করোনার সামাজিক পূর্বাভাসের প্রভাব নিয়ে সবই ভুল ছিল

করোনাভাইরাসের মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে অনেকেই মনে করেছিলেন তাদের জীবন এখন পুরোপুরি বদলে যাবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, জনপ্রিয় প্রকাশনায় ও বিশেষজ্ঞদের লেখা- সর্বত্রই ‘নিউ নর্মাল’ জীবন নিয়ে আলোচনা চলতে দেখা যায়। 

তবে বাস্তবে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা অথবা ঘরে বসে অফিস ও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের চিন্তাধারা ও ব্যবহারিক জীবনে কভিড-১৯ কতটা পরিবর্তন আনতে পেরেছে? 

হতাশা ও একাকীত্ব বেড়েছে অথবা সাধারণ মানুষের মধ্যে ধৈর্যশীলতা ও গ্রহণযোগ্য আচারণ কি বেড়েছে? দম্পতিরা আরো বেশি সময় একসাথে কাটানোর ফলে কি তাদের সম্পর্কে চিড় ধরেছে? মানিয়ে নিতে বাধ্য হওয়ার কারণে মানুষজন কি সাংস্কৃতিক পরিবর্তন নিয়ে আরো উদার হতে পেরেছে কি-না? তারা ঐতিহ্য ও আচার-অনুষ্ঠান থেকে পিছিয়ে পড়ছে? 

অনিশ্চয়তার দিনগুলোয় বিজ্ঞজন, রাজনীতিবিদ ও সেলিব্রেটিদের বিভিন্ন বিষয়ে পূর্বাভাস ও সেগুলোর সমাধান দিতে দেখা যেত। সামাজিক বিজ্ঞানীদেরও এমনটা করতে দেখা যায়। এসব পূর্বাভাস কতটা মিলেছে ও করোনা মহামারি মানুষের জীবন আচরণে কেমন প্রভাব ফেলেছে, তা জানতেই গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়। 

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে পরিচালিত এ গবেষণায় পুরো বিশ্বের ১৫ হাজার অংশগ্রহণকারী যুক্ত ছিলেন। গত এপ্রিলের শুরুর দিকে বড় পরিসরে এর কাজ শুরু হয়। সামাজিক ও আচরণগত বিজ্ঞানীদের (সামাজিক ও চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী, মতামত ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ, স্নায়ুবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বোদ্ধা) কভিড-১৯ নিয়ে দেয়া পূর্বাভাস যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মানসিক ও আচরণগতভাবে কতটা প্রভাব ফেলেছে, সে বিষয়ে জানার চেষ্টা করা হয়। এর ছয় মাস পর এই পূর্বাভাসগুলোর যথার্থতা মূল্যায়ন করা হয়। 

আমরা এই প্রতিবেদনটির মাধ্যমে বুঝতে পারি- অনেক বিশেষজ্ঞই মহামারির প্রথম দিনগুলো সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেননি। এখান থেকে আমরা আরো বুঝতে পারি যে, পরবর্তীতে এ ধরনের কঠিন সময়ের জন্য আমরা এখান থেকে কী শিক্ষা নিতে পারি? 

করোনা মহামারির প্রথম দিনগুলোতে চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘হাত ধৌত করুন, মুখ স্পর্শ করবেন না ও মাস্ক ব্যবহার করবেন।’ মহামারির মূল সত্য স্বীকার করতে না চাওয়া চীন এ বিষয়ে ভুল তথ্য দেয়ার কারণে উপদেশও এমন ছিল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ভেবেছিলেন মহামারি প্রতিরোধে তাদের কাছেই বিশ্বসেরা ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের এই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের ফলে পাঁচ লাখ আমেরিকানকে করোনায় প্রাণ দিতে হয়েছে। 

সুতরাং কভিড কীভাবে মানুষের মানসিকতাকে পরিবর্তন করেছে? বরং আশ্চর্যজনকভাবে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, ধারণার চেয়েও তা কম পরিবর্তিত হয়েছে। যদি সবার মধ্যে একাকীত্ব বেড়েও থাকে, তবে এর পরিমাণও অনেক কম। সম্পর্ক নিয়ে মানুষের সন্তুষ্টি কমেছে, তবে এখানেও সংখ্যা অনেক কম। গত বছরের মার্চে মানুষের এই সন্তুষ্টি নাটকীয় হারে পরিবর্তনের যে আভাস দেয়া হয়েছিল, বাস্তবে তার দেখা মেলেনি। এছাড়া মানুষের সামাজিক প্রণোদনামূলক কাজ সম্বন্ধে করা অথবা মর্যাদা অর্জন, পার্টনার খোঁজা অথবা পরিবারের যত্ন নেয়ার মতো বিষয়গুলোতেও অল্প-স্বল্প পরিবর্তন এসেছে। শুধু সংক্রামক মহামারি এড়াতে দেয়া প্রেরণাদায়ক মন্তব্যগুলোই মহামারি-পূর্ব অবস্থা থেকে অর্থবহ পরিবর্তন দেখা গেছে। 

এই জরিপের ফলাফল অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল। এ দলে মানব আচরণ ও সামাজিক গতিশীলতা বিষয়ক বিশেষজ্ঞও রয়েছেন, যাদের পূর্বাভাসগুলো মূলত ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছিল। অন্যদিকে অংশগ্রহণকারীদের ধারণার চেয়েও মানব আচরণ ও মানসিকতায় জড়তা লক্ষ্য করা গেছে। শুধু সহিংস অপরাধ সংগঠনের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা গিয়েছে। কয়েক মাসের ব্যবধানে যা ২০ শতাংশ বেড়েছে। অবশ্য এটি এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে পূর্বাভাসগুলো খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি। 

জরিপগুলোয় কোনো ভুল হয়েছে কি-না, তা বোঝার জন্য অক্টোবরের শেষ ও নভেম্বরের শুরুর দিকে পুনরায় সামাজিক ও আচরণগত বিজ্ঞানী ও জনমানুষদের থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় কভিড-১৯-এর কারণে গত ছয় মাসে তারা কতটি পরিবর্তন অনুভব করছেন। মজার ব্যাপার হলো, দেখা যায় এ জরিপের ফল পূর্ববর্তী অনুমানের প্রায় সমপর্যায়ের। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে বোধোদয় সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ ও বিশেষজ্ঞরাও কভিডের প্রভাবসমূহ সম্পর্কে ভুলভাবে উপস্থাপন করছে। সবচেয়ে সহজ কথা যেকোনো বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন, এমনকি এ বিষয়টি বিশেষজ্ঞদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। 

ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার অধ্যাপক ও কানাডা বংশোদ্ভুত মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফিলিপ টেটলক বলেছেন, বিশেষজ্ঞরা সাধারণত ভূরাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে খুব দুর্বল পূর্বাভাস দিয়ে থাকেন, তাদের এ পূর্বাভাস ময়লা ছোড়া শিম্পাঞ্জির লক্ষ্যের তুলনায় খুব কম সময়ই মিলে যায়। 

এর পেছনের কারণ হিসেবে বেশ কিছু বিষয় চিহ্নিত করেছেন টেটলক। এর মধ্যে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও মূল হার এড়িয়ে যাওয়া অন্যতম। মূলত অতীতে কীভাবে একইরকম ঘটনা সম্পন্ন হয়েছে, তারপরও ভিত্তি করেই বিশেষজ্ঞরা এই পূর্বাভাস দিয়ে থাকেন। 

ইসরায়েলের মনস্তত্ববিদ ও অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল কাহনেম্যান ও তার সহকর্মীরা দুর্বল পূর্বাভাস দেয়ার পেছনে বেশ কিছু পক্ষপাতমূলক কারণকে তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে বর্তমানের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া, দ্রুত কোনো বিষয়ে মতামত দেয়া ও নতুন কোনো প্রমাণের ব্যাপারে খুব ধীরে মন পরিবর্তন করা। আর এসব কারণে কি আমরা আচরণগত ও সামাজিক বিজ্ঞানীদের উপদেশ এড়িয়ে যাব? না। কারণ এসব ক্ষেত্রে সফল থিওরি ও গবেষণার অগণিত উদাহরণ রয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //