অ্যাসাঞ্জের প্রত্যর্পণ মামলায় বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া

মুক্ত সংবাদমাধ্যম উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের কারামুক্তি চেয়ে ব্রিটিশ আদালতে আবেদন করেন তার আইনজীবীরা। তারা যুক্তি দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের হাতে প্রত্যর্পণ না করতে ব্রিটিশ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের আপিল শুনানি স্থগিত থাকায় ব্রিটিশ কারাগার থেকে জামিন পেতে পারেন তিনি। তবে গত ৬ জানুয়ারি লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ওই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। 

এর আগে গত ৪ জানুয়ারি লন্ডনের একটি আদালতের রায়ে বলা হয়, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়া হবে না। অ্যাসাঞ্জের মানসিক স্বাস্থ্য এবং আত্মহত্যার ঝুঁকির কথা বিবেচনায় নিয়ে এই রায় দেন বিচারক। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বব্যাপী এ রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্টজনরা। সমাজ চিন্তকদের মতে, এ রায়ের ফলে আপাতত জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের প্রাণ রক্ষা হলেও, মুক্ত গণমাধ্যমের পক্ষে কোনো ইতিবাচকতা নেই। 

গুয়ানতানামো বে কারাগারের বেশকিছু তথ্য ফাঁস করে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রকে বড় ধাক্কা দেয় উইকিলিকস। এরপর একে একে আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধ নিয়েও ক্ল্যাসিফায়েড অনেক নথিই ফাঁস করেন অ্যাসাঞ্জ। ২০১০-১১ সালে ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসন এবং গুয়ান্তানামো বে কারাগারের প্রায় আট লাখ গোপনীয় তথ্য পায় উইকিলিকস, যা প্রায় এক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে তারা। এর পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র তথ্য ফাঁসকারী সাবেক সেনা সদস্য চেলসি ম্যানিংকে আটক করে কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি করে। নানা অভিযোগে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে ৩৫ বছরের কারাদ-াদেশ দেওয়া হয় তাকে। পরে ওই শাস্তি কমিয়ে সাত বছরে আনা হয়। গ্রেফতারের সময় থেকে হিসাব করে ২০১৭ সালে শাস্তির মেয়াদ শেষ হলে ম্যানিং মুক্তি পান। কোর্ট মার্শালের সময়েই আলোচনায় এসেছিল- তথ্য ফাঁসের অভিযোগে সেনা সদস্যের বিচারের সঙ্গে সঙ্গে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকেও বিচারের মুখোমুখি করা যায় কি-না। তবে ওবামা আমলে মার্কিন বিচার বিভাগ জানায়, এ অভিযোগে অ্যাসাঞ্জকে অভিযুক্ত করলে তা মুক্ত সাংবাদিকতাকে হুমকির মুখে ফেলবে। ক্ষমতার পালাবদলে ট্রাম্প আমলের বিচারকরা একই অভিযোগে বিপরীত অবস্থান নেন। অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে বিচার সাজাতে চেলসি ম্যানিংকে আবারও আটক করা হয়। বলা হয়েছে, অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনে সরকারের পক্ষে কাজ না করলে তাকে কারাগারেই থাকতে হবে।

২০১২ সালের জুন থেকে লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন অ্যাসাঞ্জ। দেশটিতে মার্কিনপন্থী লেনিন মোরেনো সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল রাজনৈতিক আশ্রয় প্রত্যাহার করে তাকে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে তুলে দেয় ইকুয়েডর। ওইদিনই তাকে জামিনের শর্ত ভঙ্গের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে ব্রিটিশ আদালত। তখন থেকে বেলমার্শ নামক ‘যুক্তরাজ্যের গুয়ানতানামো বে’ খ্যাত কুখ্যাত কারাগারে রাখা হয়েছে অ্যাসাঞ্জকে। এখন তাকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে একটি মামলার বিচার চলছে ব্রিটিশ আদালতে। করোনাভাইরাসের কারণে ওই মামলার শুনানি এতদিন স্থগিত ছিল। গত ১৪ সেপ্টেম্বর তা শুরু হয়। ব্রিটিশ পুলিশ অ্যাসাঞ্জকে হেফাজতে নিয়েই জানিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড জুরি অ্যাসাঞ্জকে যে ১৮টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছে, তার মধ্যে ১৭টি অভিযোগই মার্কিন গুপ্তচরবৃত্তি আইনের আওতায় পড়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে ১৭৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাশালীদের মুখোশ উন্মোচনকারী অ্যাসাঞ্জের।

গত ৪ জানুয়ারি লন্ডনের একটি আদালতে অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত মামলার রায় দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, অ্যাসাঞ্জ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিলে তার আত্মহত্যা করার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি কারাগার থেকে আত্মহত্যায় সমর্থন দেওয়া একটি সংগঠনের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগও করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ না করার রায় দেওয়া হয়। রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দুই সপ্তাহের মধ্যে আইনি যুক্তি উপস্থাপনের কথা জানিয়েছে তারা। 

গত ৬ জানুয়ারি অ্যাসাঞ্জের জামিন আবেদন খারিজ করে ব্রিটিশ আদালত। এরপর আদালত প্রাঙ্গণে অ্যাসাঞ্জের জীবনসঙ্গী স্টেলা মরিস সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটি প্রচণ্ড হতাশার। অ্যাসাঞ্জের বেলমার্শ কারাগারে থাকা ঠিক হবে না। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য আমি আইন বিভাগের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকেও আহ্বান জানাচ্ছি যেন তারা জুলিয়ানকে ক্ষমা করে দেন।’ এর আগে গত এপ্রিলেও অ্যাসাঞ্জের জামিন চেয়ে আদালতে আবেদন করেছিলেন স্টেলা মরিস। জামিন আবেদনের সঙ্গে দেওয়া এক বিবৃতিতে কীভাবে অ্যাসাঞ্জের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছিল তাও প্রকাশ করেছিলেন এ আইন গবেষক। স্টেলা বিবৃতিতে লিখেছিলেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অ্যাসাঞ্জ ও আমার মধ্যে ভালো রকমের বুদ্ধিবৃত্তিক ও আবেগী বন্ধন গড়ে ওঠে। আমরা একে অপরের সেরা বন্ধুতে পরিণত হই।’ অ্যাসাঞ্জ লন্ডনে ইকুয়েডর দূতাবাসে থাকার সময় তাদের দুটি সন্তানও হয়। তাদের একজনের নাম গ্যাব্রিয়েল, অপরজনের নাম ম্যাক্স। 

অ্যাসাঞ্জের প্রত্যর্পণ মামলার রায় ও তার জামিন আবেদন খারিজ হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অ্যাসাঞ্জকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাডর। তিনি বলেন, ‘অ্যাসাঞ্জ একজন সাংবাদিক এবং একটি সুযোগ তার প্রাপ্য। আমি তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার পক্ষে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তাকে সুরক্ষা দেবো।’ অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনও বলেছেন, ‘আমি আশা করি, আইনি লড়াই শেষ হলে অ্যাসাঞ্জ নিজ বাড়িতে ফিরতে পারবেন।’

ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক নোম চমস্কি বলেন, ‘আমরা এ বিষয়টি উদযাপন করতে পারি- অ্যাসাঞ্জকে বর্বর মার্কিন কারাগারে পাঠানো হবে না, তবে বাকিটুকু একটি বিপর্যয় ছাড়া কিছু নয়। আদালতের এ রায় বাইডেন প্রশাসনের জন্য একটি উপহার। তাদের এমন এক বিচারের চাপ বহন করতে হবে না, যা একটি আন্তর্জাতিক কেলেঙ্কারি। মানসিকভাবে অসুস্থ উল্লেখ করে অ্যাসাঞ্জকে প্রত্যর্পণ করা হয়নি। হাস্যকর যুক্তি দিয়ে মামলাটি সাজানো হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় অপরাধের তথ্য, যা কর্তৃপক্ষ লুকিয়ে রাখতে চায়; কেউ জনসমক্ষে আনলে তাকেও একইভাবে অভিযুক্ত করার স্বীকৃতিও এ রায়ের মাধ্যমে সরকারকে দেওয়া হয়েছে।’

উইকিলিকসের প্রধান সম্পাদক ক্রিস্টিন রাফসনের মতে, এ রায় অ্যাসাঞ্জের জন্য ‘জয়’ হলেও সাংবাদিকতার স্বাধীনতার জন্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করে মামলাটি তুলে নেওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি। 

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মা ক্রিস্টিন অ্যাসাঞ্জ বলেন, ‘সব অভিযোগ তুলে নিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফেরার আগে এটি শেষ হচ্ছে না। তবে ১০ বছর ধরে ট্রমায় থাকা আমাদের জন্য আজকের খবরটি অবশ্যই সবচেয়ে ভালো।’

ইকুয়েডরের সাবেক প্রেসিডেন্ট রাফায়েল কোরেয়া এক টুইট বার্তায় বলেন, ‘বিশ্বের জন্য এটি এক অসাধারণ খবর। জুলিয়ান এবং তার অনন্যসাধারণ আইনজীবীদের অভিনন্দন।’ ২০১২ সালে রাফায়েল কোরেয়া দেশটির লন্ডন দূতাবাসে অ্যাসাঞ্জকে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান করেছিলেন। 

রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা আরেক হুইসেল ব্লোয়ার এডওয়ার্ড স্নোডেন এ রায়ের পর সব অ্যাসাঞ্জ সমর্থকদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তবে মামলাটিকে ‘গত কয়েক দশকের মধ্যে সাংবাদিকতার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় আঘাতগুলোর একটি’ বলে উল্লেখ করেছেন।

যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির সাবেক প্রধান নেতা জেরেমি করবিন বলেন, ‘অ্যাসাঞ্জের প্রত্যর্পণ নিশ্চিতভাবেই সংবাদমাধ্যমের ওপর এক বড় হামলা। তাকে এখনই কারামুক্ত করা দরকার।’ দেশটির পার্লামেন্ট সদস্য জাহরা সুলতানাও অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে না দেওয়ার সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে উল্লেখ করেছেন। সেই সঙ্গে তাকে এখনই বেলমার্শ কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ারও দাবি জানান।

অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা পিলগার এ রায়কে ‘দুর্দান্ত’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘এ রায়ের ফলে যুক্তরাজ্যের মুখ রক্ষার হলো। এর মধ্য দিয়ে অ্যাসাঞ্জের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলাকে স্বীকৃতি দেওয়া হলো।’

যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ রায়কে স্বাগত জানালেও, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে। 

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মুক্ত সংবাদমাধ্যম ইন্টারসেপ্টের প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক গ্লেন গ্রিনওয়াল্ডও আদালতের রায়কে ‘সুখবর’ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি বলেন, ‘মামলার যুক্তি-তর্কে বিচারক যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্যই গ্রহণ করেছেন। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য এটি বিজয় নয়।’ 

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের সম্পাদকীয়তে বলা হয়, এই সিদ্ধান্ত অ্যাসাঞ্জ ও তার পরিবারের জন্য খানিক স্বস্তি আনলেও, তার সমর্থক অথবা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষাবলম্বনকারীদের জন্য এটি উদযাপনের কোনো উপলক্ষ নয়। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের এক বিবৃতিতে বলা হয়, অ্যাসাঞ্জকে অভিযুক্ত করার মানে হলোÑ মার্কিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর লঙ্ঘন। উল্লেখ্য, মার্কিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে মতপ্রকাশ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংরক্ষণ করা হয়। এ রায়ে সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে যে কোনো সাংবাদিক অ্যাসাঞ্জের মতো অবস্থায় পড়তে পারেন। এতে জনস্বার্থের বিজয় অর্জিত হয়নি।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //