ফাঁকা পকেটে ভ্রমণ: ষষ্ঠ পর্ব

রাওয়ালপিন্ডি থেকে ইসলামাবাদ আসতে দুটো জিনিস দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পথ চলতে সম্মুখের একটি পাহাড়, যা দেখে মনে হয়- এই বুঝি তার পাদদেশে পৌঁছে গেলাম, অথচ ইসলামাবাদ পৌঁছেও তার কোনো হদিস পাওয়া যায় না।

পাহাড়টি বহুদূরে, অথচ দেখে মনে হয়- এইতো হাতের কাছে। হাত বাড়ালেই ধরা যাবে, কিন্তু তা নয়! পাহাড়ের এ পলায়নপর দৃশ্য আমাকে অভিভূত করেছে।

আরেকটি হলো- রাওয়ালপিন্ডি থেকে বেরিয়ে ইসলামাবাদমুখী একটি সড়ক। সাহারা-ই-ইরাক। রাওয়ালপিন্ডি থেকে বেরিয়ে ইসলামাবাদ পৌঁছার শেষ রাস্তা এটি। সড়কটি এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত স্কেল দিয়ে আঁকা যেন একটি সরল রেখা।

এমাথার শুরু থেকে ওমাথার শেষ পর্যন্ত সুপ্রশস্ত সমতল রাস্তাটির দু’পাশে দূর্বা ঢাকা উঁচুনিচু খোলা জায়গা। রাস্তার দু’পাশে সারি সারি নিয়ন বাতি। রাস্তাটির দৈর্ঘ্য সঠিক কত তা জানি না। আমার অনুমান এক কিলোমিটারের কম হবে না। এর বেশি হলেও আশ্চর্য হবো না। এমন দীর্ঘ সরল সমতল সড়ক এর আগে আমি কোথাও দেখিনি। এ পথ চলতে আনন্দ আছে।

পরদিন মনজুর সাহেব পেশোয়ার থেকে এলেন না। আমি একটু চিন্তিত হলাম। পাহাড়ি পেশোয়ারের পথে দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সন্ধ্যায় হোস্টেলের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতেই আমাদের ইনস্টিটিউটের জয়েন্ট ডাইরেক্টর ড. টি এম খানের সঙ্গে দেখা। তিনি নিচে নামছেন।

সালাম জানাতেই আমাকে বললেন- ‘আপ ইধার ঘুম রাহা?’

তিনি ইসলামাবাদ এসেছেন বা আসবেন তা আমি জানতাম না। আমি উপরে উঠে এলাম। রাতে আমরা সবাই একটু চিন্তিতই হলাম। মনজুর সাহেবের সঙ্গে যিনি গেছেন, তার তো ওভার-স্টে করার কথা না! কাল তার অফিস আছে। রাতটা গেল।

সকালে নাস্তা খেয়ে একাই ইসলামাবাদ সেক্রেটারিয়েট দেখতে গেলাম। আটকাবার কেউ নেই। গেট পাসের বালাই নেই। গেটই নেই তার আবার পাস কি। ছাড়া ছাড়া কয়টি বহুতল দালান। সব কয়টিই ধবধবে সাদা। একটিতে প্রবেশ করলাম। দোতলায় উঠে গেলাম। করিডোরে লাল কার্পেট। করিডোরে কাউকে দেখলাম না। দু’পাশের কক্ষগুলো কাঠ-বার্নিশ করা দরজা আঁটা। কোনোটাতেই প্রবেশ করলাম না। পরিচিত কারো কক্ষই তো চিনি না। কাজইবা কি। করিডোর দিয়ে লম্বালম্বি পূর্বে-পশ্চিমে খানিক হেঁটে নেমে চলে এলাম।

শহরে পায়ে হেঁটে খানিক এদিক-ওদিক দেখলাম। শহরটি প্রলিং। শহরের বাড়িগুলো দেখতে হলে কোথাও কোথাও রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকাতে হয়। টিলার ঢালে বাড়িঘর। গাড়িতে চড়ে শহরে চলার সময় রাস্তার দু’পাশে সবখানে বাড়িঘর আছে বলে মনে হয় না। যদিও আছে। অসমতল ভূমির ওপর শহরটি গড়ে উঠছে। দূর থেকে নির্মীয়মান কিং ফয়সল মসজিদটি দেখলাম। দুপুরে খাওয়ার আগেই হোস্টেলে ফিরে আসি।

মনজুর সাহেব সন্ধ্যায় ফিরলেন। উৎকণ্ঠার অবসান হলো। দেরির কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন সব দেখে শেষ করতে সময় লেগে গেল। আমরা যে এ কারণে চিন্তিত হবো, সে ব্যাপারে তিনি সজাগ ছিলেন। কিন্তু পেরে উঠেননি। কি আর করা! মনজুর সাহেবের সঙ্গে যিনি গিয়েছিলেন, তিনি আমাকে বললেন- ‘না যেয়ে ভালোই করেছেন। রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ।’

সে যা-ই হোক, যেতে না পারাটা একটা মিস। আমরা কাল সকালেই করাচির পথে রওনা দেবো। গোলাম পাঞ্জাটন সাহেব এর মধ্যেই আমার পেছনে ৭০/৭৫ টাকা নিজ পকেট থেকে খরচ করে ফেলেছেন। আমাদের ছুটিও প্রায় শেষ। করাচি এসে সে টাকা আর গোলাম পাঞ্জাটন সাহেবকে পাঠানো হয়নি। 

সকালে রাওয়ালপিন্ডি রেল স্টেশন থেকে দু’জনে গাড়িতে উঠলাম। এই গাড়িই আমাদের করাচি নিয়ে নামিয়ে দেবে। দুপুরের দিকে পথে এক স্টেশনে মলিন সাদা সালোয়ার-শার্ট পরা মাথায় পাগড়ি বাঁধা এক মধ্যবয়সী রুগ্ন লোক গাড়িতে উঠলেন। এর সঙ্গে মলিন সাদা বোরকা পরা এক যুবতী। বোরকার বাইরে যুবতীর মুখ একদম গোল। মেয়ের দুগ্ধফেননিভ মুখমন্ডলে গোলাকৃতির স্ফীত দু’গালের সম্মুখভাগ রক্তিমাভ।

হঠাৎ দেখলে মনে হবে আলগা রং মেখেছে। কিন্তু আসলে এ রং অকৃত্রিম। স্বাভাবিক। কম্পার্টমেন্টে সিট না থাকায় আমাদের সামনেই মেয়েটি জড়সড়ো হয়ে মেঝেতে বসেছে। লোকটি দাঁড়ানো।

মনজুর সাহেব মেয়েটিকে দেখে বললেন- ‘এ পেশোয়ারি মেয়ে মনে হয়। অনেক সময় এদের গ্রাম থেকে এনে ব্রোথেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’ মেয়েটি এবং পুরুষটি গ্রামের তা বুঝা যায়, তবে মনজুর সাহেবের পরের কথা আমি কানে তুললাম না। আমি মেয়েটির মুখের দিকে একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। সঙ্গের পুরুষটিকেও দেখলাম। নাহ্। এরা গ্রামের সহজ সরল নিষ্পাপ লোক। আমার তাই মনে হলো। এরা আমাদের সঙ্গে করাচি পর্যন্ত আসেনি। মাঝ পথে নেমে গেছে। 

দিন শেষে রাত শেষে পরের দিন দুপুরের দিকে করাচি পৌঁছলাম। এক টানা ৩৩ ঘণ্টার জার্নি। রাতে ট্রেনে একটা গোল বাঁধলো। আমাদের টিকিটগুলো টিটি সাহেব নিয়ে গেলেন। টিকিটে কি ত্রুটি আছে বলে টিটি সাহেব জানালেন। মনজুর সাহেব তার পিছু নিলেন।

আমি সিটেই বসে রইলাম। মনজুর সাহেব উত্তেজিতভাবে ফিরে এলেন। সঙ্গে টিটি সাহেব। আমরা দু’জনে আমাদের পরিচয় দিলাম। মনজুর সাহেব আরো বলতে ছাড়লেন না যে, তিনি ইপিসিএসে কোয়ালিফাই করেছিলেন, কিন্তু তাতে যোগ না দিয়ে রেডিও পাকিস্তানে যোগদান করেছেন।

টিটি সাহেব চাইছিলেন আমাদের পরের স্টেশনে নামিয়ে দিতে। টিকিটের ফয়সালা না হলে এ টিকিটে করাচি যাওয়া যাবে না। কিন্তু আসলে আমাদের টিকিটে কোনো ত্রুটি ছিল না।

বোঝা গেল টিটি সাহেব আমাদের কাছ থেকে কিছু হাতিয়ে নিতে চান। আমরা তা দিতে নারাজ। পরে টিটি সাহেব হাল ছেড়ে দিয়ে আমাদের টিকিটগুলো ফেরত দিলেন। এর পর আর কোনো ঝামেলা হলো না। আমরা নির্বিঘ্নে করাচি পৌঁছালাম।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //