অর্থ পাচারকারীদের জন্য ‘শাপে বর’ করোনাভাইরাস

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে জেরবার গোটা বিশ্ব। তবে এ পরিস্থিতিও ‘শাপে বর’ হয়ে উঠেছে অর্থ পাচারকারী ও দুর্নীতিবাজদের জন্য। এ সময় বাড়তে পারে আর্থিক প্রতারণাও, বলছে জার্মানিভিত্তিক অলাভজনক দুর্নীতি দমন প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)।

কভিড-১৯ ঘিরে উদীয়মান বিশ্বের দেশগুলো নানা ধরনের ত্রাণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ত্রাণ কতটুকু দুস্থদের কাছে পৌঁছাচ্ছে তা ভাবনার বিষয়। ত্রাণ বিতরণের কথা বলা হলেও এর সুযোগ নিচ্ছেন কিছু সুবিধাভোগী। 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। টিআই বলছে, দক্ষিণ আফ্রিকাজুড়ে কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব ছড়িয়েছে ব্যাপক আকারে। ওই অঞ্চলে যথেষ্ট ত্রাণ ব্যবস্থাও করেছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এই ত্রাণ তহবিল নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে তাদের মধ্যে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা ও উন্নয়ন সংস্থার ত্রাণের হিসাবে গরমিলের আশঙ্কা করছেন তারা। এই সংস্থাগুলো থেকেই বেশি ত্রাণ তহবিল আসছে। ২০১৭ সালে আফ্রিকায় ইবোলা মহামারি চলাকালেও একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল।

বার্তা সংস্থা এএফপির এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাসের ত্রাণ তহবিলের অপব্যবহার করার জন্য ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওর এক রাজনীতিকের বাসভবনে অভিযান পরিচালনা করেছে পুলিশের তদন্তকারী দল। 

এখানে ব্রাজিল বা দক্ষিণ আফ্রিকার কথা বলা হলেও অর্থ পাচার বা প্রতারণার বিষয়টি কোনো আঞ্চলিক ইস্যু নয়। সর্বস্থানে বিরাজমান এটি। আর এই সর্বজনীন ইস্যু মহামারির সময় আরো প্রকট হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্টদের কপালের ভাঁজ বাড়ে। এবার করোনাভাইরাস মহামারিতে ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতির মাত্রা মারাত্মক হতে পারে বলে গত ১৩ মার্চই সতর্ক করেন টিআই কর্মকর্তারা ও তাদের লাতিন সহযোগীরা।

ত্রাণ তহবিল ব্যবহারের বিষয়টি সরবরাহ, চাহিদা সংশ্লিষ্ট কিনা, বা কেউ এ সংকট থেকে সুবিধা নিচ্ছে কিনা, তা অজানাই থেকে যাচ্ছে। টিআই বলছে, চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহ চুক্তির বাইরে ঘুষ, অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতি দেশগুলোয় করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে ত্রাণ কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করবে। উদীয়মান বিশ্ব এখন অর্থ পাচারকারী, দুর্নীতিবাজদের জন্য স্বর্র্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। তবে ইউরোপ আর্থিক দুর্নীতি রোধে এরই মধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছে। ইউরো অঞ্চলের স্থানীয় ব্যাংকগুলো মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও রাশিয়ার সাথে অসদুপায়ে ব্যবসা করে না। রুশ ব্যাংকের আর্থিক খতিয়ান তদন্তের অধীন আছে। মহামারির সময়ও এ তদন্ত চলছে।

পিভি গ্রুপ আর্থিক অপরাধে ক্ষতিগ্রস্তদের তহবিল সন্ধান ও তা ফিরিয়ে দিতে কাজ করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি অবশ্য দ্বিমত পোষণ করছে টিআইয়ের সাথে। প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাড লেন্ডার বলেন, কভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী আইনপ্রণেতা ও আইনবিষয়ক সংস্থাগুলো আর্থিক অপরাধের দিকে আরো বেশি নজর রাখছে। আগের মতো এখন আর এ সংক্রান্ত মামলা বছরের পর বছর চলে না। আর্থিক অপরাধ তদন্তে তাদের আর সেই ধৈর্য্য নেই। এখন এসব মামলা তাড়াতাড়ি শেষ করার দিকেই গুরুত্ব দেয়া হয়। 

এদিকে গত ৭ মে ইউরেপিয়ান ইউনিয়নে (ইইউ) অর্থ পাচার রোধে একটি কর্ম পরিকল্পনা ইস্যু করেছে ইউরোপীয় কমিশন (ইসি)। এছাড়া ইউরোপে আর্থিক দুর্নীতি ঠেকাতে ইইউর পুলিশ বাহিনী ইউরোপোল একটি বিশেষ তদন্তকারী ইউনিট তৈরি করেছে। ইউরোপের অর্থনৈতিক অপরাধ কেন্দ্র বা ফিন্যান্সিয়াল অ্যান্ড ইকোনমিক ক্রাইম সেন্টার জোটের পুলিশ বাহিনী ইউরোপোলের সাথে কাজ করবে। 

এ বিষয়ে ইউরোপোলের প্রধান ক্যাথরিন দ্য বোলে বলেন, ‘কভিড-১৯ আমাদের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়েছে এবং এতে করে অপরাধ প্রবণতার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।’

টুইটারে ইউরোপোলের পক্ষ থেকে লেখা হয়, ‘গন্তব্যে অর্থ পৌঁছানো পর্যন্ত লেনদেনগুলো খতিয়ে দেখা হবে ও অপরাধীদের কাছ থেকে একে দূরে রাখতে হবে।’ 

ইউরোপোল জানিয়েছে, নির্মাণ খাত, হোটেল, ভ্রমণ ও পর্যটন খাতে অপরাধের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। চিকিৎসা সরঞ্জামেও ঝুঁকির কথা বলছেন তারা। বিশেষ ইউনিটটিতে ২৭টি ইইউ সদস্য দেশ থেকে ৬৫ জন বিশ্লেষক থাকবেন। তারা নিজ নিজ দেশকে প্রতিনিধিত্ব করবেন। 

মহামারি হোক বা না হোক প্রতি বছর বৈশ্বিক আর্থিক প্রক্রিয়ায় ৮০০ বিলিয়ন থেকে ৩ ট্রিলিয়ন ডলার আর্থিক দুর্নীতি হয়ে থাকে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। মহামারির কারণে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের আইন প্রণেতা ও নীতি-নির্ধারকদের অর্থ পাচার নিয়ে চিন্তা-ভাবনার সময় খুব কম। তাই পশ্চিমা আর্থিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিতে গুরুত্ব দেবেন তারা। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় এসব অঞ্চলের সরকার ত্রাণ সহায়তা দিতে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করছে। ফলে অর্থ পাচার ও কর ফাঁকি দেওয়ার ক্ষেত্রে অপরাধীদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। 

জার্মান পার্লামেন্টের সদস্য পিটার বায়েরের ভাষ্যে, ‘বেশ কয়েকটি মামলায় দেখা গেছে, মহামারিতে দুস্থদের সহায়তার জন্য নেয়া অর্থ পরে অবৈধভাবে ব্যবহার হয়েছে। এই অর্থ হয়তো ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত কোনো প্রতিষ্ঠানকে সহায়তার জন্য ব্যয় করা হয়েছে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //