টুইন টাওয়ার হামলা থেকে শুরু

‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’

বিশ বছর আগে চারটি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করে সেগুলোকে ক্ষেপণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আঘাত হানা হয় নিউইয়র্কের দুটি আকাশচুম্বী ভবন ও মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগনে। কার্যত এই সন্ত্রাসী হামলার মধ্য দিয়েই খুলে যায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলোর জোটবদ্ধ হয়ে অন্য দেশে আগ্রাসন চালানোর দরজা। আর ওই আগ্রাসনকে নাম দেওয়া হয় ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’।

যুক্তরাষ্ট্রে হামলার অজুহাতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ শুরু করেন ‘অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম’, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ আফগানিস্তান থেকে ইরাক, পাকিস্তান, ইয়েমেন, সোমালিয়া, ফিলিপাইন, লিবিয়া ও সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এটি পরিণত হয় ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে’। কারণ এর মধ্য দিয়ে যেসব যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা কোনোভাবেই সমাপ্তির মুখ দেখেনি।

৯/১১ হামলা : এই হামলাটি ছিল শতাব্দীর অন্যতম সবচেয়ে ভয়াবহ একটি হামলা। শুধু আমেরিকানদের জন্যই নয়, গোটা বিশ্ব চমকে গিয়েছিল ঘটনার ভয়াবহতায়। দিনটি ছিল ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার। ছিনতাই করা চারটি বিমানের মধ্যে প্রথম বিমানটি আঘাত হানে টুইন টাওয়ারের নর্থ টাওয়ারে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৪৬ মিনিটে। দ্বিতীয় বিমানটি সাউথ টাওয়ারে বিধ্বস্ত করা হয় ৯টা ৩ মিনিটে। দুটি ভবনেই আগুন লেগে যায়। ভবন দুটি ছিল ১১০ তলা। মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে দুটি ভবনই বিশাল ধুলার ঝড় তুলে ভেঙে মাটিতে গুঁড়িয়ে পড়ে।

এসব হামলায় সব মিলিয়ে নিহত হন দুই হাজার ৯৭৭ জন। এই হিসাবের মধ্যে ১৯ ছিনতাইকারীর অন্তর্ভুক্ত নেই। নিহতদের বেশিরভাগই ছিল নিউইয়র্কের বাসিন্দা। চারটি বিমানের ২৪৬ যাত্রী এবং ক্রুর প্রত্যেকে মারা যান। টুইন টাওয়ারের দুটি ভবনে দুই হাজার ৬০৬ এবং পেন্টাগনের হামলায় নিহত হন ১২৫ জন। ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বাধীন উগ্র ইসলামপন্থার নামে পরিচালিত সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়দা আফগানিস্তান থেকে এই হামলার পরিকল্পনা করে।

সন্ত্রাসের নতুন আখ্যান : ১৯ শতকের শেষ দিকে পুঁজিবাদ যখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, তখন পুঁজিবাদী উপনিবেশিক রাষ্ট্রীয় শক্তি সন্ত্রাসবাদ ধারণার সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে ওই কথিত সন্ত্রাসবাদের দ্বিতীয় ঢেউ আসে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপর উপনিবেশগুলোতে স্বাধীনতাকামীরা সংগঠিত হতে শুরু করে। বিভিন্ন অঞ্চলের স্বাধীনতাসংগ্রামীদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দিয়ে নির্মম দমন-পীড়ন শুরু করে ঔপনিবেশিক শক্তি। 

১৯৬০-এর দশকে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের উত্থান থেকে শুরু করে ১৯৯০ সালে ঠান্ডাযুদ্ধের অবসান পর্যন্ত সময়কালে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কাঠামো ওই সমাজতন্ত্রী, বামপন্থীদেরকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে আখ্যায়িত করত। এটি পশ্চিমা সন্ত্রাসবাদের তৃতীয় ধাপ। এই পর্যন্ত সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করা হতো রাজনৈতিক প্রশ্নে। তবে চতুর্থ ধাপে আসে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের বিষয়টি। ১৯৮০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিভিন্ন স্থানে বামপন্থীবিরোধী ধর্মীয় রক্ষণশীল আন্দোলন গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের বীজ আগেই বপন করা হয়েছিল। পরে এসব উগ্র-ইসলামপন্থী মতাদর্শ থেকেই উত্থান ঘটে ইসলামের নামে পরিচালিত সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর। সমস্যা আরও প্রকট হয় ৯/১১ হামলার পর তালেবানরা আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দিয়ে সন্ত্রাসীদের আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তুললে। তালেবানদের হাত ধরে ইসলামী উগ্রপন্থার শুরু। আল কায়দা ও ইসলামিক স্টেটের (আইএস) হাতে কথিত ইসলামপন্থা সন্ত্রাসবাদের আকার ধারণ করে। সন্ত্রাসবাদের এই নতুন আখ্যানের মধ্য দিয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট যে কোনো দেশের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করে আগ্রাসন চালানো অব্যাহত রাখে। 

দেশে দেশে আগ্রাসন : ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগন আর টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার অজুহাতে তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের’ সূচনা করেছিল আফগানিস্তানে আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে। এর মধ্য দিয়ে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হয়। ২০ বছর পর ঘটনার পরিক্রমায় সেই তালেবান আবারও আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করেছে।

২০০৩ সালে ইরাকে আগ্রাসন চালায় মার্কিনের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট। ব্যাপক আকারের সেনা অভিযান চালায় এই জোট। সেখানে চলতে থাকে বছরের পর বছর দখলদারি এবং রক্তাক্ত বিদ্রোহী তৎপরতা। সম্প্রতি এ ক্ষেত্রে যে বড় কোনো অগ্রগতি হয়নি; কিন্তু বিদেশি সেনারা ইরাক ছাড়তে চলেছে। ইরাকের অভিজ্ঞতা এত গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে যে, রাজনীতিবিদরা এখন মধ্যপ্রাচ্যে অন্তত এক প্রজন্ম বা তারও বেশি সময়ের জন্য কোনো বড় ধরনের বিদেশি সামরিক কর্মকাণ্ডের বিপক্ষে।

২০১১ সাল থেকে শুরু হয় লিবিয়ার আগ্রাসন। লিবিয়াতে যাকে বলে ‘বুটস অন দ্য গ্রাউন্ড’- অর্থাৎ সেখানকার মাটিতে তেমন কোনো বড় সংখ্যায় পশ্চিমা সৈন্য নামেনি। তবে সেখানে ন্যাটোর উদ্যোগে একটি সংক্ষিপ্ত নো-ফ্লাই-জোন কার্যকর করা হয়েছিল। আর গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বিরোধী বিদ্রোহীদের দিক থেকে এটুকুই ছিল যথেষ্ট। এর পর দেশটিতে একটি গৃহযুদ্ধ এবং বিদ্রোহী তৎপরতা শুরু হয়। লিবিয়ানদের শুরুর দিকের কৃতজ্ঞতা এরপর পরিণত হয় ক্ষোভে। কারণ পশ্চিমারা তাদের ফেলে চলে গেছে।

২০১১ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে মার্কিন বাহিনী বিদ্রোহীদের মদদ দেওয়ার অভিযান শুরু করে সিরিয়ায়। এই গৃহযুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়ে রাশিয়া, ইরান ও তুরস্ক। সেখানে ১০ বছর ধরে সহিংসতা চলছে।

২০১৪ সালে উত্থান ঘটে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস)। তবে এদের দমনে ৮০টি দেশের এক বিরল নীতিগত জোট গড়ে উঠেছিল। এক পৈশাচিক ও ধর্ষকামী খেলাফতকে পরাজিত এবং ধ্বংস করতে এগিয়ে আসে বিভিন্ন জাতির মানুষ। তাদের ধ্বংস করা যায়নি। তবে নিয়ন্ত্রণ করতে সময় লেগেছিল পাঁচ বছর। সম্প্রতি আইএস আবার আফ্রিকাতে তাদের কার্যক্রম বাড়াতে শুরু করেছে।

২০১৩ সালে মালিতে প্রথম আগ্রাসন চালায় ফ্রান্স। প্রাথমিকভাবে ফরাসি সামরিক বাহিনীর অভিযান রাজধানী বামাকোকে রক্ষা করতে পেরেছিল। কারণ তা না হলে শহরটি প্রায় নিশ্চিতভোবেই আল-কায়দা সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসীদের দখলে চলে যেত; কিন্তু সে ঘটনার পর এখন আট বছর পার হয়ে গেছে। দেশটিতে হাজার হাজার বহুজাতিক বাহিনীর সৈন্য থাকলেও বিদ্রোহ এখনো চলছে। মালির জনগণ এখন ফরাসিদের ওপর আস্থা হারিয়েছে। 

ভবিষ্যৎ কোন পথে : ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’-এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খানিক আভাস পাওয়া যায় গত ২ জুন যুক্তরাজ্যের চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল স্যার মার্ক কার্লটন স্মিথের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটে দেওয়া এক বক্তৃতায়। তিনি জানান, এ যুগের সেনাবাহিনী হবে অনেক বেশি নেটওয়ার্ক-সমৃদ্ধ, অপেক্ষাকৃত অভিযাত্রী-সুলভ এবং অনেক বেশি দ্রুত মোতায়েনযোগ্য। তারা সংযুক্ত থাকবে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে। সৈনিকের সঙ্গে যোগাযোগ হবে উপগ্রহের মাধ্যমে এবং স্পেশাল অপারেশনস ব্রিগেডের ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা। যদি যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যের সংখ্যা কম হয়, তাহলে তার অর্থ হলো- একেবারে সর্বাধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা বেড়ে যাবে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তাও। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //