সহিংসতা ভর করেছে ত্রিপুরার বিজেপি সরকারে

রাজনীতির পারদ চড়ছে ত্রিপুরায়। লক্ষ্য ২০২৩ সালের বিধানসভা নির্বাচন। একদিকে তৃণমূল কংগ্রেস তার সর্বভারতীয় চেহারা উজ্জ্বল করতে পশ্চিমবঙ্গের নিকটবর্তী বাঙালি জনবহুল রাজ্য ত্রিপুরায় নিজের অবস্থান পোক্ত করতে চাইছে। অপরদিকে সিপিএম তার পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে উঠে দাঁড়াতে চাইছে। এর বিপরীতে ২০১৮ সালে ত্রিপুরায় ক্ষমতায় এসে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির একবিন্দুও বাস্তবায়ন না করার অভিযোগ রয়েছে বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকারের বিরুদ্ধে।

এখন তারা টিকে থাকতে রাজনৈতিক সহিংসতাকে মোক্ষম অস্ত্র করে এগোচ্ছে। তাই প্রতিনিয়ত হামলার শিকার হতে হচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও ভিন্নমতের সংবাদমাধ্যমকে। গত ৮ সেপ্টেম্বর ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় কার্যত বিজেপির তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করেছে স্থানীয় জনগণ। তবে এটি তার ধারাবাহিক সহিংসতারই প্রতিফলন বলতে হবে। কারণ তা আকস্মিক কিছু ছিল না। এমনকি ‘ট্রেলার’ বলেও উল্লেখ করেছেন বিজেপি নেতারা। 

২০১৮ সালের ৩ মার্চ ২৫ বছরের দীর্ঘ বাম শাসনকে পরাস্ত করে ত্রিপুরার ক্ষমতায় আসে বিজেপি ও আইপিএফটি জোট সরকার। এর আগে দিল্লি থেকে কয়েক ডজন নেতা-মন্ত্রী ত্রিপুরায় এসে প্রচুর সময় দিয়েছেন, স্থানীয় মানুষকে ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অথচ ক্ষমতায় এসে শাসক দল এসব প্রতিশ্রুতির প্রায় কিছুই পূরণ করেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। গ্রাম ও পাহাড়ে কাজের অভাব, বেকারত্ব, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বেহাল করোনাকালে গোটা রাজ্যের মানুষকে আরও উদ্বেগের মধ্যে ফেলেছে। এসব ইস্যু যখন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তুলতে শুরু করে, সেখানে জনগণের বিশেষ সাড়াও মেলে। এমন অবস্থায় উগ্র-রাষ্ট্রবাদ এবং ধর্মীয় উগ্রবাদকে পুঁজি করে গোটা দেশের মতো ত্রিপুরায়ও রাজনৈতিক সহিংসতা শুরু করে বিজেপি। ক্ষমতায় আসার পরে প্রথমেই প্রায় বিনা নির্বাচনে গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করার অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সেটি আরও প্রবল আকার ধারণ করে। রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতাদের পরামর্শেই লোকসভা নির্বাচনে সহিংসতা চালানো হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। অথচ ২০১৮ সালের বিধানসভার ভোটে কোনো নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনা প্রকাশ্যে আসেনি। সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণ অগাধ প্রতিশ্রুতির আশ্বাসে বিজেপিকে ক্ষমতায় এনেছিল। 

প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ায় জনগণের মধ্যে যে ক্ষোভ জন্মেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় কিছুদিন আগে হওয়া এডিসি নির্বাচনের ফলাফলে। ক্ষমতায় থেকেও নতুন দল ‘তিপ্রা মথা’র কাছে হারতে হয়েছে বিজেপি-আইপিএফটি জোটকে। এটি ত্রিপুরা জাতিসত্তার অধিকার আদায়ে গড়ে ওঠা একটি নতুন রাজনৈতিক দল; যার নেতৃত্বে রয়েছেন ত্রিপুরা রাজবংশের উত্তরাধিকারী প্রদ্যোত কিশোর দেববর্মা। বিরাটসংখ্যক সাধারণ মানুষ বিজেপি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। তবে তাদের অনেকেই রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিআইএমের দিকে আগের মতো নিরঙ্কুশ সমর্থন দিতে নারাজ। তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থন প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তৃণমূল কংগ্রেসের যুবনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ত্রিপুরা সফরের সময়ে তাঁর গাড়িতে আক্রমণের ফলে কিছু জাতীয় সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সেই নিয়ে খবর হলেও, এই রাজনৈতিক আক্রমণের ঘটনা নতুন কিছু নয়। ২০১৮ সাল থেকে বিজেপি যে রাজনৈতিক হিংসা সারা রাজ্যে চালাচ্ছে, এবার প্রকাশ্যে নিজেরাই তার প্রমাণ দিয়েছে গত ৮ সেপ্টেম্বর।

ত্রিপুরার সংবাদপত্র দৈনিক সংবাদ, দেশের খবরসহ অন্যান্য মিডিয়ার খবরে জানা যায়, বিকেল ৪টার দিকে বিজেপির যুব মোর্চার একটি মিছিল থেকে প্রথমে আক্রমণ চালানো হয় ‘পিবি২৪ চ্যানেল’ এবং দৈনিক পত্রিকা ‘প্রতিবাদী কলম’-এর দপ্তরে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহুল প্রচারিত ভিডিওগুলোতে যুব মোর্চার শীর্ষ নেতাদের প্রকাশ্যে লাঠি হাতে সংবাদমাধ্যম দপ্তরে তাণ্ডব চালাতে দেখা যায়। সেইসঙ্গে পার্শ্ববর্তী সিপিএম সদরদপ্তরে আক্রমণ চালানো হয়। সিপিএম দপ্তরের সামনে রাখা তিনটি গাড়ি পুড়িয়ে ফেলা হয়। বামফ্রন্টের আহ্বায়ক বিজন ধরের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দপ্তরে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০ লাখের ওপরে।

অনুসন্ধানী সাংবাদিক সৌরব চক্রবর্ত্তী বলেন, ‘রাস্তার দুই ধারে আগুন, মাঝখান দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছেন দুই নারী। চারদিকে স্লোগান দেওয়া হচ্ছে ‘জয় শ্রীরাম’, ‘ভারত মাতা কী জয়’। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে, ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার কোনো তথ্যচিত্র কিংবা কিছু দিন আগে ঘটে যাওয়া দিল্লি দাঙ্গার ভিডিও ফুটেজ। তবে এই দৃশ্য গুজরাট কিংবা দিল্লির নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের ছোট রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার। গত ৮ সেপ্টেম্বর রাজ্যজুড়ে যে ভয়ানক রাজনৈতিক সন্ত্রাস ভারতীয় জনতা পার্টি সংগঠিত করেছে, তা গত কয়েক দশকের মধ্যে ত্রিপুরার মানুষ দেখেননি। একেবারে প্রকাশ্যেই রাজধানী আগরতলার মেলার মাঠ এলাকায় তিনটি সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অফিস এবং সিপিআই (এম)-এর দুটি প্রধান কার্যালয়ে আক্রমণ চালায় গেরুয়া বাহিনী। তা ছাড়া সেদিনই সারা রাজ্যে আরও কয়েকটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অফিস ও সিপিআই (এম) সহ অন্যান্য বিরোধী দলের অফিসও পোড়ানো হয় কিংবা ভাঙচুর করা হয়।’

৮ সেপ্টেম্বর শুধু আগরতলা নয়, রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে একই কায়দায় আক্রমণ চালানো হয় বিরোধী দলের দপ্তর ও নেতা-কর্মীদের বাড়িতেও। যাত্রীপুরার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এই পরিস্থিতি খুবই বেমানান। সে দিনই উদয়পুরে সিপিএমের মহকুমা অফিস ভাঙচুর করা হয় ও দুরন্ত টিভির দপ্তর ভেঙে দেওয়া হয়। বিশালগড়ে বুলডোজার দিয়ে ভাঙা হয় সিপিএমের সিপাহিজলা জেলা পার্টি অফিস। সোনামুড়া মহকুমার অন্তর্গত কাঁঠালিয়ায় সিপিএমের মহকুমা কমিটির সদস্য ননী পালের বাড়ি ভাঙচুর করার পাশাপাশি তাকে মারধর করা হয়। উদয়পুরে সিপিআইএমের রাজ্য কমিটির সদস্য মানিক বিশ্বাসের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই দিনই আগরতলায় ডিওয়াইএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক নবারুণ দেবের বাড়িতে তাণ্ডব চালানো হয়। ৮ তারিখ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত সিপিএমসহ অন্যান্য বিরোধী দলের দপ্তরে আক্রমণ চালায় বিজেপির কর্মীরা। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক পঙ্কজ আচার্য বলেন, ‘বিরোধীমুক্ত ভারত গড়ার যে ডাক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দিয়েছেন, এটি সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক। অথচ এটিই সংঘ পরিবারের মূল বক্তব্য। এর ধারাবাহিকতাই ত্রিপুরায় দেখা যাচ্ছে। তাদের আইটি সেল সবসময় নজরদারি করছে বিরোধী রাজনীতি করা বা বিরোধী মনোভাবাপন্ন মানুষদের প্রতি। সময় সুযোগ মতো তাদের আক্রমণ করে কার্যত জনগণের কণ্ঠরোধের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। গো-রক্ষকবাহিনী তৈরি করে গরু সুরক্ষার নামে সংখ্যালঘু মানুষের উপর ক্রমাগত আক্রমণ ও হেনস্তা নামিয়ে আনা হচ্ছে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //