নজরদারি বাড়াচ্ছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা

অপরাধমূলক কার্যক্রম রোধে আমেরিকানদের ওপর নজরদারি বাড়াতে ব্যবস্থা নিয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)। যুক্তরাষ্ট্রে এখন থেকে কে কখন কি টুইট করছেন, জনসমাগমে কে কি বলছেন, করছেন- এসবই থাকতে পারে এফবিআইর হাতের মুঠোয়। গত ২৬ মে পুলিশি সহিংসতায় জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর প্রতিবাদে পুরো যুক্তরাষ্ট্র যখন উত্তাল, ঠিক সেদিনই ডাটামিনর নামের এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে এফবিআই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো পর্যবেক্ষণ করে ডাটামিনর।

এর দিন কয়েক পর ভেনটেল ইনকরপোরেশনের সঙ্গে করা পুরনো চুক্তিতে পরিবর্তন এনেছে সংস্থাটি। ভার্জিনিয়ার প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ফেব্রুয়ারিতে চুক্তি করেছিল এফবিআই। প্রতিষ্ঠানটি লাখো আমেরিকানের চলাচলে নজরদারি করে। সে অনুযায়ী তৈরি করে রাখে মানচিত্র। ভেনটেল প্রচুর পরিমাণে লোকেশন ডাটা কিনে বিক্রি করে সরকারি সংস্থার কাছে।

অপরাধমূলক কর্মকা- সম্পর্কে ধারণা পেতে ও সন্দেহভাজনদের শনাক্ত করতে উন্নত প্রযুক্তিগত উপকরণ দীর্ঘদিন ধরেই ব্যবহার করছে এফবিআই। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন অনেকেই। তারা মনে করছেন, নানা বিষয়ে আমেরিকানদের প্রতিবাদ ও মুক্তমত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার জন্যই এসব পদক্ষেপ নিচ্ছে এফবিআই।

চলতি বছরের শুরুতে আইনিভাবে সংগৃহীত বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চলমান জাতীয় নিরাপত্তা ও জননিরাপত্তা সংক্রান্ত ঘটনাগুলোর বিষয়ে প্রাথমিক পর্যায়েই ওয়াকিবহাল হতে প্রযুক্তিগত সহায়তা চেয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রকাশ করেছিল এফবিআই। ভেনটেলের সঙ্গে করা চুক্তিটিতে কি পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা ঠিক স্পষ্ট নয়। কোম্পানির প্রেসিডেন্ট ক্রিস জিলদিয়াও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।

যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ডাটা ব্রোকার কোম্পানি গ্র্যাভি অ্যানালিটিক্সের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ভেনটেল। গ্র্যাভি অ্যানালিটিক্স বিজ্ঞাপনদাতা ও অন্য গ্রাহকদের কাছে লোকেশন ট্র্যাকিং সংক্রান্ত তথ্য বিক্রি করে থাকে। কাজের ধরনে গোপনীয়তা রক্ষার শর্ত রয়েছে। তাই গ্র্যাভি অ্যানালিটিকসও এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ। এফবিআইর মুখপাত্রও এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

আরেক কোম্পানি ডাটামিনরের সঙ্গে ১০ লাখ ডলারেরও বেশি মূল্যের চুক্তি করেছে এফবিআই। ডাটামিনর ব্রেকিং নিউজ ও চলমান নানা ঘটনা সম্পর্কে তথ্য পেতে শ্যেন দৃষ্টি রাখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কোম্পানির মুখপাত্র এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অগ্নিকা-, বিস্ফোরণ, গোলাগুলির মতো জরুরি বিষয়গুলো সম্পর্কে এফবিআইকে সতর্কবার্তা পাঠায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আজ এগিয়ে চলেছে সন্ত্রাসবাদ- বলেন এফবিআই পরিচালক ক্রিস্টোফার রে।

গত বছর আইন প্রণেতাদের তিনি বলেছিলেন, ‘নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠী থেকে বর্র্ণবাদীদের হিংস্র উগ্রবাদ- এখন এসবের বেশিরভাগই শুরু হয় অনলাইনে।’ তবে এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন এফবিআই’র সমালোচকরা। আমেরিকান ফ্রেন্ডস সার্ভিস কমিটির (এএফএসসি) কমিউনিটিস অ্যাগেইনস্ট ইসলামোফোবিয়া প্রোগ্রামের কো-অর্ডিনেটর মেরি জার্কেল বলেন, ‘এফবিআই তাদের নজরদারির সক্ষমতা আরও বাড়াচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা ভীষণ উদ্বিগ্ন।’ মুসলিম, অভিবাসী, অশ্বেতাঙ্গ মানুষ, সাধারণ কর্মী ও বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর কয়েক দশক ধরেই নজরদারি করছে এফবিআই। এএফএসসির নিজেরও একটি এফবিআই ফাইল রয়েছে, জানান উদ্বিগ্ন জার্কেল। তিনি আরও বলেন, ‘গণতথ্য সংগ্রহের পদক্ষেপ অপরাধমূলক বিক্ষোভ বাড়িয়ে দেবে। বাকস্বাধীনতায়ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া মুসলিম ও অশ্বেতাঙ্গদের ওপর অপরাধমূলক কর্মকা- বাড়বে।’

তবে লোকেশন ডাটা ট্র্যাকিংয়ের ব্যবহার সীমাবদ্ধ করার জন্য বেশ কিছু বিধান রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের ২০১৮ কারপেনটার ভার্সেস ইউনাইটেড স্টেটসের রায় অনুযায়ী, সেবাদাতাদের কাছ থেকে সেলফোনের লোকেশন ডাটা পেতে সরকারি কৌঁসুলিদের ওয়ারেন্টের প্রয়োজন হয়। তবে অনেক বিশ্লেষকের মতে, রায়টি ভেনটেলের মতো তৃতীয় পক্ষের ডাটা ব্রোকারদের জন্য প্রয়োজ্য হতে পারে না।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেশ কয়েকটি পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জোট বেঁধেছে এফবিআইসহ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য আইন প্রণয়নকারী সংস্থাগুলো। এর মধ্যে রয়েছে পালানতির। প্রতিষ্ঠানটি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে লাইসেন্স প্লেট- সব কিছু থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করে কিছু সরঞ্জাম তৈরি করে। এ সরঞ্জাম দিয়ে যে কোনো সম্পর্কের বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। এ ছাড়া সেলফোন ট্র্যাক করতে আরেকটি পণ্য ব্যবহারের ব্যবস্থা নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণয়নকারী সংস্থাগুলো। পণ্যটির নাম ‘লোকেট এক্স’।

বিক্রি করে ভার্জিনিয়ার আরেক কোম্পানি ব্যাবেল স্ট্রিট। লোকেট এক্সের মাধ্যমে তদন্তকারীরা একটি নির্দিষ্ট এলাকা বা অঞ্চলের মানুষদের সেলফোন ট্র্যাক করতে পারেন। তবে এ বিষয়টি গোপন রেখেছে ব্যাবেল স্ট্রিট। ফেডারেল রেকর্ডে দেখা গেছে, ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশন (সিবিপি) লোকেট এক্স প্রযুক্তি কিনেছে। এ ছাড়া ব্যাবেল স্ট্রিটের এক সাবেক কর্মকর্তার তথ্য অনুযায়ী, এ প্রযুক্তির শরণাপন্ন হয়েছে সিক্রেট সার্ভিস ও ইউএস ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্টও (আইসিই)। তবে লোকেট এক্স ব্যবহারের বিষয়ে কেউই জনসমক্ষে মুখ খুলছে না। তাই লোকেট এক্স সম্পর্কে খুব কম তথ্যই জানা গেছে। 

২০১৭ সালের মে মাসে ইউএস পেটেন্ট অ্যান্ড ট্রেডমার্ক অফিসে ‘লোকেট এক্স’ নিবন্ধন করে ব্যাবেল স্ট্রিট। এরপর থেকে পণ্যটির চাহিদার সঙ্গে বাড়ছে দামও। লোকেট এক্সের কল্যাণে কদর বেড়েছে ব্যাবেল স্ট্রিটেরও। নিবন্ধনের আগে ২০১৬ সালে ফেডারেল সংস্থাগুলো লোকেট এক্স কিনতে মাত্র ৬৪ হাজার ডলারে চুক্তি করে ব্যাবল স্ট্রিটের সঙ্গে। ২০১৭ সালে অর্থের এ অঙ্ক উন্নীত হয় ২১ লাখ ডলারে। ২০১৮ সালে লোকেট এক্স কিনতে সংস্থাগুলোকে ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় ৫৩ লাখ ডলার। 

ব্যাবেল স্ট্রিটের সঙ্গে ‘ব্যালে সফটওয়্যার’ কিনতে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ৯ লাখ ৮১ হাজার ডলারেরর প্রথম চুক্তি করে সিবিপি। এরপর ২০১৯ সালে ‘ব্যাবেল সফটওয়্যার লাইসেন্সেস’ এর জন্য ২২ লাখ ডলারের নতুন চুক্তি করে তারা। লোকেট এক্সের জন্য আরও এক লাখ ৩০ হাজার ডলারের একটি চুক্তি করেছে সংস্থাটি। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাবেল স্ট্রিটের সঙ্গে ১১ লাখ ডলারের এক বছর মেয়াদি চুক্তি করে আইসিই। এর মধ্যে লোকেট এক্সও রয়েছে। গত আগস্টে ‘ডাটা সাবস্ক্রিপশন সার্ভিসেস’ সেবার জন্য ব্যাবেল স্ট্রিটের সঙ্গে ৬৫ লাখ ডলারের পাঁচ বছর মেয়াদি চুক্তি করেছে আইসিই। ব্যাবেল স্ট্রিটের সঙ্গে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এমন সংস্থাগুলোর মধ্যে ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস, ইউএস মার্শালস সার্ভিস, আর্মি, কোস্ট গার্ড, সিকিউরিটি অ্যান্ড ইমার্জেন্সি রেসপনস অন্যতম।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //