যেভাবে ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেলো

মিনিয়াপোলিস শহরে গত ২৬ মে পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনায় পুরো আমেরিকায় বর্ণবাদ বিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার পর পৃথিবীর নানা প্রান্তে অভূতপূর্ব সব ঘটনা ঘটে চলেছে। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর বেশ কিছু দিন ধরেই বিক্ষোভ চলছে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে, বিভিন্ন জায়গায় আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সাথে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।

ওই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র বাদেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ হয়েছে- যেখানে সমাজ ব্যবস্থা থেকে বর্ণবাদসহ সব ধরণের বৈষম্যের অবসানের দাবি তুলেছে মানুষ। আর গত কয়েকদিন ধরে এই বিক্ষোভে নতুন এক অনুষঙ্গ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, আর তা হলো বিক্ষোভকারীরা অনেক জায়গায় অনেক ঐতিহাসিক নেতা বা বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের ভাস্কর্য ভাঙচুর করছে কিংবা উপড়ে ফেলছে।

ব্রিটেনের ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার বিক্ষোভকারীরা ব্রিস্টল শহরে এডওয়ার্ড কলস্টোনের একটি মূর্তি ভেঙে ফেলে। আর খোদ আমেরিকায় ভাঙ্গা হয়েছে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের ভাস্কর্য। দাবি তোলা হয়েছে যে কনফেডারেট জেনারেলদের নামে যেসব সেনানিবাস রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, সেগুলোর নাম পরিবর্তন করতে হবে।

চলমান বিক্ষোভ দুনিয়াকে কতটা পাল্টাবে তা হয়তো আরো পরে বোঝা যাবে, তবে যে ঘটনার কারণে এই বিক্ষোভের শুরু, সেটির সঙ্গে জড়িত ছিলো মাত্র ২০ ডলারের একটি নোট। জর্জ ফ্লয়েডের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল যে তিনি ২০ ডলারের একটি জাল নোট দিয়ে একটি দোকান থেকে সিগারেট কেনার চেষ্টা করছিলেন।

কর্তৃপক্ষ দোকানদার ও জর্জ ফ্লয়েডের কথোপকথনের একটি অনুলিপি প্রকাশ করে, যেখানে দাবি করা হয় জর্জ ফ্লয়েড যে নোটটি দিয়েছিলেন, দোকানের কর্মচারি সেটিকে জাল হিসেবে সন্দেহ করার পর ফ্লয়েডের কাছে বিক্রি করা সিগারেট ফেরত চান।

পুলিশের কাছে দোকানদারের করা ফোনের ভিত্তিতে তৈরি করা সেই অনুলিপিটিতে বলা হয় যে দোকানদার সন্দেহ করেছিল যে ওই ব্যক্তি মাতাল এবং নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় রয়েছে। তবে সংবাদ সংস্থা এনবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দোকানটির মালিক মাইক আবুমায়ালেহ জানান, জর্জ ফ্লয়েড তার দোকানের নিয়মিত খদ্দের ছিলেন এবং কখনোই কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেননি।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেয়া আরেক সাক্ষাৎকারে মাইক আবুমায়ালেহ বলেন, যে ঘটনার দিন তিনি দোকানে থাকলে পুলিশকে ফোন করার প্রয়োজনই হতো না এবং জর্জ ফ্লয়েডও হয়তো বেঁচে থাকতেন।


ঘটনার কিছুক্ষণ পর ওই দোকানে যাওয়া এক প্রত্যক্ষদর্শী নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকাকে বলেন, দোকানের এক কিশোর কর্মচারি সেদিন পুলিশকে ফোন করেছিল, কারণ জাল নোট সন্দেহ হলে পুলিশকে ফোন করাই নিয়ম। ওই প্রত্যক্ষদর্শী আরো বলেন, পরে ফ্লয়েডের পরিণতি দেখে ওই কর্মচারি আত্মগ্লানিতে ভুগছিলেন।

ব্রিস্টল শহরের এডওয়ার্ড কলস্টন ছিলেন সপ্তদশ শতাব্দীর একজন দাস ব্যবসায়ী। ১৬৭২ থেকে ১৬৮৯ পর্যন্ত এডওয়ার্ড কলস্টনের জাহাজে করে প্রায় ৮০ হাজার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে আমেরিকায় ক্রীতদাস হিসেবে পাঠানো হয় বলে ধারণা করা হয়ে থাকে।

ব্রিস্টল শহরের বিকাশ ও সমৃদ্ধির ইতিহাসের সঙ্গে দাস ব্যবসা সরাসরি জড়িত রয়েছে। তাই কয়েক শতাব্দী ধরে ব্রিস্টলে কলস্টনের স্মৃতিকে সম্মানিত করা হচ্ছে। তবে ব্রিস্টলের অনেক মানুষ আবার অনেক দিন ধরেই এই ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলার দাবি জানিয়ে আসছিলেন।

কলস্টনের মূর্তিটি সরিয়ে ফেলার পর অনেকে দাবি তুলছেন, ব্রিটেনে নানা জায়গায় বর্ণবাদ ও দাস ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট আরো অনেকের যেসব ভাস্কর্য আছে- সেগুলোও অপসারণ করতে হবে।

ওই ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি এলাকাতেও একইভাবে বিক্ষোভ প্রকাশ করছেন প্রতিবাদকারীরা। বিভিন্ন শহরে এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত ব্যক্তির মূর্তি ভাঙচুর করা হয়েছে। মার্কিন কর্তৃপক্ষের ওপরও সম্প্রতি চাপ এসেছে গৃহযুদ্ধের সময়কার কয়েকজন কনফেডারেট নেতার নামানুসারে দেয়া সেনাঘাঁটির নাম পরিবর্তন করার।

বিক্ষোভকারীরা দাবি করছে যে বর্ণবাদ, দাসপ্রথা বা দাস ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের মূর্তি প্রকাশ্যে রাখা চলবে না। যদি ইতিহাসের প্রয়োজনে সেগুলোকে রাখতেই হয়, তবে সেগুলোকে যাদুঘরে স্থানান্তরিত করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি শহরে গত কয়েকদিনে ইতালীয় অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মূর্তি ভাঙার ঘটনা ঘটেছে। তিনি সেই ব্যক্তি যিনি ষোড়শ শতাব্দীতে আমেরিকায় এসে স্থানীয়দের দাস হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়ে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মানুষ কলম্বাসের স্মৃতিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। অনেক স্কুলে কলম্বাসের জীবনীতে তাকে নতুন পৃথিবীর আবিষ্কারক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু আমেরিকার আদি অধিবাসীরা বহু বছর ধরেই এই চলের বিরোধিতা করে আসছে। তাদের বক্তব্য, কলম্বাসের অভিযানই আমেরিকার ঔপনিবেশিক শাসনের এবং আদি আমেরিকান অধিবাসীদের গণহত্যার পেছনের কারণ।

মিনেসোটা ও ভার্জিনিয়া রাজ্য এবং বস্টন ও মিয়ামি শহরে কলম্বাসের মূর্তি ভাঙা হয়েছে। বুধবার ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডে কনফেডারেট প্রেসিডেন্ট জেফারসন ডেভিসের একটি মূর্তি উৎপাটন করে বিক্ষোভকারীরা।

১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকটি রাজ্য ছিলো যাদের পরিচিতি ছিলো কনফেডারেট রাজ্য হিসেবে, যারা একত্রিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আলাদা সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র গঠন করার দাবি জানিয়েছিল। পরে আমেরিকার গৃহযুদ্ধে কনফেডারেটদের পরাজয় হয়।

কনফেডারেট রাজ্যগুলো দাস প্রথার সমর্থক ছিলো এবং দাস প্রথাকে বৈধতা দেয়ার পক্ষে ছিলো তারা। আর এই কারণেই কনফেডারেট নেতাদের মূর্তি অপসারণের দাবি জানাচ্ছে বিক্ষোভকারীরা। তাদের মতে, বর্ণবৈষম্য ও বর্ণবিদ্বেষহীন আমেরিকা প্রতিষ্ঠা করতে হলে বর্ণবাদকে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠা করা নেতাদের মহিমান্বিত করা বন্ধ করতে হবে।

আর বিভিন্ন জায়গায় তাদের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার মাধ্যমেই শুরু করতে হবে সেই কার্যক্রম। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শহর এবং সংগঠন কনফেডারেট নেতাদের মূর্তি এবং কনফেডারেট মতবাদ প্রকাশ করে এমন প্রতীক সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্ণবৈষম্যের সাথে জড়িত থাকায় এসব প্রতীক অপসারণের দাবি করা হয়ে আসছিল অনেকদিন ধরেই।-বিবিসি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //