আলজেরিয়া ও মরক্কোর দ্বন্দ্ব এখন কোন পথে?

গত ২৪ আগস্ট আলজেরিয়ার সরকার মরক্কোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এই সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রামদানি লামামরা সাংবাদিকদের বলেন, মরক্কো আলজেরিয়ার কর্মকর্তাদের ওপর ‘পেগাসাস’ সফটওয়্যার ব্যবহার করে গোয়েন্দাগিরি করছে। একইসঙ্গে আলজেরিয়ার অভ্যন্তরে একটা বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপকে সমর্থন দিচ্ছে এবং পশ্চিম সাহারার ব্যাপারে মরক্কো যে প্রতিশ্রুতিগুলো দিয়েছে, সেগুলো তারা রাখছে না। 

লামামরা বলেন যে, মরক্কো কখনো আলজেরিয়ার বিরুদ্ধে শত্রুতাপূর্ণ আচরণ বন্ধ করেনি। আলজেরিয়ার এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া হিসেবে মরক্কোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক টুইটার বার্তায় বলে যে, আলজেরিয়ার এই সিদ্ধান্ত দুঃখজনক এবং অহেতুক। ‘রয়টার্স’ জানাচ্ছে যে, দুই দেশের মাঝে সীমানা ১৯৯৪ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে। এর আগে দুই দেশের দ্বন্দ্বে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হলেও, ১৯৮৮ সালে তা আবারও পূর্বাবস্থায় আনা হয়েছিল। তবে সেই সময় থেকে এবারই প্রথম কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হলো। মরক্কো দুই দেশের মাঝে সীমানা খুলতে চাইলেও নিরাপত্তার কথা বলে আলজেরিয়া সীমানা বন্ধ রেখেছে। 

এর এক সপ্তাহ আগেই আলজেরিয়ার সরকার বলে যে, সে দেশে ভয়াবহ দাবানলে ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগানোর পিছনে দুটি গ্রুপ জড়িত; যাদের আলজেরিয়া কিছু দিন আগে সন্ত্রাসী বলে ঘোষণা দিয়েছে। আলজেরিয়ার পূর্বাঞ্চলে কাবাইলি অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘এমএকে’ এই দুই গ্রুপের একটা। এই গ্রুপকে মরক্কো এবং ইসরায়েল সহায়তা দিচ্ছে বলে অভিযোগ করে আলজেরিয়ার সরকার। দাবানলে ওই অঞ্চলই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আলজেরিয়া সরকার আগুন লাগাবার এবং একজন নিরপরাধ মানুষকে দোষী অপবাদ দিয়ে গণপিটুনি দিয়ে খুন করে মরদেহ পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগে ২৫ জনকে গ্রেফতার করে; যাদের কয়েকজন নিজেদের ‘এমএকে’এর সদস্য বলে স্বীকার করে। আলজেরিয়ার টেলিভিশনে তাদের স্বীকারোক্তি প্রচার করা হয়। একইসঙ্গে নিরপরাধ গায়ক জামাল বেন ইসমাইলের মৃত্যুকে সরকারের সিদ্ধান্তের পেছনে জনসমর্থন আদায়ে ব্যবহার করা হয়। 

এর আগে গত ১৮ জুলাই আলজেরিয়ার সরকার মরক্কো থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নেয়। অভিযোগ ছিল যে, নিউ ইয়ার্কে মরক্কোর রাষ্ট্রদূত ওমর হিলালি জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের এক বৈঠকে আলজেরিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পক্ষে কথা বলেছেন। হিলালি বলেন, যদি পশ্চিম সাহারার জনগণের নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকারের ব্যাপারে আলজেরিয়া এতটা সোচ্চার থাকে, তাহলে তাদের নিজেদের দেশে কাবাইলি অঞ্চলের জনগণকেও নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকার দেওয়া উচিত। হিলালির কথাগুলো দুই দেশের বহু বছরের দ্বন্দ্বকে তুলে ধরে। ১৯৭০- এর দশক থেকেই মরক্কোর দক্ষিণে পশ্চিম সাহারা অঞ্চলে ‘পলিসারিও ফ্রন্ট’ স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করছে। পলিসারিওকে সরাসরি সহায়তা দিচ্ছে আলজেরিয়া। অপর দিকে মরক্কো এই অঞ্চলকে নিজের অঞ্চল বলে মনে করে। ১৯৯১ সালে যুদ্ধ শেষ হলেও অনেক বছর ঠান্ডা থাকার পর ২০২০ সালের শেষ দিকে পশ্চিম সাহারার ইস্যু আবারও গরম হয়ে উঠতে শুরু করে, যখন গত নভেম্বরে পলিসারিও ঘোষণা দেয় যে, তারা আবারও সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করতে যাচ্ছে। এরপর গত ডিসেম্বরে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম সাহারার ওপর মরক্কোর সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়।

মরক্কোর সঙ্গে আলজেরিয়ার নতুন করে দ্বন্দ্ব এমন এক সময়ে হলো, যখন ইউরোপের সঙ্গে মরক্কোর কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। গত ১০ জুন ইইউ পার্লামেন্টে পাস করা এক রেজলিউশনে বলা হয়, গত মে মাসে মরক্কোর মূল ভুখন্ডে স্প্যানিশ ছিটমহল সেউতাতে ১০ হাজার শরণার্থী ঢুকে যাবার পেছনে মরক্কো সরকারের হাত ছিল। ইইউ বলে, মরক্কোর সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সহায়তাতেই শরণার্থীরা স্প্যানিশ ছিটমহলে ঢুকে পড়ে; উদ্দেশ্য ছিল স্পেনের ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা। অনেকেই মনে করেছেন যে, স্পেনের সেউতা ছিটমহলে শরণার্থীদের প্রেরণ করা ছিল মূলত পশ্চিম সাহারার পলিসারিওর নেতাকে স্পেনে ঢুকতে দেওয়ার প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ড। 

পলিসারিওর সঙ্গে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সবসময় মরক্কোর পক্ষে থেকেছে এবং প্রচুর অস্ত্র দিয়ে সহায়তা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের উত্তেজনার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র কিনছে মরক্কো। গত এপ্রিলে মরক্কো প্রথমবারের মতো ড্রোন ব্যবহার করে পলিসারিওর ওপর হামলা করে। যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্ক একত্রে মরক্কোর সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে। একইসঙ্গে ইসরায়েলের সঙ্গে মরক্কোর সম্পর্ক স্বাভাবিক হবার কারণে তারাও হয়তো মরক্কোকে সামরিক সহায়তা দেবে; বিশেষ করে ড্রোন প্রযুক্তি দিয়ে। 

মরক্কোর কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। মরক্কোর উত্তরে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ জিবরালটার প্রণালি। সেউতা ছিটমহলের অবস্থানও ঠিক তার দক্ষিণে। অপরদিকে পশ্চিম সাহারার অবস্থান উল্টোদিকে মরক্কোর দক্ষিণে। জিবরালটারের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবাণিজ্য পথ মরক্কোর পররাষ্ট্রনীতি থেকে দূরে থাকবে ততদিন, যতদিন পশ্চিম সাহারার দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখবে ইউরোপ ও আলজেরিয়া। এই দ্বন্দ্ব তুরস্ক ও ইস্রাইলের মত দেশগুলোকেও যুক্তরাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় পশ্চিম আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় টেনে আনছে। একইসঙ্গে এই দ্বন্দ্বের কারণে মরক্কো মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ধরে রাখার জন্য একটা ‘দরজা’ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //