নূপুর শর্মা কাণ্ড

সাময়িক পিছু হটলেও হিন্দুত্ববাদে অনড় বিজেপি

এক অসাধারণ ভোটযুদ্ধে জিতে ২০১৪ সালের ২৬ মে প্রথমবারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন নরেন্দ্রভাই দামোদর দাস মোদি। ক্ষমতার আট বছর পূর্তি উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে তিনি দাবি করেছেন, এর আগে সব সরকারের চেয়ে তার সরকার অধিক সৎ। 

আরো বলেছেন, তিনি অনেক কিছু করেছেন। তবে এমন কিছু করেননি, যাতে দেশের মানুষের মাথা লজ্জায় হেঁট হয়ে যায়। যদিও অসংখ্য বিতর্কিত পদক্ষেপের দায়ভার রয়েছে মোদির ঘাড়ে। এসব ঘটনায়ও ভারতের ন্যূনতম মানবিক বোধসম্পন্ন জনগণ ব্যাপকভাবে লজ্জাবনত হয়েছে।

সংখ্যালঘু মুসলিমদের কোণঠাসা করার মজ্জাগত রাজনীতি থেকে ফেরেনি হিন্দুত্ববাদীরা। সম্প্রতি শুরু হয় মসজিদ বিতর্ক। বিচার বিভাগ ও পুলিশকে সাথে নিয়ে তারা একের পর এক মসজিদকে মন্দির বলে দাবি করে আদালতে মামলা করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় এসেছে ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদকে (স.) নিয়ে বিজেপি মুখপাত্র নূপুর শর্মার ন্যক্কারজনক বক্তব্য। নূপুর নিউজ নাও চ্যানেলের টকশোতে এসব কথা বলেন। এরপর দিল্লি বিজেপির মুখপাত্র নবীন জিন্দালসহ আরো অনেকে একই বক্তব্য দিয়েছেন। অথচ এসব বক্তব্যের বিপরীতে বিজেপি বা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পরে যখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক এলো তখনই তাদের টনক নড়ে। বিজেপির পক্ষ থেকে সমালোচনা করা হয়। জিন্দালকে স্থায়ী ও নূপুরকে অস্থায়ীভাবে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

কে এই নূপুর শর্মা : দল থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার হওয়ার আগে পর্যন্ত ৩৭ বছর বয়সী এই আইনজীবী ছিলেন ‘বিজেপির সরকারি মুখপাত্র’, যিনি মোদি সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে এবং সরকারের পক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দেওয়ার জন্য রাতের পর রাত টেলিভিশনের বিতর্ক অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছেন।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ার সময় নূপুর তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেন ২০০৮ সালে। তখন তিনি বিজেপির ছাত্র শাখা অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের (এবিভিপি) প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন। তবে লন্ডনের স্কুল অব ইকোনমিকস থেকে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক আইন বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি পাস করে ২০১১ সালে ভারতে ফেরার পর রাজনীতির জগতে তার দ্রুত উত্থান হতে থাকে।

সুবক্তা, রূঢ়ভাষী নূপুর ইংরেজি ও হিন্দি দুই ভাষাতেই দক্ষতা এবং দৃঢ়তার সাথে তার মতামতের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বিজেপিতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ২০১৩ সালে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির মিডিয়া কমিটিতে তাকে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ দেওয়া হয়। এর দুই বছর পর যখন নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন তিনি ছিলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বিপক্ষে বিজেপির প্রার্থী। কেউ আশা করেনি ওই নির্বাচনে তিনি কেজরিওয়ালকে হারিয়ে দেবেন। তবে ওই নির্বাচনের জন্য তার ব্যাপক উদ্দীপনামূলক প্রচারাভিযান তাকে দলে আরো সামনের সারিতে নিয়ে আসে। তিনি দিল্লিতে দলের সরকারি মুখপাত্র নিযুক্ত হন এবং ২০২০ সালে তাকে বিজেপির ‘জাতীয় মুখপাত্র’ করা হয়।

গত কয়েক বছরে ভারতের টিভি দর্শকদের কাছে অতি পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন নূপুর শর্মা। বেশিরভাগ সন্ধ্যায় টিভির পর্দায় শোনা যেত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে উচ্চ কণ্ঠে তার চিৎকার এবং বিরোধী রাজনীতিকদের কোণঠাসা করতে নানা কৌশলের ব্যবহার, এমনকি তাদের প্রতি গালিগালাজ।

আরব দেশগুলোর চাপে পিছু হটল ভারত : ভারতে ইসলাম-বিদ্বেষ ও মুসলমানদের উপর আক্রমণের ঘটনা ২০১৪ সালে বিজেপির ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চলছে; কিন্তু আরব বা উপসাগরীয় দেশগুলোর কাছ থেকে এমন প্রতিক্রিয়া আগে কখনো দেখা যায়নি। বিশ্লেষকরা কয়েক দিন ধরে চলা আরব দেশগুলোর ধারাবাহিক প্রতিবাদকে নজিরবিহীন বলে মনে করছেন। এর একটি কারণ গত দুই দশকে ভারতের সাথে আরব দেশসমূহ, বিশেষ করে উপসাগরীয় অঞ্চলের সম্পর্কের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। আর দ্বিতীয় কারণ আরব দেশগুলো সাধারণত ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করে না।

ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশটিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর, বিশেষ করে মুসলমানদের উপর হামলার অনেক ঘটনা ঘটেছে। গরু রক্ষার নামে বেশ কয়েকজন মুসলমানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে; কিন্তু সেসব ঘটনায় উপসাগরীয় দেশগুলোর তরফ থেকে ভারতের নিন্দা বা সমালোচনা করে প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য বা উদ্বেগ জানানো হয়নি। 

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এবারে ব্যতিক্রম হওয়ার জন্য ধর্মীয় কারণটিই প্রধান বিবেচ্য হলেও, এর পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে সামাজিক মাধ্যম, যেখানে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাকও দেওয়া হচ্ছে।

সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমানে দায়িত্ব পালন করা ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত তালমিজ আহমদ মনে করেন, বিতর্কিত মন্তব্যটি উপসাগরীয় দেশগুলোর সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার কারণে আরব নেতৃবৃন্দকে বাধ্য হয়ে প্রকাশ্যে অবস্থান নিতে হয়েছে। তিনি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেন, ‘এসব দেশের পররাষ্ট্রনীতি তাদের জাতীয় স্বার্থের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। তাদের মূলনীতি হচ্ছে, অন্য দেশের কোনো বিষয়ে মন্তব্য না করা। মন্তব্যটা করা হয়েছে ইসলামের নবী এবং তার পরিবারকে নিয়ে। আমরা জানি যে, মুসলিম বিশ্বে নবী মুহাম্মদের গুরুত্ব এবং মুসলমান সম্প্রদায় তাকে নিয়ে কোনো অবমাননাকর মন্তব্য মেনে নেবে না। এ মন্তব্য রেড লাইন বা সীমা অতিক্রম করে গেছে।’

যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের এশিয়া কর্মসূচির পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান জানান, গত দুই দশকে উপসাগরীয় এবং আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছে, সেটি অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত উভয় দিক থেকেই। এই মূহূর্তে ভারতের মোট আমদানির অর্ধেক আসে উপসাগরীয় দেশগুলোর জোট গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের সদস্য ছয়টি দেশ থেকে। ইরান ও ইরাককে যোগ করলে উপসাগরীয় দেশগুলো থেকেই আসে ভারতের পেট্রলের ৮০ শতাংশ। ভারত বছরে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে তার অর্ধেক আসে কাতার থেকে। এসব দেশের সাথে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্কও খুব জোরালো। সংযুক্ত আরব আমিরাতে বছরে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ রপ্তানি করে ভারত। এছাড়া জিসিসির সদস্য উপসাগরীয় ছয়টি দেশে ৮৫ লাখের বেশি ভারতীয় কাজ করেন। বাকি আরব দেশেও বহু ভারতীয় কাজ করেন। আরব দেশগুলো থেকে প্রবাসী ভারতীয়রা বছরে সাড়ে তিন হাজার কোটি মার্কিন ডলার রেমিটেন্স দেশে পাঠান। এসব কারণেই ভারতের অর্থনীতি উপসাগরীয় দেশগুলোর উপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল।

অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক কারণেই আরব দেশের প্রতিক্রিয়ার জবাবে ভারত কিছুটা পিছু হটে যায়। এক বিবৃতিতে বিজেপি বলেছে, তারা যে কোনো ধর্মের বা যে কোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে অপমানের নিন্দা করে। কোনো সম্প্রদায় বা ধর্মকে অপমান করা, বা হেয় করা- বিজেপি এমন আদর্শেরও বিরুদ্ধে। বিজেপির ওই দুই নেতা এরই মধ্যে প্রকাশ্যে ক্ষমাও চেয়েছেন।

তবে ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের প্রতিক্রিয়া তার ঠিক উল্টো। এখানে নূপুরকে ভিকটিম হিসেবে দেখানো হচ্ছে। ধর্ম নিয়ে কথা বলায় নূপুর আক্রান্ত হয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে। নূপুরের ন্যক্কারজনক আক্রমণকে ‘সমালোচনা’ বলে উল্লেখ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর এতে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, ভবিষ্যতে এমন আরো অনেক নূপুরকে সামনে এসে ধর্মের নামে উসকানি দিতে দেখা যাবে, যা হিন্দুত্ববাদের সহজাত রাজনীতি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //