ভ্যাকসিন যুদ্ধ: ক্ষয়িষ্ণু বিশ্বব্যবস্থায় আরেক আঘাত

করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিশ্চিতের আগেই কয়েকটি দেশ কোটি কোটি ডোজের ভ্যাকসিনের অর্ডার করে ফেলেছে। 

জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে জানায়, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ আরো কিছু পশ্চিমা দেশ আগেভাগেই বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিকে ভ্যাকসিনের অর্ডার দিয়ে ফেলেছে, যাতে করে চলতি বছর শেষ হওয়ার আগেই তাদের হাতে একটি কার্যকর ভ্যাকসিন থাকে। 

যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ১০ বিলিয়ন ডলার খরচে প্রায় ৭০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের অর্ডার করেছে। রাশিয়া ও চীনও ভ্যাকসিন আবিষ্কারে পশ্চিমা বিশ্বের বিকল্প নিয়ে হাজির হওয়ার যার পর নাই চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখন এই ‘ভ্যাকসিন যুদ্ধের’ মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা নিয়ে কথা বলছেন অনেকেই।

জাপান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৫৭ সালে রাশিয়ার প্রথম মহাকাশ স্যাটেলাইট ‘স্পুটনিক’ যেমন মহাকাশ প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছিল, এখন ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের প্রথম ভ্যাকসিন বাজারে আনার পেছনেও তেমনই ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। রাশিয়ার ভ্যাকসিনের ‘স্পুটনিক-৫’ নামকরণের স্বার্থকতা হয়তো সেখানেই! 

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ফলাও করে ভ্যাকসিনের ঘোষণা দেয়ার পেছনে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের স্বার্থ রয়েছে যথেষ্ট। রাশিয়ার অর্থনীতি ধুঁকে ধুঁকে চলছিল, ভাইরাসের আগমনের পর অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। ক্রমান্বয়ে নিম্নগামী জনসমর্থনের লাগাম টানতে এই ভ্যাকসিন পুতিনকে সহায়তা করতে পারে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এটি রাশিয়ার অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারে। 

রাশিয়ার মতো চীনও প্রথম ভ্যাকসিন বাজারে আনতে ব্যাপক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। একটি চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি জুলাই মাসেই তার শীর্ষ কর্মকর্তাদের ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক ডোজ দিয়েছে। ভ্যাকসিনের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে পুতিন নিজেও তার কন্যাকে ভ্যাকসিন দিয়েছেন বলে ঘোষণা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের আগেই ভ্যাকসিন জোগাড় করাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছেন। 

তবে রাশিয়া ও চীনের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে পশ্চিমা গবেষকরা সন্দেহ প্রকাশ করছেন। তারা বলছেন, ভ্যাকসিন যদি এখন কাজও করে, সেটি কতদিন কার্যক্ষম থাকবে, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে সময় লাগবে। 

ইউনিভার্সিটি অব সাউদাম্পটনের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মাইকেল হেড বলেন, ‘ভ্যাকসিন কাজ করবে কি না, এ মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলাটা বেশ কঠিন।’ তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তিশালী ইতিহাস থাকায় অনেকেই রাশিয়ার ভ্যাকসিনের দাবিকে এড়িয়ে যেতেও পারছেন না। 

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক আটলান্টিক কাউন্সিলের ডিসটিংগুইশড ফেলো ড্যানিয়েল ফ্রিড বলেন, ‘প্রথম ভ্যাকসিন যে দেশ বাজারে আনতে পারবে, সে দেশ বিশ্বব্যাপী যথেষ্ট সম্মানজনক একটা অবস্থান পাবে।’

রয়টার্স জানায়, ব্রিটিশ সরকার তার ছয় কোটি ৬০ লাখ জনগণের জন্য মোট ছয় প্রকারের ৩৪ কোটি ডোজের ভ্যাকসিন অর্ডার করেছে। ব্রিটিশ ভ্যাকসিন টাস্কফোর্সের প্রধান কেইট বিংহ্যাম বলেন, ‘ব্রিটেন বিভিন্ন উৎস থেকে তার ভ্যাকসিনের সরবরাহ নিশ্চিত করতে চাইছে। ভ্যাকসিনের প্রথম দিককার পরীক্ষামূলক ফলাফলগুলোর দিকে ব্রিটেন দৃষ্টি রাখবে, যাতে বোঝা যায়, কোন ভ্যাকসিনটি ঠিকমতো কাজ করছে।’ 

জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানি ব্রিটেনকে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহ করবে; সফল হলে এর সাথে আরো দুই কোটি ২০ লাখ ডোজ যোগ হবে। এর সাথে রয়েছে নোভাভ্যাক্স থেকে ছয় কোটি ডোজ। ইউরোপিয়ান কমিশন ঘোষণা দিয়েছে, তারা এসট্রা জেনেকা কোম্পানির কাছ থেকে ৩০ কোটি ভ্যাকসিন অর্ডার করেছে। একই কোম্পানি ব্রিটেনকে দেবে ১০ কোটি ভ্যাকসিন; আর যুক্তরাষ্ট্রকে ৩০ কোটি। জুলাই মাসে বায়ো এনটেক ও ফাইজারের যৌথ উদ্যোগের কাছ থেকে ব্রিটেন নয় কোটি ভ্যাকসিনের অর্ডার করে; একই কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ১০ কোটি ডোজ বিক্রি করছে। মার্কেট ওয়াচ বলছে, এই প্রতিটি কোম্পানিই অর্থনৈতিক ধসের মাঝেও পুঁজিবাজারে ব্যাপক ভালো করছে। নোভাভ্যাক্সের শেয়ারমূল্য মে মাস থেকে প্রায় সাতগুণ বেড়েছে। মার্চ থেকে বায়ো এনটেকের শেয়ারমূল্য ১৩৬ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়াও এপ্রিল থেকে ফাইজারের মূল্য বেড়েছে ৩৯ শতাংশ। মার্চ থেকে এসট্রা জেনেকার বাজারমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৬ শতাংশ।

বহুজাতিক করপোরেটরা বিলিয়ন ডলারের মুনাফা করে নিচ্ছে; কিন্তু ধনী দেশগুলোর জনসংখ্যার কয়েক গুণ ভ্যাকসিন অর্ডার করার উদ্দেশ্য আসলে কী?

‘ওয়েলকাম ট্রাস্ট’ হেলথ চ্যারিটির গ্লোবাল পলিসি প্রধান এলেক্স হ্যারিসের মতে, এভাবে ধনী দেশগুলো ভ্যাকসিনের অর্ডার করতে থাকলে গরিব দেশগুলো কোনো ভ্যাকসিনই পাবে না। ডয়চে ভেলে জানায়, গরিব দেশগুলোর জন্য বিনিয়োগ করতে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো সর্বদাই কার্পণ্য করেছে। ধনী দেশগুলোর কাছে বেশি মূল্যে ভ্যাকসিন বা ওষুধ বিক্রি করতে পারে বলেই তারা কখনো গরিব দেশগুলোর দিকে তাকানোর প্রয়োজন মনে করে না। 

নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনকে মাথায় রেখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, নভেম্বরের মাঝেই যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ভ্যাকসিন চলে আসবে। ব্রিটেনে জনমত তৈরি করা হচ্ছে, যাতে গরিব দেশগুলোতে ব্রিটেন ভ্যাকসিন দেয়ার মাধ্যমে তার ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। এজন্যই জনসংখ্যার পাঁচ গুণ বেশি ভ্যাকসিন কিনছে ব্রিটেন। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন চাইছেন ‘স্পুটনিক-৫’ ভ্যাকসিনকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে ঠাণ্ডা যুদ্ধের ‘স্পুটনিক’ স্যাটেলাইটের মতোই রাশিয়ার হারিয়ে যাওয়া গৌরব ফিরিয়ে আনতে; এ কারণে নিজের মেয়েকেও পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন দিতে ছাড়েননি তিনি। বিশ্বব্যাপী নিজেদের ডেভেলপ করা ভ্যাকসিন বিক্রির উদ্যোগ হিসেবে ২১ আগস্ট চীনারা ইন্দোনেশিয়ার কাছে চার কোটি ডোজ ভ্যাকসিন বিক্রির চুক্তি করেছে। 

কোন দেশ কার কাছ থেকে ভ্যাকসিন কিনবে, সেটি নিয়েও শুরু হয়েছে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। বহুজাতিক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর মাঝে চলছে মুনাফার প্রতিযোগিতা। শিগগিরই গরিব দেশগুলোতে ভ্যাকসিন সরবরাহ নিয়ে শক্তিশালী দেশগুলোর মাঝে শুরু হবে প্রতিযোগিতা। বৈদেশিক আর্থিক সহায়তা ও পশ্চিমা দেশে ভ্রমণের শর্ত হিসেবে ভ্যাকসিনের উৎসকে যাচাই করা হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। 

সামনের মাসগুলোতে ভূরাজনৈতিক প্রভাব ও মুনাফাবৃত্তির এই প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা করোনাভাইরাস আক্রান্ত ক্ষয়িষ্ণু বিশ্বব্যবস্থাকে আরো দুর্বল করবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //