মাসুম আজিজ একজন শিল্পসাধক

কবি জীবনানন্দ দাশ তার “মানুষের মৃত্যু হ’লে” কবিতাটিতে বলেছেন, ‘সূর্য যদি কেবলি দিনের জন্ম দিয়ে যায়, / রাত্রি যদি শুধু নক্ষত্রের, /মানুষ কেবলি যদি সমাজের জন্ম দেয়, / সমাজ অস্পষ্ট বিপ্লবের, / বিপ্লব নির্মম আবেশের, / তা হ’লে শ্রীজ্ঞান কিছু চেয়েছিলো?’

প্রখ্যাত পণ্ডিত শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর কী চেয়েছিলেন, সেই ব্যাপারে স্বয়ং বাংলা তথা পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবিই স্বয়ং প্রশ্ন রেখেছেন; কিন্তু অভিনয়ে নিজস্বতা দিয়ে নিজের জাত চেনানো অভিনেতা মাসুম আজিজের ব্যাপারে বলতে গেলে বলতে হয়- তার মৃত্যু হলেও তিনি যেন মানবই থেকে গেলেন! কেননা ১৭ অক্টোবর বরেণ্য এই নাট্যজনের অলোকলোকে বাস নেয়ার সংবাদটি জানামাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে কতটা গভীর শোকের ছায়া নেমেছিলো। 

 অভিনেতা মাসুম আজিজ।

অভিনয়শিল্পী তো বটে, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে দেশের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অঙ্গনসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষের ঢল তো নেমেছিলই। মাসুম আজিজের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন, ‘অভিনয়ের মাধ্যমেই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এই গুণী শিল্পী।’ 

নাটক- থিয়েটার তথা অভিনয়ের প্রতি ছিল তার সীমাহীন ভালোবাসা। আর এই দুর্নিবার আকর্ষণের কারণে ১৯৭৬ সালে একটা পায়জামা, একটা শার্ট আর একটা অক্ষয় চটি পায়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অত্যন্ত ভালো ফল নিয়ে ঢাকায় এসে থিয়েটার করার জেদ থেকে পথ খুঁজেছিলেন। শুধু মঞ্চ চষে বেড়িয়েছিলেন তা- ই নয়, ভালো ফল থাকার পরও চাকরির পেছনে তো ছোটেননি, দিন-মাস-বছর কাটিয়েছেন আধপেটে, অনাহারে আর অভাব-অনটনে। 

নাটকের দল ‘পদাতিক’-এ ১৯৭৯ সালে যোগ দিয়ে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দলটির সদস্য থাকা মানুষটি যদিও পিছিয়ে ছিলেন জীবিকার দৌড়ে আর চরম অভাবে তাকে দিন পার করতে হয়; কিন্তু তিনি কখনো দল ছাড়েননি। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং অভিনয়ে অসামান্য অবদান রাখার কারণে এ বছরই রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন তিনি। সংবাদটি যখন তাকে জানানো হয়েছিল, আবেগে আপ্লুত তিনি চোখের জল ধরে না রাখতে পেরে বলেছিলেন, ‘এত কষ্ট করেছি, হয়ত তার একটা স্বীকৃতি। সেজন্য বলি, জয় হোক মঞ্চের, এটি বাংলাদেশের সকল মঞ্চের, নাট্যদলের পুরস্কার।’

জনপ্রিয় নাট্যকার মাসুম আজিজ।

আধপেট খেয়ে রামপুরা থেকে টিএসসিতে এসে রিহার্সাল করা, টিএসসি থেকে আবার হেঁটে পাঁচ টাকা হাতে নিয়ে রামপুরা যাওয়া আর সেই টাকায় আধাকেজি চাল-আলু কিনে ঘরে ফেরা মানুষটি স্ত্রী- সন্তান নিয়ে কষ্ট করে ঢাকা শহরে বসবাস করেছিলেন। শুধু ভালো অভিনেতাই ছিলেন না, তার সহকর্মীরা তাকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে জানতেন। একটি চরিত্রের জন্য দিনের পর দিন উস্কোখুস্কো চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষটির শিল্পের প্রতি ছিল প্রবল সততা।

তিনি ঘুমাতে যেতেন থিয়েটার, নাটক, চলচ্চিত্র মাথায় নিয়ে। তার দক্ষতার সবটুকু উজাড় করে দিয়ে নাটক, চলচ্চিত্রে চরিত্রকে প্রাণ দিতেন। এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠা সাকিন সারিসুরি নাটকের অনবদ্য অভিনয়ের মতোই বাস্তবেও তিনি যে কোনো বিষয়ে কোনো ভয়- সংকোচ ছাড়াই মনের কথা বলার সৎসাহস রাখতেন। ফলে সবচেয়ে বড় পুরস্কার মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি অগাধ। কজনার সৌভাগ্য হয় কোটি কোটি মানুষের মনের মণিকোঠায় ঠাঁই পাওয়ার। 

অভিনেতা মাসুম আজিজ।

তার মৃত্যুতে ফিরে ফিরে আসছে রেখে যাওয়া কর্মজীবনের নানা অধ্যায়। মাসুম আজিজ শুধু অভিনেতা নন, নাট্যকার ও নির্মাতাও ছিলেন। নাটকের পাশাপাশি তিনি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। ‘ঘানি’, ‘গহীনে শব্দ’, ‘গেরিলা’, ‘এইতো প্রেম’, ‘গাড়িওয়ালা’ ইত্যাদি সিনেমা রয়েছে তার ঝুলিতে। এর মধ্যে ‘ঘানি’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব চরিত্রের অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //