পোপের আকস্মিক ইরাক সফর কেন?

মার্চের শুরুতে পোপ ফ্রান্সিস ইরাকের নাজাফ শহরে গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ আলী আল-সিস্তানির সাথে সাক্ষাৎ করেন। ক্যাথলিক খ্রিস্টান ও শিয়া মুসলিমদের আধ্যাত্মিক দুই প্রধানের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় বৈঠক। তবে সিস্তানির সাথে পোপের এই সাক্ষাৎ সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় ইরাকি রাষ্ট্রের কাঠামোগত ব্যর্থতার স্বীকৃতিও বটে।

পোপ ফ্রান্সিস এবং সিস্তানির মধ্যে নাজাফে বৈঠককালে মিডিয়ার কোনো সদস্য উপস্থিত ছিলেন না। পরে অবশ্য গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ সিস্তানি একটি বিবৃতি দিয়ে জানান, সংবিধান সম্মতভাবে খ্রিস্টান নাগরিকদের শান্তি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে। 

পোপের এই সফরকে সফল হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু পোপ কি শুধুই তার সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও ইরাকে শান্তির বার্তা নিয়ে গিয়েছিলেন? 

২০০৩ সালের মার্কিন আগ্রাসনের পর থেকে চলমান অস্থিরতার কারণে অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতিতে পড়েছিল ইরাক। 

পোপের সাথে দেশের সিনিয়র শিয়া আলেম গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ আলী আল-সিস্তানির সাথে দেখা করার কারণে পুরো ইরাকজুড়ে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়। নাজাফ শহর বন্ধ করে দেয়া হয়। বিশ্লেষকদের ধারণা, এই সফরে ইরাকি কোষাগার থেকে কয়েক মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়েছে। আর এটা এমন সময় করা হয়েছে যখন দেশটি নাগরিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে।

ইরাকি শাসকরা পোপকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করেছেন। অভ্যর্থনা কমিটিতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সব মন্ত্রী ও রাজ্য কর্মকর্তারা ছিলেন। এই সফরের কারণে পোপ তার পূর্বনির্ধারিত দক্ষিণ আমেরিকা সফর বাতিল করেন।

ফলে এটি স্পষ্ট হয়েছে — এ সফর শুধু তার সম্প্রদায়কে রক্ষার জন্য নয়। এর মধ্যে আলাদা রহস্য রয়েছে। ইরাকে মাত্র ৪ লাখ খ্রিস্টানের বসবাস ছিল, যার অধিকাংশ মার্কিন আগ্রাসনের পর দেশ ত্যাগ করেছে। ফলে এই সফরের মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে।

ধারণা করা হচ্ছে, তিনি অন্য কোনো দেশের রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে এসেছিলেন।

যদিও মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত তিনটি গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি বজায় রাখার বাণী দিয়েছেন। পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানরা সবাই ইব্রাহিমের সন্তান।

অবাক করা বিষয় হচ্ছে- এই প্রথম কোনো ক্যাথলিক পোপ ইসলামকে ঐশ্বরিক ধর্মের স্বীকৃতি দিয়েছেন। অথচ তাঁর পূর্বসূরিরা মুসলমানদের শুধুমাত্র মুহাম্মদের অনুসারী বলে বিবেচনা করেন। তাদের দাবি, মুহাম্মদ নিজে ধর্মগ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি কোনো ঐশ্বরিক বাণী লাভ করেননি।

পোপ ফ্রান্সিস ধর্মীয় ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে মধ্যস্থতার ভূমিকায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্গঠন করতে সহায়তা করেছেন। তাছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকার শরণার্থী সংকটের বিষয়েও সম্পৃক্ত হয়েছেন। 

ফরচুন ম্যাগাজিন তাকে বিশ্বের ৫০ জন সেরা নেতার তালিকায় এবং ফোর্বস তাকে বিশ্বের চতুর্থতম ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে স্থান দিয়েছে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক থেকে বর্তমান বিশ্বের চতুর্থ শক্তিধর ব্যক্তিটি আসলে কী চান? প্রত্যাশার ডানা বিস্তার করে এমন একটি দেশে পোপ গেছেন, যাদের কারণে ভ্যাটিকান এক সময় তটস্থ থাকত। 

মার্কিনরা যখন লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে এবং তার সম্পদ লুণ্ঠন করে তখন তিনি কথা বলেননি। এখনো যখন ইরাকের কেন্দ্রে অবস্থান করছিলেন পোপ, তখনো তিনি মার্কিন দখলদারিত্বের নিন্দা করেননি।

বিগত আঠারো বছরে ইরাকে গণহত্যা ও নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ব্যাপারে কোনো কথা না বলে কীভাবে তিনি প্রত্যাশা করেন সদাচারের? 

বাগদাদের পতনের পর ইরাককে শাসন করার জন্য ওয়াশিংটন নিযুক্ত করেছিল পল ব্রেমারকে। তিনি তার 'My Year in Iraq' বইতে শিয়া সম্প্রদায় ও সিস্তানির প্রতি সমর্থন বজায় রাখা এবং ইরানের সাথে শিয়া জোট বাহিনীকে বাদ দেয়া সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছেন। শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে সিস্তানির ভূমিকা ক্যাথলিকদের জন্য পোপের মতো। তিনি প্রতিদিনের রাজনৈতিক বিষয় পরিচালনা করেন না, তবে তিনি অনুগতদের সাথে ব্যক্তিগত আলোচনা এবং কর্তৃত্বমূলক ধর্মীয় মতামত প্রকাশের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করেন।

ইরাকে সিস্তানির রাজনৈতিক ভূমিকার অনেক উদাহরণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি- গেল বছর প্রধানমন্ত্রী আদিল আবদুল মাহদীর পদত্যাগের বিষয়। সংগ্রামীদের হত্যার অভিযোগে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন।

বলাবাহুল্য, সিস্তানি ইরাকের রাজনীতিকে নতুন রূপ দিতে সহায়তা করেছেন। রাজনীতিক ও জনগণের পাশাপাশি দেশটির পরিচালকদের মধ্যেও তার প্রভাব রয়েছে — এমন দাবি পল ব্রেমারের।

এখন প্রশ্ন হলো — কেন পোপ ফ্রান্সিস সিস্তানির সাথে সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে ইরাক সফর শুরু করেছিলেন? এটি কি শুধুই তার রাজনৈতিক অবস্থান, নাকি অন্য দেশের বার্তা নিয়ে এসেছেন?

পোপের এই সফরকে স্বাগত জানিয়েছে ওয়াশিংটন। ইরাকে দুই সপ্তাহেরও কম সময়ে মার্কিন বাহিনীর ওপর দুটি হামলার পর পোপের সফরে ওয়াশিংটনের যোগসূত্র মিলছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //