মার্কিন মিডিয়ায় উপেক্ষা ফিলিস্তিনি সাংবাদিক হত্যার বিষয়

রায় হানানিয়া একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘শিকাগো সিটি হল’ এর রাজনৈতিক প্রতিবেদক ও কলাম লেখক। হানানিয়া প্রতি সপ্তাহে তিনটি কলাম লেখেন, একটি মধ্যপ্রাচ্যের ইস্যুতে ও দুটি মূলধারার আমেরিকান ইস্যুতে। তাঁর মধ্যপ্রাচ্যের কলামগুলো আরব নিউজ পত্রিকায় সাপ্তাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। অন্যদুটি লেখা ছাপা হয় SuburbanChicagoland.com ও Patch.com এ। ৬ মার্চ প্রকাশিত তার বর্তমান লেখাটি আরব নিউজ থেকে ভাষান্তর করেছেন- মহিউদ্দীন মোহাম্মদ

ফিলিস্তিনি সাংবাদিক সিন্ডিকেট গেল বছর জানিয়েছিল যে ইসরাইল গত দুই দশকে ৪৬ জন সাংবাদিককে হত্যা করেছে। অন্যদিকে সাংবাদিক সুরক্ষা কমিটি বলেছে, ইসরাইল ও অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে গত ২৮ বছরে নিহত হয়েছেন ১৮ জন সাংবাদিক। কেউ হয়ত জিজ্ঞেস করতে পারেন, আসল চিত্র কোনটি? তার আগে এ সত্যটিই জিজ্ঞেস করা উচিত, কেন তারা কাউকে তোয়াক্কা করে না?

আমেরিকার মূলধারার সংবাদমাধমের কেউই অনুসন্ধান করছে না- কেন ইসরাইলি সামরিক বাহিনী সাংবাদিককে হত্যা করছে। মনে হচ্ছে এখানে রাজনীতি আছে। মার্কিন গণমাধ্যমে এ জাতীয় খবর প্রচারের কোনো সম্ভাবনা নেই, তার কারণ তারা ইসরাইলি প্রোপাগান্ডার ভয় পায়।

আমেরিকাতে ইসরাইলের সমালোচনাকে কার্যত ইহুদিবাদবিরোধী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র দুই ডজনেরও বেশি আইন পাশ করেছে-যার প্রতিপাদ্য হচ্ছে, পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরের নাগরিকদের কাছ থেকে জমি ও সম্পদ গ্রহণের জন্য যারা তাদের বয়কট করবে; তাদের শাস্তি প্রদান।

তাছাড়া মার্কিন কংগ্রেস এমন একটি আইন প্রবর্তন করতে চাইছে, যারা ইসরাইলকে বিদেশে বয়কট করবে তাদের বিরুদ্ধে। এর ফলে অধিকাংশ মিডিয়া হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি বেমালুম ভুলে যেতে পছন্দ করে।

এই সাংবাদিকদের মৃত্যুর ঘটনা নথিভুক্ত করারও অসুবিধা রয়েছে। কারণ ইসরায়েলি সরকার ও সামরিকবাহিনী প্রচারের বিষয়ে মিডিয়ার ওপর সেন্সর আরোপ করে। আর স্থানীয় সাংবাদিকদের মধ্যে অনেক ইসরাইলি রয়েছে, যারা তাদের দেশের জন্য সহানুভূতি দেখায়।

একজন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক খুন হলে তার জন্য ইসরাইলি প্রোপাগান্ডা মেশিনগুলো ফিলিস্তিনিদের দায়ী করে। সেক্ষেত্রে নিরপেক্ষ তথ্য পাওয়া আরো কঠিন এজন্য যে ইসরাইলের পছন্দসই সাংবাদিক ছাড়া কোনো নিউজ কাভার করার অনুমতি নেই। এ খবর ওয়াশিংটন পোস্ট বা নিউইয়র্ক টাইমসের কাছেও কোনো গুরুত্ব বহন করে না।

অ্যাসোসিয়েট প্রেস (এপি) এর মত বড় পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে কাজ করলেও ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বিভাগ কোনো গুরুত্ব দেয় না। তারা সক্রিয় থাকে যাতে কোনো ভাবেই সঠিক সংবাদ না বের হয়। ২০০৩  সালে অ্যাসোসিয়েট প্রেসের ক্যামেরাম্যান নাজিহ দারওয়াজেহকে নাবলুসে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী খুন করে। সামরিক বাহিনী যে হত্যা করেছে এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ।

২০১৮ সালের এপ্রিলে দুই ফিলিস্তিনি ফটো সাংবাদিক ইয়াসির মুর্তাজা ও আহমেদ আবু হুসেইন ইসরাইলি স্নাইপারদের হাতে খুন হন। সে সময় বলা হয়, গাজায় বিক্ষোভকারী ও সৈন্যদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে তাদের মৃত্যু হয়েছে।

তখন ইসরাইলি গণমাধ্যমগুলো সেসময়ের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাভিগডর লিবারম্যানের মন্তব্য ছড়িয়ে দিয়েছিল-  ‘গাজার প্রত্যেকেই সন্ত্রাসবাদী।’ ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন মুখপাত্র বলেছিলেন, মৃত্যুর বিষয়টি তদন্ত করা হবে। তবে কোনো তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ্যে আসেনি। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, কয়েকটি গণমাধ্যম দাবি করে, এ ঘটনায় ইসরাইলকে জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু মার্কিন কংগ্রেসের কেউই তদন্তের আহ্বান জানান নি। হত্যার বিষয়টি নিত্যদিনকার অন্যান্য ঘটনার মধ্যে হারিয়ে যায়।

এই অবহেলা একটা অস্পষ্টতা তৈরি করেছে, এধরণের ঘটনার সাথে কারোর দায়বদ্ধতা নেই! এর কারণ কী? কারণ বা অজুহাত হতে পারে একটাই- রাজনীতি ও বিদেশ নীতি। মুরতাজা বা আবু হুসেইনের অপরাধটা কী? উপসাগরীয় দেশগুলোর বিরুদ্ধে ওয়াশিংটন পোস্টের রাজনৈতিক এজেন্ডা, তেলের রাজনীতি বা অস্ত্র বিক্রিতে ইসরাইলের বিরোধিতাকে রুখে দিতে কলাম লিখেন নি। তারা কেবল সাংবাদিকতার জায়গা থেকে নৃশংসতা রেকর্ড করার চেষ্টা করেছিল। আর এ সত্য জানাতে চেয়েছিল বিশ্বের তাদেরকে যারা এটা শুনতে অনিচ্ছুক ছিলো।

২০১৮ সালের নভেম্বরে বেথেলহেমের দিশেহে শরাণার্থী শিবিরের একজন ফ্রিল্যান্সার ফটোগ্রাফার মুয়াজ অমরনেহ, হেব্রনের কাছে তার চোখে ইসরাইলের একজন স্নাইপার গুলি করেছিল। হয়ত তিনি বেঁচে আছেন।

এখানে যাদের কথা বলা হয়েছে এই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা বড় বড় অক্ষরে ‘প্রেস’ শব্দ লেখা পোশাক পরে ছিলেন। যেকোনো স্নাইপার ট্রিগার চাপার আগে উচ্চশক্তি সম্পন্ন যন্ত্রের সাহায্যে তাদের দিকে তাকিয়ে দেখে থাকতে পারেন, ক্ষতিগ্রস্তরা কোনো অস্ত্র বহন করছিল না।

এমন অনেক নিহত ও আহতের ঘটনা রয়েছে যার সব বিবরণ এখানে দিতে পারিনি। এমন খুব কম লোক রয়েছে যারা ইসরাইলের কড় সেন্সরশিপ উপেক্ষা করে সবার ওপর প্রতিবেদন তৈরি করতে পেরেছে।

ইসরাইলের রয়েছে একটি লোহার মুষ্টি, যা দিয়ে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক, অ্যাক্টিভিস্ট ও সাংবাদিকদের জীবন কেড়ে নেওয়ার সাথে সাথে নেতিবাচক তথ্যকে আক্রমণাত্মকভাবে শ্বাসরোধ করে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //