশা করা বিশাল কার্পেটে ঢাকা। দেয়াল ঘেঁষে সোফা। আমরা সেখানে কিছুক্ষণ বসে আলাপ করলাম। এর মধ্যে দুয়েকজন উঠে হল রুমের পাশের লাইব্রেরিতে গেলেন। আমাদেরও লাইব্রেরিটি দেখার ইচ্ছে হলো। বেশ বড় লাইব্রেরি। প্রচুর বই। সবটা ঘুরে দেখা হলো না। আমাদের তাড়া আছে। আমরা তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। 

টাঙ্গায় চড়ে আপার মল পেরিয়ে লোয়ার মল হয়ে রেল স্টেশনের কাছ দিয়ে আমরা সম্রাট জাহাঙ্গীরের সমাধিসৌধ দেখতে যাচ্ছি। শাহদারাতে জাহাঙ্গীরের সমাধিসৌধে যখন পৌঁছলাম তখন শেষ বিকেল। এটি জাহাঙ্গীরের প্রিয় স্ত্রী নূর জাহান নির্মাণ করেছেন। আমরা এর ভেতরভাগ দেখলাম। সফেদ মার্বেল পাথরের জাফরি দিয়ে মাজারটি ঘেরা। খয়েরি রঙের পরিমিত আকারের স্মৃতিসৌধটি আমাদের কয়েকশ বছর পেছনে নিয়ে গেল। স্মৃতিসৌধের চারদিক খোলা। শ্যামল দূর্বা ঘাস পা জড়িয়ে ধরে। চারধারে ছায়াসুনিবিড় বৃক্ষরাজি। 

এর একটু উত্তরেই নূর জাহানের কবর। কবরটি মাটির নিচে। সুরঙ্গ পথে সেখানে যেতে হয়। একজন একটি মোমবাতি হাতে করে সুরঙ্গ পথে আমাদের কবরটির কাছে নিয়ে গেল। ভেতরে নিশ্চিদ্র অন্ধকার। মোমের আলোয় যা পারা গেল কবরটি দেখলাম। মাটির কবর। কবরের ওপর একটি দূর্বা ঘাসও নেই। এই রমণী বলেছিলেন- ‘গরিব গোরে দীপ জ্বেলো না, ফুল দিও না কেউ ভুলে/শ্যামা পোকার না পোড়ে পাখা, দাগা না পায় বুলবুলে।’  

আমরা ফুল নেইনি। কোনো বুলবুলকে আহত করিনি। দীপ নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো শ্যামা পোকা দেখিনি। প্রয়াত সম্রাজ্ঞীর হৃদয়ে আমরা আঘাত দেইনি। চিরনিদ্রায় চির শান্তিতে তিনি শায়িত থাকুন। এই কামনা করে সেখান থেকে বিদায় নিলাম।

পরদিন সকালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে গেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়টি শহরতলিতে। মনজুর সাহেবের পরিচিত এক নবীন শিক্ষক আছেন এখানে। দোতলায় তার বিভাগে তার সঙ্গে দেখা হলো। কোন বিষয়ের শিক্ষক তিনি, সে কথা মনে পড়ছে না। অল্পক্ষণ আলাপের পর তিনি আমাদের নিচে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কেন্টিনে নিয়ে এলেন। চা-নাস্তা খাওয়ার ফাঁকে আলাপ হচ্ছে।

এক সময় সুদর্শন এক প্রৌঢ় শিক্ষক এসে আমাদের পাশের একটি চেয়ারে স্বভাবসুলভ নম্রভাবে বসলেন। তার সর্বাবয়বে শিক্ষক সুলভ আভিজাত্যের দীপ প্রজ্বলিত। তিনি কিছু খেলেনও না কারো সঙ্গে কোনো কথাও বললেন না। চা খাওয়া শেষ হলে আমরা বেরিয়ে পড়ি। আমাদের সঙ্গের শিক্ষক বললেন, আমাদের পাশে যিনি এসে বসেছিলেন, তিনি প্রফেসর ড. মাহমুদুল হাসান।

ড. মাহমুদুল হাসান পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যলয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের ভাইস চ্যান্সেলর। ভারতের রাষ্ট্রপতি জাকির হোসেনের ভাই। সম্ভবত আমরা পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছি ভেবেই আমাদের পাশে এসে একটু চুপচাপ বসলেন। মনে পড়ল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার বিদায় সুখকর ছিল না।

আমি তখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হইনি। ঢাকা কলেজে পড়ি। মনে আছে, তার বিদায়কে কেন্দ্র করে অবজারভার পত্রিকা একটি কার্টুন ছেপেছিল। কোনো আলাপ না হলেও একজন শিক্ষককে দেখতে পেরে মনে বড় আনন্দ অনুভব করলাম। 

এখান থেকে বেরিয়ে একটি কৃত্রিম খাল ওপর দিয়ে কালভার্ট পেরিয়ে ব্যাচেলর শিক্ষকদের ডরমেটরিতে এলাম। এখানে আমাদের সঙ্গের শিক্ষক থাকেন। সেখান থেকে বিদায় নিয়ে শহরে চলে এলাম।

শহরে এসে প্রথমেই লাহোর জাদুঘর দেখতে যাই। প্রাচীন যুদ্ধাস্ত্র, সামরিক পোশাকসহ অনেক কিছুই এখানে দেখার আছে। জাদুঘরটিতে দর্শনীয়সামগ্রী বেশ ছিমছাম পরিপাটি করে সাজানো। পরিচ্ছন্ন জাদুঘর। ঢাকার চানখাঁর পুলে তখনকার জাদুঘরে দেখেছি দর্শনীয় জিনিসগুলো গাদাগাদি করে সাজানো। এটা সে রকম নয়। ভালো লাগলো।

জাদুঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে দূর থেকে লাহোর গভর্নমেন্ট কলেজ দেখলাম। সেখানে পরিচিত নেই, আবার হাতেও সময় কম বলে যাওয়া হলো না। কলেজটি বিখ্যাত। পাকিস্তানের উচ্চতর প্রশাসনিক পদের বহু কর্মকর্তা এ কলেজের এক সময়ের স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র। কলেজটি দেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তা হয়ে উঠল না। 

এখান থেকে বেরিয়ে যখন বাদশাহী মসজিদ দেখতে এলাম, তখন ভরদুপুর। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব মসজিদটি নির্মাণ করেছেন। জোহরের সময় প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আমরা মসজিদের পূব দিকের সিঁড়ির অনেক ধাপ পেরিয়ে মূল প্রবেশ পথে উঠলাম। প্রবেশপথে জুতা রেখে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে।

এখানে জুতা রেখে হালকা লাল বেলে-পাথরে নির্মিত বিশাল চত্বর, তারপর মূল মসজিদে এলাম। দু’জনে এখানে দু’রাকাত করে শুকরিয়া নামাজ আদায় করলাম। মসজিদটির অভ্যন্তরভাগের কারুকাজ নিরাভরণ মার্জিত। মোগল স্থাপত্য কলার আরেকটি অভাবনীয় নিদর্শন এই বাদশাহী মসজিদ। মসজিদ থেকে বেরুবার সময় সিঁড়ির ওপর থেকে পূর্ব দিকে খানিক দূরে লাহোর দুর্গের সুউচ্চ বুলন্দ দরজা নজরে পড়ে। দরজাটি এবং এর উভয় পাশের সুউচ্চ দেয়াল ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে।

দেয়ালে এবং দরজায় আগাছা জন্মেছে। এটি সম্রাট আকবরের সময় নির্মিত। এর সযত্নে রক্ষণাবেক্ষণ হয় বলে মনে হলো না। মসজিদ থেকে নেমে হাতের ডানদিকে দার্শনিক মহাকবি ইকবালের মাজার। মসজিদের পূর্ব পাশ ঘেঁষে খোলা জায়গায় সাদা মার্বেল পাথরে নির্মিত ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ মাজারটির ওপর শেষ দুপুরে পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্য মসজিদটির ওপর কোমল ছায়া বিস্তার করেছে। তার মাজারে দু’জনে ফাতেহা পাঠ করলাম।       (চলবে)


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //