মহাকাশে যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়ার চ্যালেঞ্জ

গত ১৬ ডিসেম্বর মার্কিন সামরিক বাহিনীর স্পেস কমান্ডের এক বিবৃতিতে বলা হয়, রাশিয়া মহাকাশকে যুদ্ধক্ষেত্র বানাতে চাইছে। রাশিয়া নতুন করে একটা স্যাটেলাইট বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। এটি ২০২০ সালে রাশিয়ার এরকম তৃতীয় পরীক্ষা। মার্কিন স্পেস কমান্ড আরও জানায়, এরকম ক্ষেপণাস্ত্র নিম্ন কক্ষপথে থাকা স্যাটেলাইট ধ্বংস করতে সক্ষম। আর এরকম একটি স্যাটেলাইট ধ্বংস হলে এর ধ্বংসাবশেষ আশপাশের স্যাটেলাইটের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।

স্পেস কমান্ডের কমান্ডার জেনারেল জেমস ডিকিনসন এক বিবৃতিতে বলেন, রাশিয়া মুখে বলছে যে তারা মহাকাশে যুদ্ধ চায় না; কিন্তু তারা মহাকাশ ও ভূপৃষ্ঠে হামলার সক্ষমতা গড়ে তুলছে। আর এটি স্যাটেলাইটের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরশীলতাকে দুর্বলতা হিসেবে কাজে লাগাতে চাইছে। মার্কিন কর্মকর্তারা জানান, রাশিয়া দুই ধরনের স্যাটেলাইট বিধ্বংসী অস্ত্র ডেভেলপ করছে। এর একটি হলো- ‘ডিরেক্ট এসেন্ট এন্টি স্যাটেলাইট’, যা মূলত ভূমি থেকে ছোড়া একটা ক্ষেপণাস্ত্র। আর দ্বিতীয়টি হলো- ‘কো অরবিটাল এন্টি স্যাটেলাইট’, যার মাধ্যমে মহাকাশে একটি স্যাটেলাইট আরেকটা স্যাটেলাইটের ওপর হামলা করে। রাশিয়ার মহাকাশভিত্তিক এই পরীক্ষাগুলোর উদ্দেশ্য বুঝতে হলে এই প্রকল্পগুলোর বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

গত জুলাই মাসে মার্কিন স্পেস কমান্ড জানায়, রাশিয়া আরও একটি স্যাটেলাইট বিধ্বংসী ব্যবস্থার পরীক্ষা চালিয়েছে। ‘কসমস ২৫৪৩’ নামের এই স্যাটেলাইট মহাকাশে গিয়ে আরেকটি বস্তুকে মহাকাশে ছেড়েছে। এর মাধ্যমে কোনো কিছু ধ্বংস করা ছাড়াই রাশিয়া একটি কো অরবিটাল এন্টি স্যাটেলাইট ব্যবস্থার পরীক্ষা চালাল। এর আগে গত এপ্রিলে রাশিয়া ডিসেম্বরের মতোই একটি এন্টি স্যাটেলাইট ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছিল। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা জানান, দুটি রুশ স্যাটেলাইট মহাকাশে মার্কিন গোয়েন্দা স্যাটেলাইটের উপর নজরদারি করছে। এর মধ্যে একটি স্যাটেলাইট হলো সেই ‘কসমস ২৫৪৩’, যা নিজের পেটের ভেতর থেকে আরেকটি স্যাটেলাইটের ‘জন্ম’ দেয়। রুশ স্যাটেলাইটগুলো মার্কিন স্যাটেলাইটের খুব কাছে, ১৬০ কিলোমিটারের মাঝে চলে আসে।

মার্কিন জেনারেল জন রেইমন্ড টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘রুশ স্যাটেলাইটের এমন কর্মকাণ্ড খুবই অদ্ভুত এবং বিরক্তিকর।’ তিনি আরও জানান, মার্কিনিরা কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে রুশদের কাছে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তবে রুশ কর্মকর্তারা বার্তা সংস্থা তাসকে বলছেন, এই স্যাটেলাইট ছিল ইন্সপেক্টর স্যাটেলাইট, যার কাজ হলো অন্য রুশ স্যাটেলাইটের টেকনিক্যাল অবস্থা পরীক্ষা করা। 

মহাকাশ গবেষক মাইকেল থম্পসন প্রথমবারের মতো রুশ স্যাটেলাইটের এই কর্মকাণ্ড নিয়ে টুইটারে পোস্ট দেন। তিনি বলেন, রুশ স্যাটেলাইটটি মার্কিন গোয়েন্দা স্যাটেলাইট ‘ইউএসএ ২৪৫’-এর কাছাকাছি কক্ষপথে নিজের অবস্থান নিয়েছে। মার্কিন স্যাটেলাইটটি হলো গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল রেকনাইস্যান্স অফিসের স্যাটেলাইট। ‘কী হোল’ প্রকল্পের অধীন এই স্যাটেলাইটের কাজ হলো- মহাকাশ থেকে ভূমির হাই রেজলিউশন অপটিক্যাল ও ইনফ্রারেড ছবি তোলা। মার্কিন মহাকাশ সংস্থা ‘নাসা’র ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালে মহাকাশে পাঠানো এই স্যাটেলাইটের কর্মকাণ্ড গোপনীয়। ক্রিস পিটের ব্যবস্থাপনায় চলা স্যাটেলাইট মনিটরিং ওয়েবসাইট হেভেন্স এবাভের এক বিশ্লেষণে দেখানো হয়, মার্কিন স্যাটেলাইটটির কক্ষপথ রাশিয়ার পূর্বদিকের শ্বেত সাগর থেকে শুরু করে কৃষ্ণ সাগরের মাঝামাঝি গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোর ওপর দিয়ে যায়। দিনে ১৫ বার এটি পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে।

ডিফেন্স নিউজের এক লেখায় রুশ বিশ্লেষক পাভেল লুজিন বলেন, ‘রাশিয়া মহাকাশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ইউনিয়ন অব কনসার্নড সায়েনটিস্টস জানায়, মহাকাশে অন্তত দুই হাজার ২০০ স্যাটেলাইট রয়েছে, যার মধ্যে এক হাজারের বেশি যুক্তরাষ্ট্রের। তার মধ্যে রয়েছে ১৮৯টি সামরিক স্যাটেলাইট। রাশিয়ার ১৬০টি স্যাটেলাইটের মাঝে সামরিক স্যাটেলাইট প্রায় ১০০। চীনের ৩২০টি স্যাটেলাইটের মাঝে ১০৫টি সামরিক। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের অর্থনীতি স্যাটেলাইটের ওপর যথেষ্টই নির্ভরশীল। তবে রাশিয়ার সামরিক স্যাটেলাইটগুলোর মাঝে ৫১টিই যোগাযোগ স্যাটেলাইট। আর মাত্র ১৬টি হলো ভূমির ছবি তোলার স্যাটেলাইট।

অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের যেখানে রয়েছে ৫৬টি ছবি তোলার স্যাটেলাইট, যোগাযোগ স্যাটেলাইট রয়েছে মাত্র ৪৯টি। চীনের ছবি তোলার স্যাটেলাইট ৫৭টি হলেও যোগাযোগের স্যাটেলাইট মাত্র তিনটি। অর্থাৎ ছবি তোলার স্যাটেলাইট, যেগুলো মূলত ইন্টেলিজেন্সের জন্যে ব্যবহৃত হয়, সেখানেই রাশিয়া প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে আছে।’ লুজিন আরও বলেন, ‘পশ্চিমা অবরোধের কারণে রাশিয়ার জন্য কিছু প্রযুক্তি জোগাড় করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে, যেগুলো মহাকাশে রাশিয়ার পক্ষে যথেষ্টসংখ্যক স্যাটেলাইট রাখাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। এমতাবস্থায় রাশিয়া চাইছে মহাকাশে হুমকি তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনৈতিক দরকষাকষি করতে। রাশিয়া জ্যামিং এবং এন্টি স্যাটেলাইটের মতো প্রযুক্তি ডেভেলপ করতে চাইছে, যেগুলোর উদ্দেশ্য হবে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব স্যাটেলাইটের নেটওয়ার্ক ব্যবহারে বাধা প্রদান করা।’

প্রতিপক্ষের শতশত স্যাটেলাইট টার্গেট করা একটি অর্থহীন কর্মকাণ্ড। ইউনাইটেড ন্যাশনস ইন্সটিটিউট ফর ডিজআর্মামেন্ট রিসার্চের জ্যেষ্ঠ ফেলো গবেষক পাভেল পডভিগ এক সেমিনারে বলেন, ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই এন্টি স্যাটেলাইট ব্যবস্থা ডেভেলপ করতে চেয়েছিল; কিন্তু তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে, এমন ব্যবস্থা ডেভেলপ করে ফলাফল পাওয়া কঠিন। কেননা প্রতিপক্ষ বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে এন্টি স্যাটেলাইটের সফলতাকে কমিয়ে ফেলতে সক্ষম হবে। এরপরও উভয় পক্ষই এন্টি স্যাটেলাইটের প্রযুক্তি একেবারে ফেলে দেয়নি। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ‘এসএম-৩’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে একটি কক্ষপথচ্যুত স্যাটেলাইট ধ্বংস করেছিল। ২০২০ সালের এপ্রিলে রাশিয়ার পরীক্ষা করা ‘নুডল’ এন্টি স্যাটেলাইট ক্ষেপণাস্ত্রও এ ধরনেরই একটি অস্ত্র। তবে মহাকাশ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান সিকিউর ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশনের

পরিচালক ব্রায়ান উইডেনের মতে, বিভিন্ন কারণে কোনো একটি দেশের পক্ষে নিজস্ব স্যাটেলাইট ব্যবস্থাকে আঘাত সহ্য করার মতো করে তৈরি করাটা খুব সহজ হয় না। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর ধরে চেষ্টা করেও তাদের স্যাটেলাইট ব্যবস্থার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। হয়তো এই সুযোগটিই রাশিয়া নিতে চাইছে। বিশেষ করে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের মূল টার্গেট যখন চীন, তখন রাশিয়া তার দিকে যুক্তরাষ্ট্রকে ফেরাতে সবকিছুই করবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

বিষয় : আহমেদ শরীফ

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //