করোনা : জীবনরক্ষায় যুগান্তকারী নতুন চিকিৎসা উদ্ভাবন

হাসপাতালে ভর্তি কোভিড-১৯ আক্রান্ত গুরুতর রোগীদের মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে পারে- এমন নতুন একটি জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসার পথ খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা।

তবে বেশ ব্যয়বহুল এই চিকিৎসায় রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে জোরদার করার বদলে স্যালাইনের মাধ্যমে শক্তিধর অ্যান্টিবডি মানবদেহের শিরায় ঢুকিয়ে দেয়া হয় যা ভাইরাসকে পরাস্ত করতে পারে। এই চিকিৎসায় খরচ পড়ে এক হাজার থেকে দুই হাজার ডলার।

হাসপাতালের পরীক্ষায় দেখা গেছে, কোভিডে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে প্রতি তিনজনের একজন এতে সুস্থ হয়ে উঠেছে। এই চিকিৎসা দিয়ে করোনায় আক্রান্ত প্রতি ১০০ জন সাধারণ রোগীর মধ্যে ছয়জনের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে বিশেষজ্ঞরা হিসেব করে দেখেছেন।

যেসব রোগীর দেহে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো যথেষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি হয় না শুধু তাদেরই এই চিকিৎসা দেয়া হয়। তবে যাদের শরীরে প্রাকৃতিকভাবে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যায়, তাদের বেলায় এই চিকিৎসা পদ্ধতি কতটা কার্যকর তা এখনো বোঝা যায়নি। 

গতকাল বুধবার (১৬ জুন) যুক্তরাজ্যের এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়, হাসপাতালে ভর্তি কোভিড-১৯ আক্রান্ত ওইসব রোগী যাদের শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তাদের বেলায় অ্যান্টিবডি ‘দারুণ কার্যকর’ প্রমাণিত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ কোম্পানি রেজেনেরন ফার্মাসিউটিক্যাল ও সুইজারল্যান্ডের রোশের তৈরি অ্যান্টিবডির মিশ্রণকে বলা হচ্ছে রেজেন-কোভ। এর চূড়ান্ত ধাপের ট্রায়ালের ফলে দেখা গেছে, এই থেরাপি কোভিড-১৯ রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি এবং হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকিও ৭০ শতাংশ কমাতে পারে।

কিম্বারলি ফেদারস্টোন এই চিকিৎসার মেডিকেল ট্রায়ালে অংশ নিয়েছিলেন। ছবি : বিবিসি

গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের বেলায় এটি অনেক বেশি কার্যকর হয়েছে। ২৮ দিনের বেশি সময় ধরে হাসপাতালে ভর্তি কোভিড-১৯ রোগী, যাদের শরীরের নিজস্ব অ্যান্টিবডি রোগ প্রতিরোধে সাড়া দিচ্ছে না (সেরোনেগিটিভ রোগী), তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি একপঞ্চমাংশ কমাতে পারে এই অ্যান্টিবডি থেরাপি।

যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ কোভিড-১৯ আক্রান্ত মৃদু থেকে মাঝারি উপসর্গ আছে এমন ব্যক্তিদের বেলায় এই চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহারের জরুরি অনুমোদন দিয়েছে।

৩৭ বছর-বয়সী কিম্বারলি ফেদারস্টোন এই চিকিৎসার মেডিকেল ট্রায়ালে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমার ভাগ্য ভাল যে করোনা হওয়ার পর আমাকে যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ততদিনে এই পরীক্ষা চালু হয়ে গিয়েছিল এবং এই যুগান্তকারী পরীক্ষাটিতে আমি অংশ নিতে পেরেছিলাম।

এই চিকিৎসার নাম মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ট্রিটমেন্ট। এর ওষুধ করোনাভাইরাসের কোষকে ঘিরে ধরে। এর ফলে দেহের অন্য কোন কোষে করোনাভাইরাস আর সংক্রমিত হতে পারে না এবং সংখ্যায়ও বাড়তে পারে না। ব্রিটেনের বিভিন্ন হাসপাতালের প্রায় ১০ হাজার করোনা রোগীর ওপর এই চিকিৎসার পরীক্ষা চালানো হয়।

এর ফলাফলে দেখা গেছে- এতে মৃত্যুঝুঁকি অনেক কমেছে; হাসপাতালে চিকিৎসার সময়, যা গড়ে চারদিন, সেই সময়ও কমে এসেছে এবং ভেন্টিলেটর ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তাও কমানো সম্ভব হয়েছে।

এই চিকিৎসা পরীক্ষায় যে দুইজন নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের একজন হলেন স্যার মার্টিন ল্যানড্রে। তিনি বলেন, দুই ধরনের অ্যান্টিবডি মিশিয়ে স্যালাইনের মাধ্যমে শিরায় প্রবেশ করানো হলে কোভিড রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা এক-পঞ্চমাংশ কমে যায়।

তিনি বলেন, কোভিড-১৯ আক্রান্ত গুরুতর রোগীদের যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তখন এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি কাজ করবে কিনা সেটা নিয়ে খুব, খুবই সংশয়ের মধ্যে থাকতে হয়। যদি প্রাকৃতিকভাবে আপনার শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি না হয়. তবে এই অ্যান্টিবডি ব্যবহার করে আপনি সত্যিই উপকার পাবেন।

হাসপাতালের ট্রায়ালে প্রদাহবিরোধী স্টেরয়েড ওষুধ ডেক্সামাথাসোনের পাশাপাশি রোগীদের ওপর নতুন এই চিকিৎসা প্রয়োগ করা হয়।

এই পরীক্ষার দ্বিতীয় প্রধান গবেষক স্যার পিটার হরবি বলছেন, অ্যান্টিবডি চিকিৎসা আসলে কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা ছিল। কারণ কোনো কোনো পরীক্ষায় দেখা গেছে যে এটা খুব একটা সুফল বয়ে আনে না।

করোনা রোগীদের রক্ত থেকে প্লাজমা সংগ্রহ করে কোভিড চিকিৎসাতেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। কিন্তু এই নতুন চিকিৎসার রিকভারি ট্রায়ালে ল্যাবরেটরিতে তৈরি দুটি সুনির্দিষ্ট অ্যান্টিবডির মিশ্রণ রোগীর দেহে ঢোকানো হয় যেগুলো করোনার কোষে আটক যায়।

স্যার পিটার বলেন, কোভিড-১৯‘র মারাত্মক অবস্থাতেও রোগী দেহে ভাইরাসের বিরুদ্ধে যে এই চিকিৎসা কার্যকর এটা খুবই খুশির খবর।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //