সৌদি আরবে বাইডেনের ভিন্ন সুরের নেপথ্যে

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডে এমবিএস খ্যাত সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারটি প্রকাশ্যে আসে। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য তখনকার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জো বাইডেন বিশ্বমঞ্চে সৌদি আরবকে ‘অস্পৃশ্য’ করে রাখতে চেয়েছিলেন।

ট্রাম্প-পরবর্তী সময়ে যে কারণে সৌদি-মার্কিন সম্পর্কের অবনতি হয়। এবার সেই ‘অস্পৃশ্য’ সৌদি আরবের দ্বারস্থ হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। খাসোগি হত্যার অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, সেই এমবিএসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতেও দেখা গেছে তাকে। অনেকে এ অবস্থানকে ‘মার্কিন স্বার্থের মানবাধিকার’ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে এর পেছনে রয়েছে রাশিয়া-চীন-ইরান মোকাবেলা, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন অবস্থান শক্ত করা এবং তাদের ভূরাজনীতির স্বার্থ। 

এ সফরের আগে বাইডেন মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টে লেখা এক নিবন্ধে নিজের অবস্থানের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘আমি জানি অনেকেই আমার সৌদি আরব সফরের পরিকল্পনার সঙ্গে একমত নন। মানবাধিকার বিষয়ে আমার অবস্থান স্পষ্ট এবং দীর্ঘস্থায়ী। আমি যখন বিদেশ সফরে যাই, মৌলিক স্বাধীনতার বিষয়টি সবসময়ই আলোচ্যসূচিতে থাকে। ... প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমাদের দেশকে শক্তিশালী ও সুরক্ষিত রাখাই আমার কাজ। আমাদের রাশিয়ার আগ্রাসন মোকাবেলা করতে হবে, চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভালো আবস্থানে যেতে হবে এবং বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চলে আরও বেশি স্থিতিশীলতার জন্যও কাজ করে যেতে হবে। এই কাজগুলো করার জন্য এমন সব দেশের সঙ্গে আমাদের সরাসরি সম্পৃক্ত হতে হবে, যারা ফল নির্ধারণে প্রভাব রাখতে পারে। সৌদি আরব এসব দেশের মধ্যে একটি। যখন আমি সৌদি নেতাদের সঙ্গে দেখা করব, আমার লক্ষ্য থাকবে মৌলিক মার্কিন মূল্যবোধের প্রতিও সৎ থেকে পারস্পরিক স্বার্থ এবং দায়িত্বের ভিত্তিতে কৌশলগত অংশীদারিত্ব জোরদার করা।’

বাইডেনের এ অবস্থানকে মার্কিন অবস্থান হিসেবে অনেকে সমর্থন করছেন। তবে সমালোচকরা এ অবস্থানকে ‘মার্কিন স্বার্থের মানবাধিকার’ বলে উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের স্বার্থ অনুযায়ী গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয়টিকে ব্যবহার করে আসছে বহু বছর ধরে। বাইডেনের অবস্থানও এর বাইরে কিছু নয়। 

বৈঠকের আগে বাইডেন ও এমবিএস পরস্পরের মুষ্টিবদ্ধ হাত ঠোকাঠুকি করে স্বাগত জানাচ্ছেন এমন ছবি প্রকাশিত হয়, যা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আপাতদৃষ্টিতে উষ্ণ হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। তবে খাসোগির বাগদত্তা হেতিস চেঙ্গিজ দুজনের ছবি টুইট করে লিখেছেন, ‘আমার বাগদত্তার হত্যাকাণ্ডের এই জবাবদিহির প্রতিশ্রুতিই কি আপনি আমাকে দিয়েছিলেন? এমবিএসের পরবর্তী শিকার যে হবে তার রক্ত আপনার হাতে লেগে রয়েছে।’

ওয়াশিংটন পোস্টের প্রকাশক এবং প্রধান নির্বাহী ফ্রেড রায়ান বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও মোহাম্মদ বিন সালমানের মধ্যকার এই ‘ফিস্ট বাম্প’ একটি হ্যান্ডশেকের চেয়েও খারাপ ছিল- এটি ছিল লজ্জাজনক। এটি ঘনিষ্ঠতার এমন একটি স্তর প্রকাশ করে, যা এমবিএসকে অযাচিতভাবে সেই দায়মুক্তি দিয়েছে, যা পেতে সে মরিয়া হয়ে উঠেছিল।’ 

শান্তিতে নোবেল জয়ী ইয়েমেনের অধিকারকর্মী তাওয়াক্কোল কারমান বাইডেনের সৌদি সফরের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি ত্যাগ করেছেন বাইডেন।’ 

তবে ১৩ থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত চলা মধ্যপ্রাচ্য সফরে সৌদি আরব যাওয়ার আগে ইসরায়েল এবং অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চল সফর করেন বাইডেন। ১৫ জুলাই এমবিএসের আতিথ্য গ্রহণ করে তিনি একই সঙ্গে কয়েকটি লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করেন। সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণ ও বিশেষজ্ঞ মতামত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতায় জ্বালানি তেলের স্বার্থরক্ষা ও সৌদি-ইসরাইল সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতা আনার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানবিরোধী ঐক্য জোরদার করার লক্ষ্য রয়েছে তার। পাশাপাশি বাইডেন এই অঞ্চলে চীনবিরোধী রাজনীতিকে শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে মার্কিন কর্তৃত্বকে নিরঙ্কুশ করতে চান। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইসরাইল আর আমিরাতের মধ্যে ‘আইটুইউটু’ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করাও তার লক্ষ্য।

বছরের পর বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের সব থেকে বড় ক্রেতাদের একটি হলো সৌদি আরব। প্রধানত নিজেদের অস্ত্র বিক্রি ও জ্বালানি তেলের স্বার্থে মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে সৌদি রাজপরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছে সব মার্কিন প্রশাসন। নাইন ইলেভেনের টুইন টাওয়ার হামলায় সৌদি নাগরিকদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিললেও এ নিয়ে সৌদি আরবকে তেমন কোনো অসুবিধার মুখে পড়তে হয়নি কখনো।

মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোম চমস্কি যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প ধারার সংবাদমাধ্যম ট্রুথ আউটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়ংকর সব রেকর্ড অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি সম্পর্ক সবসময়ই বন্ধুত্বপূর্ণ পথে এগিয়েছে।’

ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাইডেনের সৌদি সফরের প্রধান দুই কারণ হলো, জ্বালানি তেল ও ইসরাইল-সৌদি সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। বাইডেনের প্রতি ইসরাইলের চাওয়া, তিনি যেন আব্রাহাম চুক্তির (যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে স্বাক্ষরিত সহযোগিতা চুক্তি) স্বার্থে এমবিএস ও সৌদি রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেন। গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে হোয়াইট হাউসের এক ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের এবারের থিম হচ্ছে ‘সম্পর্ক স্বাভাবিক করার রোডম্যাপ’। 

বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরে সৌদি আরব ইসরায়েলকে তার আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। এখন সৌদি আকাশসীমা ব্যবহার করে ভারত ও চীনে যাতায়াত করতে পারবে ইসরায়েল।

ইউক্রেন সংকটের পর যুক্তরাষ্ট্রের তেলের বাজারে ভয়াবহ অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বাইডেন বুঝতে পারছেন, বাড়তি সৌদি তেল এখন আমেরিকার জন্য জরুরি। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা মিডল-ইস্ট ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্রায়ান কাটুলিস বলেন, ‘ছেলেমানুষি কাটিয়ে বাইডেনের প্রশাসন অভিজ্ঞ হতে শুরু করেছে। বিষয়টা এমন নয় যে, আপনি এই ব্যক্তিকে (সৌদি যুবরাজ) ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবেন। ফলে জটিল এই পরিস্থিতি যতটা সম্ভব সামাল দিয়ে নিজের স্বার্থ দেখা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে এমন অসংখ্য মার্কিন নীতির নজির রয়েছে।’ অর্থাৎ সৌদি আরবের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গতানুগতিক পররাষ্ট্রনীতির পথে ফিরে গেছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। নোম চমস্কি বলেন, ‘বাইডেনের সৌদি সফর মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের নীতিরই প্রতিধ্বনি।’

ডেমোক্রেসি ফর দ্য আরব ওয়ার্ল্ড নাউয়ের নির্বাহী পরিচালক রাহ লিয়া হুইটসনও এ সফরের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এটা বাইডেনের নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ। আমরা যদি তেলের দামের জন্য আত্মত্যাগ করতে ইচ্ছুক হই, তাহলে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকারের জন্য জঘন্য সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখার দরকার নেই। এর চেয়ে অনেক কম ত্যাগ স্বীকার করেই তা করা সম্ভব।’ তিনি দাবি করেন, রাশিয়ার তেলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এর চেয়ে ভালো সমাধান। 

বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, পানি, জ্বালানি, পরিবহন, মহাকাশ, স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা খাতে যৌথ বিনিয়োগের পাশাপাশি এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাই এই জোটের লক্ষ্য। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চার দেশের নেতারা বলেছেন, তারা দীর্ঘমেয়াদে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ও বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কাজ করবেন। ভারতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত আহমেদ আল-বান্না এই জোটকে ‘ওয়েস্ট এশিয়ান কোয়াড’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই জোটের বাণিজ্যিক সুরক্ষা নিশ্চিত করাও বাইডেনের সৌদি আরব সফরের একটা অন্যতম উদ্দেশ্য বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //