ফাঁকা পকেটে ভ্রমণ: পঞ্চম পর্ব

আমাদের ফেরার সময় হলো। আগে থেকেই খোঁজ নেওয়া ছিল রাওয়ালপিন্ডির বাস কখন ছাড়বে। সঠিক সময়ে আমরা এসে বাসে বসলাম। বাসে পাহাড়ে উঠতে নামতে দু’টোতেই ভয়। শুনেছি নামতে বিপদের সম্ভাবনা একটু বেশি। সে যা-ই হোক, এখানে আমরা থাকতে আসিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফএইচ হল মিলনায়তনে এক সন্ধ্যায় পাকিস্তানের খ্যাতনামা আইনবিদ এ কে ব্রোহীর একটি বক্তৃতা শুনেছিলাম।

বাসে চড়ে মারি পাহাড় আরোহন কোনো গৌরবের কাজ নয়, তবে মারি পাহাড়ে আরোহনের স্মৃতিকে হৃদয়ে লালন করতে হলে আমাদেরও সমতলের লোকালয়ে ফিরতে হবে, যেখানে আমাদের কর্মক্ষেত্র ও বসবাস। বাস তার আপন গতিতে ড্রাইভারের হাতের স্টিয়ারিং হুইলের ঘোরপ্যাঁচে পাহাড়ের গায়ের প্যাঁচানো রাস্তা ধরে ঢাল বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। আমাদের চারিধারে ঘন সবুজ বৃক্ষ আচ্ছাদিত ছোট-বড় পাহাড় আর গভীর-অগভীর খাদ। সামনে পাহাড়ের গা ঘেঁষে বিটোমিন আচ্ছাদিত সড়ক। গন্তব্য রাওয়ালপিন্ডি। উপরে সুনীল আকাশ। হৃদয়ে আল্লাহ। 

এ ক’দিনের খাওয়া-দাওয়ার কৃচ্ছতা আর মনজুর সাহেবের বেখাপ্পা আচরণ আমাকে ক্লান্ত অবসন্ন করে তুলেছে। আমি আর তার সঙ্গে কোথাও যেতে চাইনা। আমি পরিশ্রান্ত। রাতে মনজুর সাহেব বললেন- ‘কাল পেশোয়ার যাবো।’ আমি বললাম- ‘আমি অসুস্থ বোধ করছি। আমি আর কোথাও যাবো না। আপনি যান।’ 

আমি তাকে মিথ্যা বলিনি। আসলেও নিজকে অসুস্থ লাগছে। পরের কাঁধে বন্দুক রেখে যুদ্ধ করা সুখকর রসিকতার কাজ হলেও পরের পকেটে পয়সা রেখে ভ্রমণ করা যে মোটেও সুখকর নয় এ আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

মনজুর সাহেব বিপাকে পড়লেন কাকে নিয়ে পেশোয়ার যাওয়া যায়। তিনি বুঝলেন আসলেও আমি ক্লান্ত। তার এক বন্ধু এগিয়ে এলেন। তাকে নিয়েই সকালে তিনি পেশোয়ার রওনা দিলেন। বলে গেলেন কালই বিকাল নাগাদ ফিরবেন। পেশোয়ার যাওয়ার আমার খুবই ইচ্ছা ছিল। বিশেষ করে ওখানের ‘কেচ্ছাখানি’র বাজারটি আমার আকর্ষণ।

ক্লাস এইটে ইব্রাহীম খাঁর ‘পশ্চিম পাকিস্তানের পথে ঘাটে’ বইটি আমাদের রেপিড রিডিং বই হিসেবে পাঠ্য ছিল। সে বইয়ে কেচ্ছাখানি বাজার সম্বন্ধে পড়েছি। বাজারটি সচক্ষে দেখার একটি সুযোগ এসেছে বলে খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু মানুষের সব সাধই কী পূর্ণ হয়? ইসলামাবাদ গভর্নমেন্ট হোস্টেলে তার বন্ধুদের হাওলায় আমি রয়ে গেলাম।

এই হোস্টেলটিতে অনেক বাঙালি অফিসার আছেন। কেউ একা কেউ সপরিবারে। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের ক্যাডার সার্ভিসের অফিসারদের জন্য এ হোস্টেল। হোস্টেলটির পানি সাপ্লাই ব্যবস্থা চমৎকার। টেপে ঠান্ডা ও গরম পানি উভয়েরই ব্যবস্থা আছে। দুটো টেপ এডজাস্ট করে পানির উষ্ণতা প্রয়োজনীয় মাত্রায় এনে শাওয়ারের নিচে গোসল করা যায়।

ইসলামাবাদের চলতি আবহাওয়ায় এটা বেশ কাজে এসেছে। হোস্টেলের পাশেই বিশাল ট্যাঙ্কে বৈদ্যুতিক যন্ত্রের সাহায্যে পানি গরম হচ্ছে। বিশাল ট্যাঙ্কের গা সাদা কাপড় জাতীয় কিছু দিয়ে সম্পূর্ণ মোড়া। সম্ভবত গরম পানি ভর্তি ট্যাঙ্কের উত্তাপ যাতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, তাই এ ব্যবস্থা। এই ট্যাঙ্ক থেকে হোস্টেলে গরম পানির সাপ্লাই আসে। 

হোস্টেলের ক্যান্টিনটিতে রুচিসম্মত খাবার মিলে। সকাল-বিকালের নাস্তা এবং দুপুর ও রাতের খাবার এখানেই খাচ্ছি। খরচ জোগাচ্ছেন ইনফরমেশন সার্ভিসের গোলাম পাঞ্জাটন সাহেব। দেখলাম তিনিও আমার মতো ভোজন রসিক। সকালে পাউরুটির সঙ্গে ডিম মাখন। দুপুরে পরটা গোস্ত। বিকেলে দুধের সঙ্গে কর্নফ্লেক্স। রাতে ভাতের সঙ্গে মাছ-মাংস বা রুটি-গোস্ত, যেটা পছন্দ।

মনজুর সাহেবের অত্যচার থেকে জিহ্বাটা আর পেটটা বাঁচল। কিন্তু অস্বস্তি লাগে এ জন্যে যে, পয়সাটা নিজের পকেট থেকে দিতে পারছি না! পাঞ্জাটন সাহেব আমার পূর্ব পরিচিত নন। নেহায়েত ভদ্রতার খাতিরেই এটা করছেন। পয়সার কথা তুললেই বলেন- ‘যা খরচ হয় করাচি যেয়ে পাঠিয়ে দেবেন। তবেই চলবে।’

একাই ঘুরছি। রাওয়ালপিন্ডি যাই জি টি ট্রান্সপোর্টের মাইক্রোবাসে চড়ে। শহরে ঘুরিফিরি। একদিন কিছুটা দূর থেকে দেখলাম, ঢাকা কলেজের এক কালের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক এম ইউ আহমেদ সাহেব রাওয়ালপিন্ডির দূরের একটি দোকানে প্রবেশ করছেন। আমি তাকে এক বছরের জন্য সে কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবে পেয়েছিলাম। পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট তিনি। হেংলা পাতলা দীর্ঘকায় কালো ভদ্রলোক। স্যুট-টাই পরেন।

আরেকদিন আমেরিকান ইনফরমেশন সার্ভিসের পাশের ফুটপাথে রাস্তার দিকে পেছন দিয়ে জুতা কালি করাচ্ছি। পেছন থেকে কে একজন কাঁধে হাত রাখলো। ফিরে দেখি এক নবীন আর্মি অফিসার। চিনতে দেরি হলো না। ওবায়েদ। কলেজে বিজ্ঞান গবেষণাগারে প্র্যাকটিকালে আমার পার্টনার ছিল। ভালো ফুটবল খেলত। এখনো খেলে। সেই গুণ তাকে সেনাবাহিনীতে প্রবেশের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে। সামনের একটি দাঁত ছাত্রজীবন থেকেই বাঁধানো। ভালো ফুটবল খেলে বলে সেনাবাহিনীর কমিশন্ড অফিসার হতে সেটা কোনো বাধা হয়নি। সে তখন ক্যাপ্টেন র‌্যাঙ্কে। পোস্টিং করাচিতে। রাওয়ালপিন্ডি ফুটবল খেলতে এসেছে। বহুদিন পর দেখা। ফুটপাথে জুতা পলিশ শেষ হতে হতে তার মুখে এত কিছু জানা গেল। তাকে দেখে মনটা চাঙ্গা হয়ে উঠল। বলল- ‘চলো মেসে।’ 

কাছেই সেনাবাহিনীর মেস। অল্প হাঁটলাম দু’জনে। বসার রুমে এলাম। রুমটি তেমন বড় নয়। রুমের দেয়াল ঘেঁষে কালো পুরু সোফা। বসতেই অর্ধেক তলিয়ে গেলাম। সোফার ফোম যেমন নরম, তেমন পুরু। তাদের কাছে কেমন লাগে জানি না, তবে আমার কাছে আরামদায়ক মনে হলো না। কি খাব জিজ্ঞেস করলো। একটু আগেই হোস্টেল থেকে খেয়ে এসেছি। বললাম- ‘কিছুই লাগবে না।’ সে বলল- ‘অন্তত একটা সেভেন আপ খাও।’ তাই খাওয়া গেল। আমার করাচির ঠিকানা দিলাম। বললাম- ‘আসলে খুশি হব।’ 

রাওয়ালপিন্ডি সবুজ। গাছগাছালি প্রচুর। পকিস্তান সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর এখানে। অধিকাংশ এলাকাই রেস্ট্রিকটেড। দেখার মতো তেমন কিছু নেই। ছোট শহর। মনজুর সাহেবকে সঙ্গে করে একদিন পাকিস্তান টেলিভিশন সম্প্রচার কেন্দ্র ঘুরে এসেছি। সম্প্রচার কেন্দ্রটি তেমন আকর্ষণীয় নয়। এটি সাময়িক ব্যবস্থা। পরিপূর্ণ অবয়বে পাকিস্তান টেলিভিশনের সম্প্রচার কেন্দ্র শিগগিরই নির্মাণ করা হবে। (চলবে)

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //