শিল্পী দম্পতি

বিশ্বাসে বাঁধা ৩৩ বছর

গল্পের শুরুটা রাজশাহীতে। প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের জন্মের সময়কালে নগরীর পাশাপাশি দুটি এলাকা সাগরপাড়া ও ঘোড়াপাড়ায় বেড়ে উঠছে দুই কিশোর-কিশোরী। একজন খুবই শান্তশিষ্ট লক্ষ্মী মেয়ে। অন্যজন দুরন্ত কিশোর, দলবল নিয়ে চষে বেড়ায় পাড়াময়। মেয়েটি বাবার হাত ধরে পদ্মা রঙ্গমঞ্চে যায় থিয়েটার করতে। আর ছেলেটি ফ্রিতে সেই নাটক দেখার সুযোগ না পেয়ে দুষ্টু বালকের দল নিয়ে মঞ্চে ঢিল ছুড়ছে। ওই সময় সবুজ পত্র-পল্লবে ঘেরা নগরীতে বাস করছেন একজন পরশ পাথর। যার ছোঁয়ায় সেই কিশোর-কিশোরই স্বাধীন বাংলাদেশে হয়ে উঠবেন একেকটা হিরের টুকরা। যারা আলো ছড়াবেন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সুদূর বিদেশ-বিভূঁইয়ে। তারা হাল ধরবেন বাংলাদেশের নাট্যমঞ্চ সাজানোর কাজে। আর গল্পের পুরোটা সময়জুড়ে ‘বিশ্বাস’ নামক একমন্ত্রে বাঁধা থাকবে সেই কিশোর-কিশোরী। তারা বাঁচবেন একসঙ্গে। কাজ করবেন একসঙ্গে। তারা একই মন্ত্র বুকে ধারণ করে সৃষ্টি করবেন অনন্য এক নজির। 

যা খুব করে খুঁজে ফিরছে এই সময়- গল্পটা যেহেতু কল্পলোকের নয়। তাই তার আছে দুটি জীবন্ত চরিত্র। তারা হলেন দেশের নাট্যাকাশের উজ্জ্বল দুই নক্ষত্র রহমত আলী ও ওয়াহিদা মল্লিক জলি। দু’জনই মনে করেন শিল্পচর্চা গড়তে পারে একজন মানুষ। তারা বিশ্বাস করেন দীর্ঘসময় একত্রে পাড়ি দেওয়ার মূলমন্ত্র বিশ্বাস। সম্প্রতি এই দুজন মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন দেশকাল পত্রিকার পক্ষ থেকে আনিস মণ্ডল। শুনতে চেয়েছেন তাদের জীবনের গল্প। একই ছাদের নিচে দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়ার মূলমন্ত্র। আর সেইসব কথাই উপস্থাপন করা হলো। 

রহমত আলী
রহমত আলী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ভারতের কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯৯১ সালে। নাট্যকলা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। পরে ২০০০ সালে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগে। বর্তমানে তিনি ওই বিভাগের অধ্যাপক।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার সময় বিখ্যাত সব পরিচালক-নির্দেশকের অধীনে অভিনয় করেছেন রহমত আলী। ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সময়ে কলকাতার ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপে’ নিয়মিত কাজ করেছেন। কুমার রায়, জোগেশ দত্ত, উৎপল দত্ত, বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখার্জির মতো নাট্যব্যক্তিত্বের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা ঋদ্ধ করেছে তাকে। কলকাতা দাপিয়ে বেড়নো নাটক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুক্তধারা, রক্তকরবী ও রাশের রাশিতে অভিনয় করেছেন মুখ্য চরিত্রে। মূকাভিনয়েও তিনি সমান পারদর্শী।

রবীন্দ্রভারতী থেকে দেশে ফিরে নাট্যদল ‘তোপখানা’য় যোগ দেন রহমত আলী। সেটি ১৯৯০ সালের কথা। পরের বছর ওয়াহিদা মল্লিক জলিকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন নিজেদের নাট্যদল ‘দৃশ্যকাব্য’। কিংবদন্তি বাদল সরকারের ‘সারারাত্তির’ ছিল তাদের দলের প্রথম প্রযোজনা। তার নির্দেশনায় মঞ্চায়ন হয়েছে অসংখ্য নাটক। মঞ্চ, রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমায় অভিনয় করেছেন অসংখ্য নাটকে।

ওয়াহিদা মল্লিক জলি 
ওয়াহিদা মল্লিক জলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজের অধ্যাপক এবং গুণী ও মেধাবী একজন অভিনেত্রী। অভিনয় করেছেন মঞ্চ, টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রে। প্রধানত মঞ্চ নাটক ও ছোটপর্দায় অভিনয় করেন জলি। শিল্পচর্চা ছিল তার পরিবারের দৈনন্দিন ব্যাপার। একদম শিশু বয়স থেকেই রেডিও ও মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে পথ চলা শুরু। পরবর্তীকালে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী থেকে মাস্টার্স করেন নাটকের ওপর। টানা চার বছর কলকাতার ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’-এ বিভিন্ন নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন। একসময় নিজের তৈরি রেপার্টরি থিয়েটার ‘দৃশ্যকাব্য’য় কাজ করতেন। শুধু অভিনয়ই নয়- মঞ্চ, চলচ্চিত্র ও টিভি নাটকে তিনি কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবেও কাজ করেছেন। ভূষিত হয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে। মঞ্চের বাইরে টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করছেন ১৯৮৬ সাল থেকে। ১৯৮৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে ১৯৯০ সালে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগে।

সেই পরশপাথর 
তফাজ্জল হোসেন- বড় বড় দুটি নামের পাশে তৃতীয় নামটি বড্ড অচেনা মনে হতেই পারে। তবে তিনিই এই গল্পের সেই পরশপাথর। আগেই বলেছি, যে পরশপাথরের ছোঁয়ায় হিরের টুকরো হয়ে ওঠেন রহমত আলী ও ওয়াহিদা মল্লিক জলি। তিনি অভিনেত্রী শর্মিলী আহম্মেদ ও ওয়াহিদা মল্লিক জলির পিতা। এ ছাড়াও আরও তিন কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। শিল্পচর্চা ছিল যার কাছে ধ্যানজ্ঞান, ঘরই ছিল যার থিয়েটার মঞ্চ। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তার নাটকের দল সাংস্কৃতিক সংঘ। রাজশাহী পদ্মার পাড় রঙ্গমঞ্চে নিজ সন্তানদেরও নিয়ে যেতেন নাটক করতে। সেখানেই তিনি আবিষ্কার করেন রহমত আলীকে। পরে সন্তানতুল্য রহমত আলীরও ভাগ্যে জোটে সেই পরশপাথরের ছোঁয়া। ১৯৯১ সালের ২৮ ডিসেম্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন এই শিল্পমনা, শিল্পে বাঁচা মানুষটি।

স্বাভাবিকভাবেই জন্মসূত্রে পরশপাথরের ছোঁয়া পেয়ে যান জলি। তার ভাষায়, ‘আমার নাটকের শুরুটা তো মায়ের পেট থেকেই। আমাদের ড্রয়িং রুমেই নাট্যচর্চা চলত। আমি যখন মায়ের পেটে তখন বাবা ড্রয়িং রুমেই রিহার্সেল করতেন।’ সেই পরিবারের মেয়ে জলি শিল্পমনা হবেন, সেটা অনুমেয়ই। 

কিন্তু একপ্রকার সৌভাগ্যবশত সেই মানুষটার ছোঁয়া পান রহমত আলী। তারও আছে দারুণ একটি গল্প। জলি বলেন, তারা যখন পদ্মার পাড় রঙ্গমঞ্চে নাটক করতে যেতেন, পাশেই বসে থাকত একদল কিশোর। যারা ফ্রিতে নাটক দেখতে চাইত। সুযোগ না পেয়ে মঞ্চে ঢিল ছুড়ত। সেই দলের সর্দার রহমত আলী। রহমত আলীর মামাও ছিলেন নাটকের মানুষ। একদিন তফাজ্জল হোসেন সেই কিশোর দলের কাছে গিয়ে রহমত আলীকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি ঢিল ছোঁড় কেন? তুমি কি নাটক দেখতে চাও? হ্যাঁ-সূচক সমর্থন পেয়ে তফাজ্জল হোসেন দলে টেনে নেন রহমত আলীকে। এরপর রহমত আলীর জীবনও বাঁধা পরে শিল্পের জাদুতে। 

রাজশাহীর সেই কিশোর একদিন লেখাপড়া করতে পাড়ি জমান কলকাতার রবীন্দ্রভারতীতে। পরে সেই প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার জন্য যান গুরুর মেয়ে জলি। বিদেশ-বিভূঁইয়ে রহমত আলী পেয়ে যান জলির অভিভাবকের দায়িত্ব। একসঙ্গে কাজ শুরু করেন প্রখ্যাত নাট্যদল থিয়েটার ‘ওয়ার্কশপ’-এ। সাংস্কৃতিক সংঘে একসঙ্গে নাটক করা। রহমত আলীর বোন ছিলেন জলির বান্ধবী। সেই সূত্রেও পারিবারিকভাবে চেনাজানা তাদের ভালোই ছিল। গুরু ও শ্বশুর তফাজ্জল হোসেন সম্পর্কে রহমত আলীর মূল্যায়ন, উনি অদ্ভুত একটা ভালো মানুষ ছিলেন। খুবই সুখী মানুষ ছিলেন। জীবনকে খুব সহজ করে দেখতেন। সবকিছু ভুলে যেতেন, আবার সবকিছু মনেও রাখতেন। 

বাবা তফাজ্জল হোসেন মন্ত্র বুনে দিয়েছিলেন জলির ছোট্ট মনে। জলির ভাষ্যমতে সেই মন্ত্র ছিল, ‘মানুষ হতে হবে। প্রত্যেককে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আর শিল্পচর্চাটা করবে, জীবনটাকে জীবনের বোধটাকে সুন্দর করার জন্য।’ সেই মন্ত্রকেই বুকে ধারণ করে আজও পথ চলেন রহমত আলী ও জলিসহ তফাজ্জল হোসেনের সব সন্তান।

বিশ্বাসে বাঁধা 
দীর্ঘপথ একসঙ্গে পাড়ি দেওয়ার একপর্যায়ে জলিকে প্রেমের প্রস্তাব দেন রহমত আলী। ‘একসঙ্গে থাকতেন, একসঙ্গেই কাজ করতে চান।’ জলির হ্যাঁ’র পর পরস্পর বাঁধা পড়েন বিশ্বাসে। একে অপরের প্রতি এক অলিখিত দলিলে। অনেক সাক্ষাৎকারেই জলি এই ঘটনাকে মজার ছলে রক্ষকের ভক্ষক হয়ে ওঠা হিসেবে অভিহিত করেছেন। যে রহমত আলী ছিলেন তার অভিভাবক, এমনকি খরচের টাকাও পরিবার থেকে যেত যার হাতে; সেই রহমত আলীই হয়ে গেলেন তার আজীবনের পথচলার সঙ্গী। বেঁচে থাকার অন্যতম অনুষঙ্গ।

১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন রহমত আলী ও জলি। বলা হয়ে থাকে, তারকাদের সংসার মানে দুই দিনের খেলাঘর। গড়তেও সময় লাগে না, ভাঙতেও সময় লাগে না। সেই জায়গাতেই অনন্য নজির এই দম্পতি। ৩৩ বছর ধরে নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপন করে চলেছেন তারা। এই বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম রহমত আলীর কাছে। কী সেই মূলমন্ত্র? যার বলে একসঙ্গে পাড়ি দেওয়া যায় দীর্ঘপথ? রহমত আলী বলেন, এর একটাই কারণ, একের অপরের প্রতি বিশ্বাস। আর কোনো কারণ নেই। ও আমাকে বিশ্বাস করে, আমি ওকে বিশ্বাস করি। এটাই হচ্ছে মূলমন্ত্র।

জানতে চেয়েছিলাম সম্পর্কে কি কখনো হারজিতের প্রশ্ন থাকে? এই যে এই সময়ে একটা বিয়ের সম্পর্কের পর অনেকেই হিসাব কষে দেখার চেষ্টা করেন, কে হারল, কে জিতল- এ প্রসঙ্গে রহমত আলী বলেন, ভালোবাসায় কখনো লাভ-ক্ষতি দেখা হয় না। ভালোবাসার পেছনে লাভ-ক্ষতির প্রশ্ন আসতেই পারে না। ভালোবাসতে গিয়ে যারা লাভ-ক্ষতির হিসাব করে, সেটা বোধ হয় ভালোবাসা না, স্বার্থপরতা। ভালোবাসার আরেক নাম বিশ্বাস।

দুজন মানুষ একই পথের যাত্রী। এটা সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাড়তি কোনো প্রভাব রাখে কিনা- রহমত আলী বলেন, যেহেতু আমরা দুজনে একই বৃত্তে কাজ করি। বিশেষ করে নাট্যজগতে। ও (জলি) অভিনয় করে, আমিও অভিনয় করি। সে হিসেবে একটা সমঝোতা তো আছেই। আর অভিনয় যারা করেন, আমার জানা মতে তারা প্রত্যেকেই সৎ হোন। কারণ অভিনয় করতে গেলে যে নিষ্ঠা, যে কর্মঠ হওয়া দরকার; তার মধ্য দিয়ে তাদের ফুরসত হয় না, খারাপ কিছু হওয়ার বা খারাপ কিছু চিন্তা করার।

একই  প্রশ্নে জলির কথাতেও উঠে আসে বিশ্বাসের বিষয়টা। তিনি বলেন, ভালোবাসা স্বার্থহীন। এতে স্বার্থ থাকে না। এটা একটা অনুভূতি। এটা একটা বায়বীয় ব্যাপার। দুটি মানুষ স্বামী-স্ত্রী হোক কিংবা ভাইবোন; একসঙ্গে থাকা মানেই কখনো সুন্দর মুহূর্ত কাটবে, কখনো খারাপ সময় যাবে। কিন্তু ছেড়ে যায় না কখনো। যখন বায়বীয় বিষয়টা থাকে, একটা টান থাকে, একটা ভালোবাসা থাকে। যেটা একেবারেই স্বার্থহীন।

লোকে বলে তারকাদের সংসার টেকে না- এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে দ্বিমত পোষণ করেন দুজনই। তাদের অভিমত ছিল, বছরে কয়টা তারকার বিয়ে ভাঙছে? তার চেয়ে বেশি সংসার ভাঙছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। কিন্তু তারকাদের জীবন ওপেন। আলোচনায় থাকে, তাই এটা বেশি চোখে পড়ে।

এই দম্পতির দুই সন্তান রয়েছেন। একজন জার্মানিতে, অন্যজন কানাডাতে থাকেন। দেশকাল পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় এই দম্পতি চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে ভারতের দিল্লিতে অবস্থান করছিলেন। তারা দেশে ফিরবেন। তাদের পদচারণায় মুখর থাকবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। তারা আবার ব্যস্ত হয়ে উঠবেন শিল্পচর্চায়। তাদের আলোয় আরও আলোকিত হবে বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির জগৎ। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //