বর্জ্যরে উপনিবেশবাদ

অবাঞ্ছিত প্লাস্টিকে জর্জরিত বিশ্ব

প্লাস্টিক বর্জ্যে ভর্তি ১৪১টি কনটেইনার এক বছরেরও বেশি সময় ধরে যাত্রা করছে সমুদ্রপথে। কখনো তুরস্ক, কখনো গ্রিস আবার কখনো বা কনটেইনারগুলোর দেখা মিলছে ভিয়েতনামে। কনটেইনারবাহী জাহাজটির যাত্রা শুরু হয়েছিল জার্মানি থেকে। এখন এগুলোর অবস্থান জার্মানি থেকে যোজন যোজন দূরে। এই কনটেইনারগুলোর সমুদ্রযাত্রায় প্লাস্টিক বর্জ্যের গুপ্ত বিশ্ব বাণিজ্যের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। 

২০২০ সালের শেষ নাগাদ মিশ্র প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারির কিছু সময় পর কনটেইনারবাহী জাহাজটি তুরস্কে পৌঁছে। তৎক্ষণাৎ কনটেইনারগুলো নিয়ে ঝঞ্ঝাট বেঁধে যায় এক দল ব্যবসায়ী, শিপিং লাইন, একাধিক সরকার এবং পরিবেশবাদী প্রচারকদের মধ্যে। বর্জ্যভর্তি কনটেইনার ফেরত পাঠানোর দাবি জানিয়েছিল তারা। তুর্কি কর্তৃপক্ষও তখন কনটেইনারগুলো গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর কনটেইনারগুলো তুরস্কের বিভিন্ন বন্দরে পড়েছিল। অগত্যা পচতে শুরু করে কনটেইনার বন্দি বর্জ্যগুলো। মাস কয়েক পর কনটেইারগুলো থেকে দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করে বলে জানান তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের শহর আদানার প্লাস্টিক দূষণবিষয়ক গবেষক সেদাত গুনডগডু। ১৪১টি কনটেইনারের বছরব্যাপী সমুদ্রযাত্রার গল্প প্লাস্টিক বর্জ্যরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি নগণ্য অংশ। উন্নত বিশ্বের প্লাস্টিক বর্জ্য, বিশেষ করে গৃহস্থালির মিশ্রিত প্লাস্টিক, প্রায়ই অন্য দরিদ্র কোনো দেশে পাঠানো হয়। সেখানে এই প্লাস্টিক গলিয়ে ফেলা হয়। অথবা আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেওয়া বা পোড়ানো হয়।

মিশ্র প্লাস্টিক হলো বাণিজ্যের সবচেয়ে নোংরা এবং কম কাঙ্ক্ষিত বর্জ্য। কারণ এতে সাধারণত বোতল বা প্যাকেজিংয়ের মতো গৃহস্থালির আবর্জনা থাকে। অর্থাৎ পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের সঙ্গে মেশানো থাকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয় এমন উপাদান। অনেক দেশই মিশ্র প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সেসব দেশের ব্যবসায়ীরা এসব বর্জ্য আমদানি করলে তাদের আমদানিসংক্রান্ত লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায়। 

বিশ্বের শীর্ষ ব্যবহারযোগ্য জিনিসের মেয়াদ শেষে তা পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে সক্ষম অনেক দেশও বৃহৎ প্লাস্টিক বর্জ্য রফতানিকারক। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তিন বছর আগে বিশ্বের শীর্ষ পণ্য পুনর্ব্যবহারকারী হিসেবে নাম নিয়েছিল জার্মানির; কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, দেশটি বার্ষিক গড়ে ১০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য রফতানি করে থাকে, যা ইউরোপী ইউনিয়নের (ইইউ) যে কোনো দেশের তুলনায় বেশি। যুক্তরাজ্যের অবস্থান এ ক্ষেত্রে কিছুটা ভালো।

ব্রিটিশ প্লাস্টিক ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, দেশটি এর ৬১ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য রফতানি করে। গুনডগডুর ভাষ্যে, প্লাস্টিক বর্জ্য  সমস্যা দুটি উপায়ে সমাধান করা যায়। এর একটি পুড়িয়ে ফেলা, অন্যটি  ডাম্পিং করা। যদি দেশে ডাম্পিং ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে পুড়িয়ে ফেলাই শ্রেয়; কিন্তু এতে বায়ু ও পরিবেশ দূষণ হয়। অনেক দেশ কার্বন নির্গমনের হার কমাতে চাইছে। তাই তারা বর্জ্য পোড়াতে চায় না। এ অবস্থায় যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানির মতো ইউরোপের শীর্ষ বর্জ্য উৎপাদক দেশগুলো এ সমস্যা সমাধানে অন্য সহজ উপায় বেছে নিয়েছে। অর্থাৎ পরিবেশগত আইন ও প্রবিধান ছাড়াই দরিদ্র দেশে রফতানি করা। এটাই ‘বর্জ্য উপনিবেশবাদ’। 

মে মাসে তার্কিস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কনটেইনারগুলো ফেরত দেওয়ার জন্য জার্মানির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল; কিন্তু জার্মান কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে।  তারা এখন আর কনটেইনারগুলো গ্রহণ করতে পারে না। ব্যাডেন-ওয়ার্টেমবার্গ রাজ্যের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র অ্যাঙ্গেলা গ্রিয়েসবাচ এখন কনটেইনার তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছেন। তিনি বিষয়টিকে ‘ভুল বোঝাবোঝি’ বলে জানিয়ে বলেন, বর্জ্যবাহী কনটেইনারগুলো যখন তুরস্কে পৌঁছে, তখন তা বৈধই ছিল। উল্লেখ্য, ২০২০ সালে জার্মানির রফতানি করা প্লাস্টিক বর্জ্যরে  বেশিরভাগ চালান তুরস্ক এবং গ্রিসের বন্দরে আটকে আছে।

প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানিতে ভিয়েতনামের নিজস্ব নিষেধাজ্ঞা ২০২৫ সালে কার্যকর হওয়ার কথা; কিন্তু দেশটি বৈশ্বিক প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারযোগ্য বাণিজ্যের জনপ্রিয় গন্তব্য হিসেবে থেকে গেছে। পুনর্ব্যবহারযোগ্য ও অপূর্ণব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বাছাইয়ের জন্য শ্রমিকদের দৈনিক ৫ পাউন্ডেরও কম মজুরি দেওয়া হয় ভিয়েতনামে।

প্লাস্টিক সম্পর্কিত দূষণের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন করে ব্যাসেল অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (বিএএন)। এ সংগঠনের এক কর্মী জিম পাকেট নভেম্বরে এথেন্সের কাছে পাইরাস বন্দরের দিকে যাওয়া জার্মান কনটেইনারগুলোর মধ্যে ৩৭টি চিহ্নিত করেছিলেন। আর এগুলো পচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্যবাহী কনটেইনার। আর সন্দেহ ছিল, এগুলো ভিয়েতনামের দিকেও যাচ্ছে। সেসময় তাক্ষণিকভাবে গ্রিক কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবগত করে বলেন, এসব বর্জ্য খালাস করার অনুমতি দিতে পারে না তারা। ভিয়েতনামেও কনটেইনারগুলো নেওয়ার অনুমতি দেওয়া যায় না। এটা অবৈধ এবং এই জাহাজটির উচিত জার্মানিতে ফিরে যাওয়া। পাকেটের অভিযোগ আমলে নিয়ে গ্রিক কর্তৃপক্ষ কনটেইনাগুলো পাইরাস বন্দরেই রেখে দেয়। 

২০১৮ সালে প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারির সিদ্ধান্ত নেয় চীন। এরপর ভিয়েতনাম ও তুরস্ক প্লাস্টিক বর্জ্যরে আস্তাকুঁড় হিসেবে পরিণত হয় পশ্চিমা বিশ্বের কাছে। জাতি সংঘের তথ্য অনুযায়ী, চীনের সিদ্ধান্ত বিশ্বজুড়ে সাধুবাদ পেয়েছিল। জাতিসংঘ বলছে,  বিশ্বের উত্তরের দেশগুলোকে অবশেষে প্লাস্টিক বর্জ্য চীনে পাঠানোর পরিবর্তে তাদের প্লাস্টিকে আসক্তির প্রকৃত মূল্য দিতে হবে। চীন ১৯৯২ সাল  থেকে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক বর্জ্য গ্রহণ করেছে।

পাকেট বলেন, আমরা পৃথিবীতে আরও বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলছি। প্রতিদিনই, আজকের দিনটির চেয়ে বেশি। আর এর কোনো গন্তব্য নেই। এখন প্লাস্টিক বর্জ্য কে নেবে, তা নিয়ে খেলা চলছে। কারণ প্লাস্টিক বর্জ্যের পাহাড় তৈরি হয়ে গেছে এরই মধ্যে। আর এটা কখনো থামবে না। দিন দিন প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ বেড়েই যাবে। ফলস্বরূপ নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ১১ কোটি ১০ লাখ টন প্লাস্টিক  বর্জ্যরে জন্য নতুন গন্তব্য খুঁজতে হবে গুরুত্ব সহকারে।

চীন আমদানি নিষিদ্ধ করলেও, জাহাজ বাণিজ্যে আধিপত্যের মাধ্যমে প্লাস্টিকের  বৈশ্বিক বাণিজ্য থেকে মুনাফা করছে। এই নিবন্ধ শুরু হয়েছে ১৪১টি পচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্যরে সমুদ্রযাত্রার গল্প দিয়ে। এই কনটেইনারবাহী জাহাজটি চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠন কসকো শিপিংয়ের। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিষয়ক গবেষক ম্যাথিউ গর্ডন ‘অ্যাটলাস অব প্ল্যাস্টিক ওয়েস্ট’ শীর্ষক প্রকল্পে কাজ করছেন। এই প্রকল্পে বিশ্বের নতুন প্লাস্টিক ডাম্পিং সাইটগুলো সংকলন করা হচ্ছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে ডাম্পিং সাইটবিষয়ক প্রতিনিধিত্বকারী দেশের সংখ্যা দেখে বিস্মিত হয়েছেন গর্ডন। এসব দেশের মধ্যে বসনিয়া, থাইল্যান্ড, রোমানিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক উল্লেখযোগ্য। 

তিনি বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে স্পষ্টভাবে মূল্য কেন্দ্র মনে হচ্ছে। বিশেষ করে চীনের নিষেধাজ্ঞা জারির পর। এর একটি কারণ হচ্ছে, কনটেইনার জাহাজগুলো চীনের মতো দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানি হয়। ফিরতি পথে জাহাজগুলো একরকম ফাঁকাই থাকে বলতে গেলে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের রফতানিকারকরা দেশে বর্জ্য সমস্যা সমাধানের চেয়ে অন্য দেশে পাঠিয়ে দেওয়াকেই অতি সস্তা বলে করেন। তুরস্কের স্থানীয় প্লাস্টিক আমদানিকারকরা বৈশ্বিক পুনর্ব্যবহারযোগ্য বাণিজ্যে সম্পৃক্ত থাকতে চান। অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান পরিবেশগত উদ্বেগ তো আছে। এ অবস্থায় উভয় সংকটে রয়েছে দেশটি। 

নেদারল্যান্ডসের স্বতন্ত্র গ্লোবাল ক্যাম্পেইনিং নেটওয়ার্ক গ্রিনপিসের অনুসন্ধানের পর ব্রিটিশ এবং জার্মান সুপারমার্কেট চেইন থেকে পুনর্ব্যবহারের উদ্দেশ্যে প্লাস্টিক পণ্যগুলো রাস্তার ধারে ফেলে রাখা অবস্থায় পাওয়া গেছে। তুরস্ক গত মে মাসে সংক্ষিপ্তভাবে প্রায় সব প্লাস্টিক আমদানি নিষিদ্ধ করেছিল; কিন্তু কিছু কিছু প্লাস্টিক বর্জ্য এখনো আমদানি হচ্ছে।

গুনডগডু বলেন, প্লাস্টিক বর্জ্যরে নতুন ডাম্পিং গ্রাউন্ড কিছু দিন বন্ধ থাকার পর আবার তা ফুলেফেঁপে উঠছে। প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানির কেন্দ্র তুরস্কের আদানা। সম্প্রতি তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানকে এক খোলা চিঠি দিয়েছে স্থানীয় প্লাস্টিক ব্যবসায়ীদের একটি জোট। চিঠিতে এরদোগানকে এই শিল্প চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এই চিঠি প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানি পুনর্বিন্যাস করার একটি প্রচারণার অংশ ছিল। প্রচারণাটির প্রতিপাদ্য ‘এটি বর্জ্য নয়, কাঁচামাল’।

তারা চিঠিতে জানিয়েছে, প্লাস্টিক বর্জ্য শিল্পে জড়িত ৩ লাখ তুর্কি। ব্যবসায়ীরা নিজেদের ‘দূষিত না করে পরিবেশ পরিষ্কার করি’ বলে চিঠিতে আখ্যায়িত করেছেন। তবে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন অনেক তার্কিস নাগরিক। ২০২০ সালে ইইউ থেকে ৮ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য এসেছিল। এ বিষয়ে তারা ঠিক কেমন বোধ করেছে জিজ্ঞেস করা হলে তাদের বেশিরভাগই বলেন, ‘খুব খারাপ’। অন্যরা নিজেদের দেশে প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানির প্রতিবাদ জানিয়ে একটি স্লোগান দিয়েছে ‘তুরস্ক আবর্জনার আস্তাকুঁড়ে নয়’। এই স্লোগান উপজীব্য করে দেশটিতে প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //