বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন

কিছু কি পেল ধরিত্রীবাসী?

গ্লাসগোতে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন শেষ হলো। স্কটল্যান্ডের এই শহরটি পরিবেশদরদি মানুষের পদচারণায় মুখর ছিল। বিশ্ব নেতা থেকে পরিবেশ অধিকার কর্মীসহ নানা ধরনের মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। ধরিত্রীকে বাঁচাতে বিশ্ব নেতাদের মুখে ছিল কথার ফুলঝুড়ি। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। নেতারা মুখের কথার চিড়ে ভিজিয়েছেন। ফটোসেশন করেছেন সবাই।

মূলধারার গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সর্বত্র এসব ছবির ছড়াছড়ি দেখা গেছে। পৃথিবী ও তার আশপাশে ঠান্ডা রাখতে আগের মতোই প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিয়েছেন নেতারা। এতকাল বিরামহীন দূষণে সৃষ্ট ক্ষত মুছতে উদার হস্তে অর্থ বিলানোর আগের অঙ্গীকারও পুনর্ব্যক্ত করেছেন; কিন্তু প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন এখনো স্বপ্নের মতো অধরা।

বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে মানবজাতির অস্তিত্ব হুমকির আশঙ্কা আগে থেকে করছিলেন। উষ্ণতা বৃদ্ধি কি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক কারণে হচ্ছে, না-কি মানুষের দায় আছে এমন দোলাচলের মধ্যে গঠিত হলো আন্তঃদেশীয় বিজ্ঞানীদের মোর্চা- ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)। তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে বেরিয়ে এলো ভয়াবহ চিত্র। পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণ মানবসৃষ্ট। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার ওপরে আস্তরণ আছে। এটার নাম ওজোনস্তর। ওজোনস্তরের কারণে মাত্রাতিরিক্ত সূর্যের তাপ পৃথিবীতে আসতে পারে না। সূর্যের কড়া রশ্মি বিকীরণ মোকাবেলায় ওজোনস্তর অনেকটা দেয়ালের মতো কাজ করে; কিন্তু বায়ুমণ্ডলে মিশে যাচ্ছে শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন গ্যাস- যা ওজোনস্তরের ক্ষয়সাধন করে। ফলে সূর্যের তাপমাত্রা ভূপৃষ্ঠে আসে বাধাহীনভাবে। ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়।

পর্বতমালার বরফ বেশি করে গলতে থাকে। পানি সমুদ্রে গড়িয়ে গিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। বায়ুমণ্ডল গরম হয়ে সৃষ্ট দাবানল পুড়ে ছাই করে বনভূমি। উজার হয় পৃথিবীর শ্বাসতন্ত্র। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা বাড়তে থাকে। ফলে মানবজাতি এগিয়ে যায় ক্রমবিলুপ্তির পথে। এমন এক বাস্তব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশগুলো বিশ্ব সম্মেলন আয়োজন শুরু করেন। এই সম্মেলনের নাম ‘কনফারেন্স অব পার্টিস’ সংক্ষেপে কপ। এখানে পার্টিস কথাটার মানে হলো দেশ।

গবেষণার মাধ্যমে বেরিয়ে এলো, পৃথিবীতে মোট দূষণের অর্ধেকের জন্য দায়ী- চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত ও রাশিয়া। এরা শিল্প-কারখানার মাধ্যমে কার্বন নির্গমন করে, শিল্পে জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহার করে ক্ষতিকর মিথেন গ্যাস ছড়ায়, সবুজের সমারোহ ধ্বংস করে। তাদের দূষণের ফলে ওজোনস্তরের ক্ষয় হয়। গোটা মানবজাতি তার শিকার হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশ দূষণের জন্য দায়ী নয়; কিন্তু দূষণের শিকার হয় বাংলাদেশ। পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ার কারণে হিমালয়ের বরফ বেশি গলছে। বঙ্গপোসাগরের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা উপচে পড়ে বিনষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি। খাদ্য ঘাটতি হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ খাবার পানি মিলছে না।

দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ সারাবছর বৃষ্টির পানির দিকে চেয়ে থাকেন। বঙ্গপোসাগরের পানির উচ্চতা এক মিটার বেড়ে গেলে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ জনপদ পানির নিচে তলিয়ে যাবে। মানুষ হবে উদ্বাস্তু। সমুদ্র ঘন ঘন উত্তাল হচ্ছে। জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে যাচ্ছে বেড়িবাঁধ এবং তলিয়ে যাচ্ছে লোকালয়। ঘূর্ণিঝড়ে উড়ে যাচ্ছে বসতভিটা। এ সব কারণে বাংলাদেশে দুই কোটি জলবায়ু উদ্বাস্তুর সৃষ্টি হবে। এমনিতে ১১ লাখ রোহিঙ্গা পাহাড় কেটে, বন ধ্বংস করে ঘনবসতির বাংলাদেশে বাড়তি চাপের সৃষ্টি করছে। জলবায়ু উদ্বাস্তু বাংলাদেশে কী অবস্থার সৃষ্টি করবে, তার কিছুটা আঁচ করা যাচ্ছে; কিন্তু এত কিছুর পরেও কোনটির জন্যই বাংলাদেশ দায়ী না। দায়ী দূষণকারী দেশগুলো। দুনিয়াতে ন্যায়বিচার বলে যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে, তবে এসব দূষণকারী দেশগুলোর উচিত হবে- দ্রুততম সময়ে দূষণ বন্ধ করা; ক্ষতির শিকার দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া; জলবায়ুর ফলে বিরূপ জীবনযাত্রার সঙ্গে মানিয়ে চলার জন্য অর্থ বরাদ্দ ও প্রযুক্তি সহায়তা দেওয়া; ক্ষতির শিকার মানুষদের দুর্ভোগ লাঘবে অর্থায়ন করা- এসব বিষয় সামনে রেখেই কপের যাত্রা শুরু হয়েছিল; কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিশ্বে এক নম্বর দূষণকারী চীন ও দুই নম্বর দূষণকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুব বেয়ারা। এরা দূষণ কমাতে চায় না।

এসব দেশ মনে করে, দূষণ কমালে তাদের শিল্পে উৎপাদন কমে যাবে। কপ যখন কিছুই করতে পারছে না, তখন গড়ে ওঠা পরিবেশ আন্দোলন চাপের সৃষ্টি করে। বিশেষ করে যেখানেই কপ সম্মেলন, সেখানেই পরিবেশ অধিকার কর্মীরা বিক্ষোভ করছেন। কপের ইতিহাসে খানিকটা সফলতা দেখেছিল ২০১৫ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে সম্মেলন। ওই সম্মেলনে গোটা বিশ্ব একটা চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল। ওই সম্মেলনে মত প্রকাশ করা হয় যে, বিশ্বে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার এক দশমিক পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। প্রাক শিল্প যুগের সঙ্গে তুলনা করে বিজ্ঞানীরা এই টার্গেট নির্ধারণ করে। দেশগুলো এটা বাস্তবায়নে একমত পোষণ করে। এটা প্যারিস জলবায়ু চুক্তি নামে অধিক পরিচিত।

প্যারিস জলবায়ু চুক্তির দুর্বল দিক হলো, চুক্তিটি বাস্তবায়ন আইনগত বাধ্যতামূলক নয়। চুক্তির বাস্তবায়ন কোন দেশ কতটা করেছে, সেটি মনিটরিংয়ের কিছু নেই। তবুও কথা ছিল, স্বেচ্ছায় দেশগুলো প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন করবে। প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা আসে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দূষণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেন। ট্রাম্প নিজে একজন ব্যবসায়ী। তিনি মনে করেন, জলবায়ু চুক্তি মোতাবেক কার্বন নির্গমন কমাতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন কমে যাবে। তাই তিনি জলবায়ু ইস্যুকে অগ্রাহ্য করেন।

জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর প্রথম দিকেই তিনি প্যারিস চুক্তিতে ফিরে যান। বাইডেন মনে করেন, জলবায়ু কূটনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব নেতৃত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে। কিংবা বিশ্বের নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তিনি তাই বহুপক্ষীয় কূটনীতিতে ফিরে আসেন। যুক্তরাষ্ট্র ফিরে আসায় জলবায়ু কূটনীতি চাঙ্গা হয়। গ্লাসগো সম্মেলন এতটা গুরুত্ব লাভ করার বড় কারণ সম্মেলনটিতে বাইডেনের ফিরে যাওয়া। কোভিড শেষ হতে না হতেই এত বড় শোডাউন আর হয়নি। বাইডেন গিয়ে চীনের নেতা শি জিনপিং এবং রুশ নেতা ভ্‌লাদিমির পুতিনের সমালোচনা করে। বললেন, জলবায়ু সম্মেলনে অংশ না নিয়ে তারা ভুল করেছেন। শি জিনপিং ও ভ্‌লাদিমির পুতিন গ্লাসগো সম্মেলনে যোগ না দিলেও চীন ও রাশিয়া প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে।

গ্লাসগো সম্মেলনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হয়েছে। কয়লার ব্যবহার কমানোর চুক্তি হয়েছে। চুক্তিতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র সই করেনি। ফলে চুক্তিটি কার্যত অর্থনীতি বিষয়ের চুক্তি হয়ে পড়েছে। দেশগুলো কার্বন নির্গমন কমিয়ে ক্লিন এনার্জি ব্যবহারের যে সময়সীমা দিয়েছে তা অগ্রহণযোগ্য।

অনেক দেশ ২০৬০ সাল নাগাদ কার্বন নির্গমন সীমিত করার অঙ্গীকার করলেও ভারত বলেছে, তারা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে আছে। তাই তারা কার্বন নির্গমন কমাবে ২০৭০ সাল নাগাদ। বনজসম্পদ উজার করবে না বলে চুক্তিতে সই করেনি বাংলাদেশ। এসব চুক্তি বাধ্যতামূলক চুক্তি নয়। চুক্তির বাস্তবায়ন অগ্রগতি মনিটরিং করার কোনো ব্যবস্থা নেই। তবুও চুক্তি সই করতে গড়িমসি। বাস্তবায়ন তো বহু দূরের কথা। বরং গ্লাসগো সম্মেলনে নেতারা নিজস্ব এয়ারক্রাফট উড়িয়ে গিয়ে দূষণ ছড়িয়ে দিয়েছেন। সম্মেলনে কিছুটা নাটকীয়তা ছিল।

শেষ দিকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র একযোগে কাজ করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। জলবায়ু তহবিল নিয়ে বাস্তবায়নের বিষয়ে অগ্রগতি চোখে পড়েনি। দূষণকারী দেশগুলো জলবায়ুর ক্ষতি পোষানো এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে বছরে একশ’ কোটি ডলারের তহবিল গঠনের কথা ছিল। তহবিলে অর্থায়ন হয়েছে অতি সামান্য। ফলে ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য’ করে যাওয়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে এখনো অনেক পথ হাঁটার বাকি রয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //