পরিবর্তিত বিশ্ব বাস্তবতা ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন সরবরাহ নিয়ে ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দ্বন্দ্ব এখন বেশ পরিষ্কার। 

ব্রিটিশ-সুইডিশ কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা জানায়, তারা ইইউর কাছে যে পরিমাণ ভ্যাকসিন ২০২১ সালের মার্চের মধ্যে সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা তারা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হচ্ছে না। 

২৬ জানুয়ারি ইতালীয় পত্রিকা ‘লা রিপাবলিকা’র সাথে এক সাক্ষাৎকারে কোম্পানির প্রধান নির্বাহী পাসকাল সোরিঅট জানান, চুক্তি অনুযায়ী ‘সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা’ দেয়ার জন্য কোম্পানির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে নির্দিষ্ট তারিখের মাঝে সব ভ্যাকসিন সরবরাহ করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। 

তবে ইইউ ‘অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র এই বক্তব্য মানতে নারাজ। ইইউর স্বাস্থ্য কমিশনার স্টেলা কিরিয়াকিদেস ২৭ জানুয়ারি সাংবাদিকদের বলেন, কোম্পানির ব্রিটিশ কারখানাগুলো ইইউর সাথে করা চুক্তির অংশ। যেহেতু ব্রিটিশ কারখানাগুলোর সরবরাহ ভালোমতো চলছে, তাই কোম্পানি তার প্রতিশ্রুতি রাখতে বাধ্য। 

পরদিন এক টুইটার বার্তায় তিনি জানান, ইইউ অ্যাস্ট্রাজেনেকার চলমান অস্বচ্ছ সরবরাহ সিডিউল ব্যাতিত। কিরিয়াকিদেস সাংবাদিকদের বলেন, ‘কোম্পানি চুক্তিকে যেভাবে ব্যাখ্যা করছে, তা ভুল ও অগ্রহণযোগ্য। এর সপ্তাখানেক আগে কোম্পানি বলে যে, মার্চের মাঝে তারা তাদের প্রতিশ্রুত আট কোটি ভ্যাকসিনের মাঝে মাত্র তিন কোটি ১০ লাখ সরবরাহ করতে পারবে। কারণ হিসেবে বলা হয়, তাদের বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের কারখানাগুলো সরবরাহ দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এছাড়াও কোম্পানির দুটি কারখানা রয়েছে ব্রিটেনে।’ 

তবে ব্রিটিশ মন্ত্রী মাইকেল গোভ জানান, ইইউর সাথে অ্যাস্ট্রাজেনেকার যে দ্বন্দ্বই থাকুক না কেন, ব্রিটিশ জনগণের ভ্যাকসিন পেতে কোনো সমস্যাই হবে না। তিনি সাংবাদিকদের আরো বলেন, “ব্রিটেনের কাছে ‘পূর্ণ নিশ্চয়তা’ রয়েছে যে, ব্রিটেন তার ভ্যাকসিন ঠিকমতোই পাবে। আর ব্রিটেনের ভ্যাকসিন প্রকল্প সম্পূর্ণ সফল হওয়ার পরই ইইউর দেশগুলোকে সহায়তা দেয়ার কথা আসবে।” 

তিনি আরো জানান, ইউরোপীয় কমিশনের চাপ সত্ত্বেও অ্যাস্ট্রাজেনেকা ব্রিটেনকে নিশ্চিত করেছে- তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রাখবে। ভ্যাকসিন নিয়ে ইইউ ও ব্রিটিশ সরকারের পরস্পরবিরোধী কথাগুলো ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’-এর আলোচনাকে সামনে নিয়ে আসছে, যার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব যথেষ্ট।

ইইউ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ও ভ্যাকসিন প্রকল্প বাস্তবায়নে হিমশিম খাচ্ছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইইউ তার প্রায় ৪৫ কোটি জনসংখ্যার জন্য এখন পর্যন্ত মোট ২৩০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন অর্ডার করেছে। এর মাঝে অ্যাস্ট্রাজেনেকার কাছ থেকে অর্ডার করেছে ৪০ কোটি। 

ইইউ কর্মকর্তারা বলছেন যে, ইইউর কাছ থেকে কোম্পানি যে অর্থ পেয়েছে, তা দিয়েই কোম্পানির ব্রিটিশ কারখানার উন্নয়ন করা হয়েছে। ইইউর সাথে চুক্তিতে বলা হয়েছে, কোম্পানির মূল কারখানা ব্রিটেনে; বেলজিয়াম আর নেদারল্যান্ডসের কারখানাগুলো দ্বিতীয় সারির। অ্যাস্ট্রাজেনেকা ছাড়াও মার্কিন কোম্পানি ফাইজার ও জার্মান কোম্পানি বায়োএনটেকের জয়েন্ট ভেঞ্চার থেকে ইইউ অর্ডার করেছে ৬০ কোটি ডোজ; আর মার্কিন কোম্পানি মডার্নার কাছ থেকে অর্ডার করেছে ১৬ কোটি ডোজ। ফাইজার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মাঝে তারা এক কোটি ২৫ লাখ ডোজ সরবরাহ করবে। কোম্পানির বেলজিয়ান কারখানা সম্প্রসারণের কাজ চলায় তারা সিডিউলে কয়েক সপ্তাহ পিছিয়ে রয়েছে বলে বলছে। 

এর ফলাফল স্বরূপ স্পেন সরকার ২৭ জানুয়ারি ঘোষণা দেয়, ভ্যাকসিনের অভাবে মাদ্রিদ এলাকায় ভ্যাকসিন কর্মসূচি দুই সপ্তাহের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। কাতালোনিয়াতেও ভ্যাকসিন কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইতালি সরকার ইতিমধ্যেই অ্যাস্ট্রাজেনেকার বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছে। অপরদিকে, জার্মান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেন্স স্পাহন ইউরোপীয় কমিশনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন, যাতে ভ্যাকসিন কারখানাগুলো ইইউর যেসব সদস্য রাষ্ট্রের সীমানার মাঝে অবস্থিত, তাদের সরকারের অনুমতি ব্যাতীত যেন ভ্যাকসিন রফতানি করতে না পারে।

অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও ইইউর দ্বন্দ্ব বলে দিচ্ছে, ভ্যাকসিনের কারখানা কোনো দেশের জাতীয় সীমানার মাঝে রয়েছে, তা এখন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু সব দেশের মাটিতে তো কারখানা নেই; বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। 

২৬ জানুয়ারি ‘প্যান আফ্রিকানিস্ট’ সংবাদ সম্মেলনে ধনকুবের বিল গেটস বলেন, মহামারি থেকে উদ্ধার পেতে আরো অনেক ভ্যাকসিন কারখানা চালু করতে হবে ও সব দেশের মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে হবে। গেটস জানান, তিনি বিশ্বের ভ্যাকসিন কারখানাগুলোকে অর্থায়ন করছেন, যাতে করে ভ্যাকসিন ডেভেলপ করা বায়োটেকনলজি কোম্পানিগুলোর ভ্যাকসিন অনেকগুলো কারখানায় তৈরি করা সম্ভব হয়। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটেনের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ডেভেলপ করা ভ্যাকসিন তৈরি করছে ‘অ্যাস্ট্রাজেনেকা’; আর ‘অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র সহায়তা নিয়ে ভ্যাকসিন উৎপাদন করছে ভারতের ‘সিরাম ইন্সটিটিউট’। তবে গেটস বিশ্বের সব স্থানে কারখানা তৈরিকেও আবার সমর্থন করছেন না। 

এক প্রশ্নের জবাবে গেটস বলেন যে, আফ্রিকায় একটা ভ্যাকসিন কারখানা করতে কমপক্ষে পাঁচ বছর সময় লাগবে; কাজেই এটি বরং ভবিষ্যতের কোনো মহামারির প্রস্তুতি হিসেবে দেখা যেতে পারে। বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশেগুলোর বড় কারখানাগুলোর ওপর নির্ভর করা ছাড়া গতি নেই। তিনি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ভ্যাকসিন কারখানার জন্যে ধনী দেশগুলোর বিনিয়োগ প্রত্যাশা করেন। 

ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের গবেষণায় বলা হয়, বিশ্বব্যাপী সব দেশে ভ্যাকসিন প্রকল্প চালু করা না গেলে বিশ্ব অর্থনীতি ৯ হাজার ২০০ বিলিয়ন বা ৯.২ ট্রিলিয়ন ডলার হারাবে। বিল গেটস জানান, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব যেখানে ২৮ হাজার বিলিয়ন বা ২৮ ট্রিলিয়ন ডলার হারিয়েছে, সে তুলনায় ভ্যাকসিনের জন্যে নতুন কারখানার পেছনে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ কিছুই নয়; কিন্তু গেটসের কথায় এটি পরিষ্কার যে, কেউই আসলে এই মুহূর্তে আফ্রিকার মতো উন্নয়নশীল অঞ্চলে ভ্যাকসিন কারখানার কথা চিন্তা করছেন না। আর অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোন কারখানা কোন দেশে অবস্থিত, তা যখন ব্রিটেন ও ইইউএর মাঝে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করছে; তখন আফ্রিকাসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ভ্যাকসিন কারখানা তৈরি করাটা অবাস্তবই শোনাবে। 

‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’-এর এই পরিস্থিতি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যাবস্থায় আদর্শ নয়, বরং জাতীয় স্বার্থই সকল সিদ্ধান্তের কেন্দ্রবিন্দুতে। একইসাথে মানুষের জীবন নয়, বরং বিশ্ব অর্থনীতির ওপর প্রভাবই জাতীয় সিদ্ধান্তের পেছনে মূল প্রেরণা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //