বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট

আলোর দিশারি হতে পারে মধ্যপ্রাচ্য

‘ক্ষুধা বিপর্যয়ের’ মুখোমুখি হচ্ছে বিশ্ব, সতর্কবার্তা ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের (ডব্লিউএফপি)। জাতিসংঘের খাদ্য সহায়তা দাতা সংস্থাটির মতে, যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিড-১৯ এবং খাদ্য ও জ্বালানির ক্রমবর্ধমান দর ৮১টি দেশের অন্তত ৪ কোটি ৭০ লাখ মানুষকে দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে। সংঘাত ক্ষুধার অন্যতম কারণ। আর বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের ৬০ শতাংশ যুদ্ধ ও সহিংসতা কবলিত এলাকায় বাস করে। 

ডব্লিউএফপির মতে, ইউক্রেনের যুদ্ধ মানুষের উপার্জনের উৎসে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ২০২০ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফসল উৎপাদন না হওয়ায় ও জীবিকা হারিয়ে বাস্তুহারা হয়েছেন ৩ কোটি মানুষ। এখন দুর্ভিক্ষ এড়াতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে গুরুত্ব দিতে বলছেন বিশ্লেষকেরা। 

কোভিড-১৯ ক্ষুধার্তের সংখ্যা অভূতপূর্বভাবে বাড়িয়ে তুলেছে। 

মহামারির আগে, ২০১৯ সালে, বিশ্বব্যাপী ১৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হয়েছিল। এটি এখন দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে ২৭ কোটি ৬০ লাখে ঠেকেছে-এ তথ্য ডব্লিউএফপির।

বিশ্বব্যাপী উদ্ভূত খাদ্য সংকটের প্রভাব অসমভাবে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। লেবানন, ইয়েমেনের মতো দেশ রাশিয়া-ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং নানা সংঘাতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এখন এসব দেশের পরিস্থিতি তথৈবচ। অন্যদিকে ইউক্রেন ও রাশিয়ার গমসহ অন্যান্য শস্যের ওপর নির্ভরশীল মিশর। গত বছর ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে ৮০ শতাংশ গম আমদানি করেছে দেশটি। যুদ্ধের ঘনঘটায় এখন দেশটিকে খাদ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে বেগ পেতে হচ্ছে।

তবে মধ্যপ্রাচ্যের পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল ও ইসরাইল এখন পর্যন্ত খাদ্য সংকটের বিষয়টি মোকাবেলা করছে দৃঢ়ভাবে। এর কারণ মূলত এসব দেশের নেওয়া খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গি বৈশ্বিক খাদ্য চ্যালেঞ্জগুলো সমাধানের চাবিকাঠি। তাই বিশ্লেষকদের মতে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশ্বের জন্য আলোর দিশারি হতে পারে মধ্যপ্রাচ্য। 

প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে খাদ্য উৎপাদনের জন্য দুরূহ স্থান মধ্যপ্রাচ্য। তাই এ অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার উৎস খাদ্য নিরাপত্তাজনিত বিষয়গুলো। ২০১১ সালের আরব বসন্ত বিক্ষোভের প্রাথমিক কারণগুলোর মধ্যেও খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল। পানি সরবরাহের অভাব থেকে কঠোর আবহাওয়া পরিস্থিতি ঐতিহ্যগত কৃষি পদ্ধতি ব্যবহার করে বড় আকারের কৃষিকাজ মধ্যপ্রাচ্যে কার্যত অসম্ভব।

এ অবস্থায় অঞ্চলটির অনেক দেশ উদ্ভাবনী প্রযুক্তির মাধ্যমে খাদ্য সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নিয়েছে। পানির অভাবের সমস্যা প্রশমনে ইসরাইল প্রথম প্রযুক্তি ব্যবহার করে। উন্নত সেচ ব্যবস্থা ও বিলবণীকরণ কমানোর মাধ্যমে ইসরাইল পানির স্বয়ংসম্পূর্ণতার একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলে এখন দেশটি বড় পরিসরে চাষাবাদের সক্ষমতা অর্জন করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) মতো গালফ অঞ্চলের দেশগুলোকে খাদ্য ও পানি সরবরাহ নিরাপদ করতে একই ধরনের পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। 

উল্লেখ্য, বিলবণীকরণ হচ্ছে সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে (ক্ষেত্রবিশেষে স্থলভাগবেষ্টিত হ্রদের হালকা লবণাক্ত পানি, অত্যধিক মাত্রায় খনিজায়িত ভূগর্ভস্থ পানি এবং পৌর বর্জ্যপানি) দ্রবীভূত খনিজ লবণ দূর করা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিলবণীকৃত ভূগর্ভস্থ সিক্ত শিলাস্তরটির (অ্যাক্যুইফার) অবস্থান ইউএইতে। লিওয়া মরুভূমিতে অবস্থিত এই অ্যাক্যুইফারে রয়েছে ২৬ বিলিয়ন লিটার পানি। এটি পূরণ করতে সময় লেগেছে প্রায় তিন বছর। জরুরি অবস্থায় এই অ্যাক্যুইফার দৈনিক ১০ কোটি লিটার পানির জোগান দিতে সক্ষম। বিশ্বের বিলবণীকরণ ব্যবস্থার প্রায় ৯ শতাংশ পরিচালনা করে আবুধাবি। এ হিসেবে ৪১ লাখ ৩০ হাজার ঘনমিটার পানি বিলবণীকরণ হয় শহরটিতে। কৃষি এবং খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে জোর দিয়েছে গালফ অঞ্চলের দেশগুলো। সৌদি আরবের নেতৃত্বে উপসাগরীয় দেশগুলো খাদ্য উৎপাদনের জন্য বিশ্বব্যাপী বিশাল জমি কিনেছে। ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে আমদানির মাধ্যমে খাদ্যের চাহিদা মেটাতে মিসরের নেওয়া পদ্ধতির বিপরীতে ধনী উপসাগরীয় দেশগুলো অন্যান্য দেশে খাদ্য উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে। 

খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি দীর্ঘ দিন ধরেই এ অঞ্চলে উদ্বেগের বিষয় ছিল। ২০০৯ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা পরবর্তী সময়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বেশি গুরুত্ব দেয় মধ্যপ্রাচ্য। হাইড্রোকার্বনের দাম কমে যাওয়া এবং আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় গালফ অঞ্চলের দেশগুলোর সরকার স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ২০০৯ সালের মন্দার পর আফ্রিকায় অনেক জমি কেনা হয়েছিল। ২০১৫ সালে আবুধাবিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আল দাহরা এগ্রিকালচারাল কোম্পানি সুদানের উর্বর আল হাওয়াদ উপত্যকায় ১০ বিলিয়ন ডলারের কৃষি প্রকল্পে প্রথম পর্যায়ে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে সম্মত হয়। ইউএইর মতো কিছু দেশ খাদ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিতে কৃষি প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করেছে।

সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে একটি মন্ত্রণালয়ই রয়েছে ইউএইর। ২০১৮ সালে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা কৌশল বিভাগ চালু করেছে দেশটি। এর লক্ষ্য ২০৫১ সালের মধ্যে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা সূচকের শীর্ষ ১০-এ স্থান নেওয়া। এছাড়া মরুভূমিতে লবণ-সহনশীল শস্য উৎপাদন, দুবাই মরুভূমিতে অভ্যন্তরীণ খামার এবং স্মার্ট গ্রিনহাউস তৈরি করা এই প্রচেষ্টার অংশ। ২০১৭ সালে কাতারের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের উদ্যোগ নেয় প্রতিবেশী দেশগুলো। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা কৌশল চালু করে দেশটি। এই কৌশলে জোর দেওয়া হয় খাদ্য উৎসে বৈচিত্র্য আনয়ন এবং আকস্মিক পরিকল্পনায়। সেই সময় সৌদি আরব সীমান্ত ব্যবহার করে প্রতিদিন ৪০০ টন দুধ ও দই আমদানি করত কাতার থেকে। পরবর্তীকালে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে দেশের মরুভূমিতে দুগ্ধ শিল্প গড়ে তোলে দেশটি। 

খাদ্য নিরাপত্তা কৌশল ছাড়াও গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিবেশীদের তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ কারণেই তারা খাদ্য সরবরাহ সংকট আরো ভালোভাবে প্রতিরোধ করতে সক্ষম।

আগামীতে জলবায়ু পরিবর্তন আরো অনেক দেশকে খাদ্য উৎপাদনের জন্য সীমানার বাইরে জমি অনুসন্ধানে বাধ্য করবে। যেমন-যুক্তরাষ্ট্রে যথেষ্ট আবাদযোগ্য জমি থাকা সত্ত্বেও দেশটির খাদ্য সরবরাহের একটি বড় অংশ আসে মেক্সিকো থেকে। মেক্সিকোয় শস্য উৎপাদন বেশ সাশ্রয়ী; কিন্তু এ ব্যবস্থা খাদ্য নিরাপত্তা দিতে সক্ষম নয়। গত বছর মেক্সিকো থেকে অ্যাভোক্যাডো আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ফলটির সরবরাহ ঘাটতিতে যুক্তরাষ্ট্রে এর দাম বেড়ে পৌঁছে ২৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। 

অন্য দেশে আবাদযোগ্য জমি কিনে তাতে শস্য উৎপাদন প্রক্রিয়া খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে সমর্থ হলেও বিশ্বের কিছু অংশে এ ব্যবস্থা ভূরাজনৈতিক জটিলতা আরো উসকে দিতে পারে। এক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট উদাহরণ গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র। অনেক ধনী দেশ ও প্রতিষ্ঠান দেশটির প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ আহরণের মাধ্যমে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার উপার্জন করলেও দুঃখজনকভাবে প্রত্যাশিত উন্নয়ন হয়নি কঙ্গোয়। আজ এখানে কোবাল্ট, লিথিয়াম পাওয়া যায়। ধরে নেওয়া যায়, অদূর ভবিষ্যতে কঙ্গোর জমি ব্যবহার হবে খাদ্য উৎপাদনে। বৈদ্যুতিক গাড়ি ও স্মার্টফোন তৈরিতে ব্যবহার হয় কোবাল্ট ও লিথিয়াম।

এশিয়া টাইমসে সম্প্রতি এক নিবন্ধে প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক নিউজলেটার এক্সপোনেন্সিয়াল ভিউয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ সম্পাদক যোসেফ ডানা উল্লেখ করেছেন, গালফ অঞ্চল প্রমাণ করেছে, খাদ্য আমদানি-রপ্তানির মডেলটির পরিসর অনেক ছোট। তা ধনী সমাজের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা মোকাবেলায় কাজ করতে পারে। এ প্রক্রিয়া বড় পরিসরে করা হলে এর প্রভাব কী হবে, তা বিবেচনা করা প্রয়োজন। আগামীতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নতুন নির্দেশিকা দরকার। মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্বেই এই প্রচেষ্টা এগিয়ে নিতে পারে বিশ্ব।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //