করোনার উৎস সন্ধান

চীন থেকে ঘুরে যেতে পারে অন্য দিকে

বিশ্বের বিপজ্জনক একটি ভাইরাসের নাম করোনা (কভিড-১৯)। ভাইরাসটি বিশ্বব্যাপী আতঙ্কের নাম হলেও এটি প্রথম কোথা থেকে এবং কীভাবে ছড়িয়েছে, তা এখনো বিজ্ঞানীদের বিস্ময়। 

ভাইরাসটি উহানের গবেষণাগারে তৈরির অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিরা। তাদের অভিযোগের আঙ্গুল চীন থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। খুব শিগগিরই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই প্রতিনিধিরা চীন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে তাকাবেন। তারা এসব দেশ সফর করার চেষ্টা করবেন ভাইরাসটির উৎস সন্ধানে। 

চীনের সঙ্গে কয়েক মাসের আলোচনার পর গত জানুয়ারিতে করোনাভাইরাসের উৎস খুঁজতে উহানে যায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তদন্ত দলটি। তাদের কর্মকা-ের ওপর বিশেষ নজরও রেখেছিল চীনা কর্তৃপক্ষ। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনকে বিলম্বিত ও অসম্পূর্ণ উল্লেখ করে উদ্বেগও জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৪টি দেশ।

চীনের শীর্ষ ভাইরাস গবেষণাগারগুলোর মধ্যে অন্যতম উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলোজি থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে বলে একটি তত্ত্ব ছড়িয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম এই তত্ত্বের কথা জানান। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টরের অফিস থেকে বলা হয়েছিল, ‘ভাইরাসটি মানবসৃষ্ট, জেনেটিকেলি মোডিফায়েড। কোনো প্রাণী থেকে মানবদেহে এসেছে, না-কি ল্যাবরেটরি দুর্ঘটনা থেকে ছড়িয়েছে তা তদন্ত করা হচ্ছে।’ 

ভাইরাসটি যেহেতু প্রথম চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে ছড়িয়েছে, সে কারণে বিজ্ঞানীদের অনেকেই সন্দেহ পোষণ করছেন যে, নতুন কিন্তু অদ্ভূত বৈশিষ্ট্যের এই ভাইরাসটি উহানের গবেষণাগার থেকেই ছড়িয়েছে। তারা সন্দেহ করছেন যে, ভাইরাসটি গবেষণাগারে তৈরি একটি কৃত্রিম ভাইরাস। ‘চীনারা জীবাণু অস্ত্র তৈরির উদ্দেশ্যে নতুন নতুন জীবাণু তৈরির কাজ করতে গিয়ে অসাবধানতা বশত ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে’- এমন ভাবনা রয়েছে বিশ্বের অনেক মানুষের মধ্যে। এমনকি অনেক বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিশেষ করে আমেরিকান ও ইউরোপিয়ানদের মধ্যে এমন ধারণা রয়েছে। কেউ কেউ অভিযোগও করেছেন চীনাদের বিরুদ্ধে এবং ভাইরাসটির উৎস অনুসন্ধানে কাজ করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওপর চাপ তৈরি করা হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত বছর থেকে উহানের ওই ল্যাব পরিদর্শনে যাওয়ার আবেদন করলেও, অনেক দিন চীনা সরকার নানা অজুহাত দেখিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞদের চীনে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। তবে সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে পরিদর্শনে যাওয়ার অনুমতি দিলে একদল বিশেষজ্ঞ উহানে গিয়ে ওই গবেষণাগার ও চারপাশটা ঘুরে দেখে প্রতিবেদন জমা দেন ফেব্রুয়ারিতে।

করোনাভাইরাস চীনের গবেষণাগার থেকে ছড়ানোর তত্ত্বটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই প্রতিনিধি দল বাতিল করে দিয়েছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মিশন প্রধান পিটার বেন এমবারেক সংবাদ মাধ্যমকে জানান, উহান শহরের ল্যাব থেকে ভাইরাসটি ছড়ানোর ‘সম্ভাবনা নেই বললেই চলে’। তিনি আরও জানান, ভাইরাসের উৎস শনাক্ত করতে আরও কাজ করতে হবে।’ ২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরেই প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এরপর থেকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসে গত ৫ এপ্রিল পর্যন্ত ১৩ কোটি ২৪ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং ২৮ লাখ ৭৪ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ডা. এমবারেক এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ‘অনুসন্ধানে নতুন তথ্য পাওয়া গেছে। তবে নাটকীয়ভাবে এই প্রকোপের চিত্র পাল্টে দেবে এমন কিছু পাওয়া যায়নি।’ বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মানুষের শরীরে ছড়ানোর আগে ভাইরাসটি অন্য কোনো প্রাণী থেকে এসেছে। তবে কীভাবে এটি ঘটেছে, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত নন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মিশন প্রধান ড. এমবারেক জানান, “বর্তমান করোনাভাইরাসের উৎস খুঁজতে গিয়ে বাদুড়ের কোনো ‘প্রাকৃতিক সংরক্ষণাগার’ থেকেই এই ভাইরাস ছড়িয়েছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তবে তা উহানে হওয়ার সম্ভাবনা কম। অন্য কোনো প্রাণী থেকে মানবদেহে ভাইরাসটি সংক্রমিত হয়েছে কি-না, তা বের করতে এখনো অনেক কাজ বাকি। তবে মধ্যবর্তী কোনো প্রজাতি থেকেই মানবদেহে ভাইরাসটি ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি।” দলটি বলছে, ভাইরাসটি প্রাণী থেকে মানুষে ছড়াতে পারে। এক্ষেত্রে বাদুড় ও প্যাঙ্গোলিনের (বন রুই) মাধ্যমে ছড়ানোর সম্ভাবনা আছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো শক্ত প্রমাণ মেলেনি। করোনার উৎস নিয়ে অনুসন্ধান চলতে থাকবে বলে জানান তারা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ দলের এক সদস্য বলেছেন, অনুসন্ধানের জন্য এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে মনোনিবেশ করা যেতে পারে। হিমায়িত খাবার পরিবহন ও ব্যবসার দিকে ইঙ্গিত করে বিশেষজ্ঞ দলটির এক সদস্য বলেন, এই ‘কোল্ড চেইন’ ধরে ভাইরাসটি সংক্রমণের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই দলের একজন সদস্য ড. পিটার দাজাক বলেন, কোভিড-১৯-এর উৎস খুঁজতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অঞ্চলগুলোতে অনুসন্ধানে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।

তিনি সংবাদ মাধ্যমকে জানান, তারা চীনে অনেক কাজ করেছেন এবং কভিড-১৯ ছড়ানোর মানচিত্র থেকে দেখা যায় যে, এর সংক্রমণের চিত্রটি সীমান্তের দিকে ইঙ্গিত করছে এবং জানি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পুরো অঞ্চলের দিকেই বিশেষজ্ঞরা খুব কম মনোযোগ দিচ্ছেন। ড. পিটার আরও জানান, ‘চীন একটি বেশ বড় দেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াও বেশ বড়। হুনান সামুদ্রিক প্রাণীর বাজারের সরবরাহ চেইন বেশ বিস্তৃত। বিভিন্ন দেশ থেকে সেখানে পণ্য আসতো। চীনের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও আসতো। তাই করোনার উৎস খুঁজে বের করতে হলে আরও কিছু কাজ করতে হবে। এখন সেই সরবরাহ চেইনের দিকেই মনোযোগ দিতে হবে।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তদন্ত দলের প্রধান ড. এমবারেক জানান, তদন্তকালে গবেষণাগার ঘুরে দেখা গেছে, সেখান থেকে কোনো কিছু ‘বের হওয়ার কথা না’। দলটি সেখানকার মাছ, মাংস ও জীবন্ত বন্য প্রাণী ও সামুদ্রিক প্রাণী বিক্রি করার বাজার অনুসন্ধান করেছেন বলে জানান ওই বাজার থেকেই প্রথম মানবদেহে সংক্রমণ ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বিশেষজ্ঞরা জানান, ‘২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সেখানে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার সরকারি ঘোষণার আগেই উহানজুড়ে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছিল’- এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। চীনের স্বাস্থ্য কমিশনের বিশেষজ্ঞ লিয়াং ওয়ানিয়ান বলেছেন, উহানে শনাক্ত হওয়ার আগে কোভিড-১৯ অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকতে পারে। 

চলতি বছরের জানুয়ারিতে করোনার উৎস অনুসন্ধানে উহানে যায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি বিশেষজ্ঞ দল। ১৭ সদস্যের এই বিশেষজ্ঞ দল চার সপ্তাহ চীনে অবস্থানের পর করোনার উৎস সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। উহানের একটি গবেষণাগার থেকেই বিশ্বব্যাপী করোনা ছড়িয়েছে বলে গত বছর প্রথম অভিযোগ করে যুক্তরাষ্ট্র। অবশ্য চীন অভিযোগের পর পরই তা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে। 

করোনার উৎস সন্ধানে জোরালো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে বিশেষজ্ঞ দলের প্রতি আরও গবেষণার দাবি জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেডরোস আধানম গেব্রিয়েসুস। এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘বিশেষজ্ঞ দলের এ মূল্যায়ন পর্যাপ্ত বলে মনে করছি না। গবেষণাগার থেকে করোনা ছড়ানোর অনুমানকে সবচেয়ে কম সম্ভাব্য কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে দলটি। নিশ্চিত সিদ্ধান্তে যেতে আরও অনুসন্ধানের দরকার। এ জন্য আরও বিশেষজ্ঞ নিয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাতে আমি প্রস্তুত।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকের বক্তব্যের সমালোচনা করেছে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //