জটিল সমীকরণে এরদোয়ানের সৌদি সফর

দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, তখন ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমীকরণে পরস্পরের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা সামনে এসেছে। আর তাই তীব্র মতবাদিক বিরোধ সত্ত্বেও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেব এরদোয়ান সৌদি আরব সফর করেছেন। ২৮ এপ্রিল এই সফর শুরুর আগে তিনি সৌদি আরবকে ‘ভ্রাতৃপ্রতীম’ দেশ আখ্যায়িত করেছেন। এই সফরের মধ্য দিয়ে সম্পর্কের নতুন যুগ শুরু হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন এরদোয়ান।

তুর্কি প্রেসিডেন্ট সৌদি আরবে পাঁচ বছরের মধ্যে তার প্রথম সফরে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে (এমবিএস) আলিঙ্গন করেন এবং একটি রাষ্ট্রীয় নৈশভোজ ও সরাসরি আলোচনার আগে বাদশাহ সালমানের সাথে ঐতিহ্যবাহী আরবি কফি পান করেন, যা ২৯ এপ্রিল ভোর পর্যন্ত চলে।

২০১১ সালের আরব বসন্তের পর কয়েকটি আরব দেশের সাথে যে বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তা নিরসনে বিগত বছরগুলোতে কাজ করছে তুরস্ক। এসব দেশের মধ্যে মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব অন্যতম। মুসলিম ব্রাদারহুডকে তুরস্কের সমর্থনের কারণে আরব দেশগুলো রাজনৈতিক ইসলামকে একটি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে। এতে করে তুরস্কের সাথে তাদের বৈরিতা শুরু হয়।

সর্বশেষ ২০১৭ সালে তুরস্কের মিত্র কাতারের ওপর উপসাগরীয় দেশগুলোর অবরোধ আরোপে এই বিচ্ছিন্নতা আরো বাড়িয়ে দেয়। ২০১৮ সালের অক্টোবরে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে ভাড়াটে খুনিদের মাধ্যমে সৌদি সাংবাদিক ও কলামিস্ট জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ড তুরস্ক এবং সৌদি আরবের মধ্যে ইতিমধ্যেই সংঘাতময় ও নড়বড়ে সম্পর্ককে পুরোপুরি পতনের মুখে ঠেলে দেয়। 

এই হত্যার ঘটনায় সৌদি আরবের ডি ফ্যাক্টো নেতা যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ওপর চাপ বাড়ে এবং বৈশ্বিক নিন্দার ঝড় ওঠে। এক বছর আগের মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাশোগিকে হত্যা বা বন্দি করার অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন খোদ যুবরাজ। সৌদি সরকার সব সময় তার সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে আসছে।

সরকারপন্থি তুর্কি সংবাদমাধ্যম ও খোদ এরদোয়ান যুবরাজের নাম উল্লেখ না করে বলেছেন, সৌদি রাজতন্ত্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে কিলিং স্কোয়াড কাজ করেছে। সৌদি আরবের একটি আদালত ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে এক রায়ে ৮ ব্যক্তিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো এই প্রহসনের বিচারের নিন্দা জানিয়েছে। তুরস্ক সন্দেহভাজন ২৬ সৌদি নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা ও তদন্ত জারি রাখে।

তবে এরদোয়ানের সফরকে সামনে রেখে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এই বিচার স্থগিত ও সৌদি আরবের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মাধ্যমে সম্পর্ক উষ্ণ করার প্রধান বাধা দূর করা হয়েছে।

নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি আবুধাবির মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক মনিকা মার্কস বলেন, ‘এটিই ছিল সবচেয়ে বড় বাধা। নিশ্চিতভাবে গত ছয় মাসে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, আঞ্চলিক সম্পর্ক উষ্ণ করার ক্ষেত্রে সৌদি আরবের সাথে নিশ্চিত অগ্রগতিই ছিল সবচেয়ে বড় বাধা। এর পেছনে জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডে ব্যক্তিগত বিরোধের গভীরতা ও আক্রমণের ভূমিকা রয়েছে।’

এর আগে চলতিও বছরের ফেব্রুয়ারিতে এরদোয়ান যখন সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন, তখন তাকে ধুমধামের সাথে স্বাগত জানানো হয়। আমিরাত থেকে ফেরার পথে সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, সৌদি আরবের সাথে ইতিবাচক সংলাপ চলমান রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এরদোয়ান রমজান মাসে সৌদি আরব সফর করেন। 

এর আগে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসোগলু ২০২১ সালের মে মাসে সৌদি আরব সফর করেন। এর আগের মাসেই তিনি সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেছিলেন। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, আগামী দিনে সম্পর্কোন্নয়নে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হবে। 

খাশোগি হত্যাকাণ্ডের সাড়ে তিন বছর পর দেশ দুটি সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের যে চেষ্টা করছে, তার পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। 

অর্থনৈতিক সংকট : তুরস্কের এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পেছনে রয়েছে দুই দশকের মধ্যে দেশটির সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকট। মিত্র হিসেবে ধনী উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলো বিনিয়োগের মাধ্যমে সহায়তা করতে পারে। মিসর ও ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের পদক্ষেপও নিয়েছে তুরস্ক।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে সম্পর্ক সংশোধন করার পরে আবুধাবি তুরস্কে বিনিয়োগ সহায়তা হিসেবে ১০ বিলিয়ন ডলার তহবিল ঘোষণা করেছে এবং অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে সহায়তার জন্য অন্য পদক্ষেপ নিয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, তুরস্কের অর্থনৈতিক দুর্দশা লাঘবে সহায়তা দিতে পারে সৌদি আরব। আগামী বছরের কঠিন নির্বাচনের মুখে রয়েছেন এরদোয়ান। এর মধ্যে বাড়তি মুদ্রাস্ফীতির চাপে রয়েছে তুরস্কের অর্থনীতি।

সৌদি আরবের জেদ্দার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার আগে এরদোয়ান সাংবাদিকদের বলেন, এই সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্ক উন্নয়ন, রাজনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরালো করা। 

প্রসঙ্গত, খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিরোধের জেরে ২০২০ সাল থেকে সৌদি আরবে সরকারি ঘোষণা ছাড়াই তুর্কি পণ্য বয়কট চলছিল। ফলে দেশটিতে তুরস্কের রফতানি ৯০ শতাংশ কমে যায়। গত মার্চ মাসে সৌদি আরবের সাথে তুরস্কের বাণিজ্য ছিল ৫৮ মিলিয়ন। আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ হলেও ২০২০ মার্চের ২৯৮ মিলিয়নের তুলনায় নগণ্য।

তুরস্কের এই কূটনৈতিক উদ্যোগের নেপথ্যে দেশটির বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের ভূমিকা রয়েছে। করোনা মহামারির পর এখন ইউক্রেন যুদ্ধ। সরকারি মূল্যস্ফীতি ৬১ শতাংশে পৌঁছেছে, তুর্কি মুদ্রা লিরার দরপতন হয়েছে। ২০২১ সালে ডলারের বিপরীতে মূল্য কমেছে ৪৪ শতাংশ এবং এই বছর কমেছে আরো ১০ শতাংশ।

এরদোয়ানের আমিরাত সফরের আগেই তুরস্ক আবুধাবির সাথে ৪.৯ বিলিয়ন ডলার মুদ্রা বিনিময় চুক্তি নিশ্চিত করেছে। কাতার, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাথেও দেশটি এমন চুক্তি করেছে। আমিরাত ঘোষণা দিয়েছে তুরস্কে ১০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা বিনিয়োগের।

ভূরাজনৈতিক সমীকরণ : রিয়াদ ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যে সৌদি আরব আঞ্চলিক জোট বিস্তৃত করতে এই পদক্ষেপ নিয়েছে।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক বছরেরও বেশি সময় আগে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এমবিএস এখনো তার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করেননি। বাইডেনের ডেমোক্রেটিক পার্টির বেশ কয়েকজন আইনপ্রণেতা তাকে সৌদি আরবের প্রতি আরো কঠোর হওয়ার জন্য খোলাখুলিভাবে আহ্বান জানিয়েছেন। তারা সৌদিকে খারাপ কৌশলগত সহযোগী দেশ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ দেশটি রাশিয়ার সাথে ওপেক-নেতৃত্বাধীন চুক্তি অব্যাহত রেখেছে। সমালোচকেরা বলছেন, এ কারণে ইউক্রেনে যুদ্ধের সময়ে তেল সরবরাহের সংকট আরো খারাপ হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক মনিকা মার্কসের মতে, উভয় দেশের জন্য পুনরায় ঘনিষ্ঠ হওয়া রাজনৈতিকভাবে যৌক্তিক এবং অর্থনৈতিকভাবে মুনাফাজনক। অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার নিরিখে মহামারি বিভিন্ন দেশের সরকারকে আরো বাস্তবসম্মত পদক্ষেপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একইসাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের উপসাগরীয় নীতিতে পরিবর্তন এসেছে।

তিনি আরো বলেন, এই অপ্রত্যাশিত আঞ্চলিক সম্প্রীতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ হয়েছে। সেটি হচ্ছে, তিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট- ওবামা, ট্রাম্প ও বাইডেন সৌদি চাহিদামতো ইরানের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

সফরের ফলে এরদোয়ান ও এমবিএসের ব্যক্তিগত অনাস্থাও দূর হতে পারে বলে মনে করেন মনিকা মার্কস। আস্থা অর্জনের চূড়ান্ত ধাপ হিসেবে এরদোয়ানের কাছে যুবরাজের চূড়ান্ত প্রত্যাশা হতে পারে খাশোগির হত্যা মামলা নিয়ে তিনি আর বিরোধ বাড়াবেন না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //