‘একটু শ্বাস নিতে চাই’ : নয়াদিল্লিতে দূষণবিরোধী গণবিক্ষোভ
স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৬:২২
নয়াদিল্লির এই বিক্ষোভ দমনে অযাচিতভাবে হামলা চালায় পুলিশ ছবি : এএফপি
দমবন্ধ করা ধোঁয়ার এক পুরু চাদরে ঢেকে গেছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত এই বাতাসে এখন দিল্লির প্রায় তিন কোটি বাসিন্দার জীবন বিপন্ন। দূষণের মাত্রা আকাশ ছুঁয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এক চরম জরুরি অবস্থা সৃষ্টি করেছে। আর এই পরিস্থিতিতে সরকারি হস্তক্ষেপের দাবিতে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছে নগরবাসী।
১০ নভেম্বর সকাল নাগাদ নয়াদিল্লির এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) পৌঁছেছিল ৩৪৪০-এ, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, নিঃশ্বাসের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং মারাত্মক হিসেবে চিহ্নিত। এই দূষণ মাত্রা ডব্লিউএইচওর প্রস্তাবিত সহনশীলতার চেয়ে বহুগুণ বেশি। ৯ নভেম্বর গভীর উদ্বেগের সঙ্গে ইন্ডিয়া গেটের কাছে কয়েকশ বিক্ষোভকারী সমবেত হয়। বিপজ্জনক ধোঁয়াশায় ঢাকা শহরের এই বিষাক্ত বায়ু সংকট মোকাবিলায় তারা দ্রুত সরকারি পদক্ষেপের দাবি জানান। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শিশুরা তাদের
মা-বাবার সঙ্গে মাস্ক পরে এসেছিল। তাদের হাতে থাকা একটি প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিলÑ‘আমি শ্বাস নিতে ভুলে গেছি।’ আরেকটি প্ল্যাকার্ডে আকুতি লেখা ছিল, ‘আমি শুধু শ্বাস নিতে চাই।’
বিক্ষোভস্থলে পিএম ২.৫ কণার মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রস্তাবিত দৈনিক সর্বোচ্চ মাত্রার ১৩ গুণেরও বেশি ছিল। পিএম ২.৫ হলো সেই ক্যান্সার সৃষ্টিকারী কণা, যা ফুসফুস ভেদ করে রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করতে পারে। দিল্লির বাতাসে এসব কণার ঘনত্ব প্রায়ই জাতিসংঘের প্রস্তাবিত দৈনিক স্বাস্থ্য নির্দেশিকার চেয়ে ৬০ গুণ বেশি মাত্রায় বৃদ্ধি পায়।
শীতকালে কেন এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি
নয়াদিল্লি বরাবরই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত রাজধানী শহরগুলোর মধ্যে স্থান পায়। প্রতি বছর শীতকালে এই পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় কৃষি বর্জ্য পোড়ানো, শিল্প-কারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া থেকে সৃষ্ট দূষণ সৃষ্টিকারী কণাগুলো মাটির কাছাকাছি স্তরে আটকে যায়। পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে কৃষকদের ফসল কাটার পর অবশিষ্টাংশ পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া রাজধানীর ওপর এসে এক বিষাক্ত ধোঁয়াশার (স্মগ) চাদর তৈরি করে।
আইনজীবী তন্বী কুসুম, যিনি ‘হতাশ’ হয়ে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বছর বছর একই কাহিনি; কিন্তু কোনো সমাধান নেই। সরকারকে অন্তত এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে চাপ সৃষ্টি করতে হবে।’ বিক্ষোভকারীদের একজন নমনতা যাদব তার ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। বলেন, ‘আজ আমি শুধু একজন মা হিসেবে এখানে এসেছি। আমি এখানে এসেছি, কারণ আমি জলবায়ু শরণার্থী হতে চাই না।’
অপর্যাপ্ত সরকারি পদক্ষেপ
এই সংকট মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো এখনো পর্যন্ত অপর্যাপ্ত প্রমাণিত হয়েছে। নির্মাণকাজ সীমিত করা, ডিজেল জেনারেটর নিষিদ্ধ করা এবং জীবাশ্ম জ্বালানিচালিত যানবাহনের ওপর সীমিত নিষেধাজ্ঞাসহ যে স্তরভিত্তিক জরুরি ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। এমনকি ফসল পোড়ানো নিয়ন্ত্রণে ভর্তুকি এবং কৃত্রিম বৃষ্টির মাধ্যমে দূষণ কমানোর প্রচেষ্টাও সফল হয়নি। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া এক তরুণী বলেন, ‘দূষণ আমাদের আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে।’
‘দ্য ল্যানসেট প্ল্যানেটারি হেলথ’ জার্নালের গবেষণা অনুসারে, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ভারতে বায়ুদূষণের কারণে আনুমানিক ৩৮ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ সতর্ক করেছে, দূষিত বাতাস শিশুদের তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
বিক্ষোভ দমনে পুলিশি পদক্ষেপ
শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে যখন মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে তখন পুলিশ এসে হস্তক্ষেপ করে। বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে বাসে তুলে নেয় এবং তাদের প্রতিবাদের সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করে। তারা দাবি করে, বিক্ষোভকারীদের কাছে সঠিক অনুমতি ছিল না। বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী এক্সে এক পোস্টে লেখেন, ‘পরিষ্কার বাতাসের অধিকার একটি মৌলিক মানবিক অধিকার।’
দূষণ আরো বাড়তে পারে
সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড (সিপিসিবি) কর্তৃপক্ষকে ‘জরুরি’ বিভাগের অধীনে ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দিয়েছে। তারা আরো জানায়, ‘রাতে শান্ত পরিস্থিতির সঙ্গে দুর্বল বাতাসের কারণে’ এই দূষিত বাতাস অন্তত ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত চলতে পারে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এই মৌসুমে কৃষি জমিতে আগুন লাগার সংখ্যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান আইজিউএয়ারের মতে, নয়াদিল্লি হলো বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত রাজধানী শহর এবং ২০২০ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বের ৩০টি সবচেয়ে দূষিত শহরের মধ্যে ২২টিই ভারতে অবস্থিত। এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে নয়াদিল্লির বাসিন্দাদের দাবি একটাই-একটু পরিষ্কার বাতাস, একটু প্রাণভরে নিঃশ্বাস!
