শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে ভারত কি আগ্রহী

শ্রীলঙ্কায় গত কয়েক মাস ধরেই অর্থনৈতিক সংকট চলছে। ২০০৯ সালে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির পর থেকে যে অগ্রগতি হয়েছিল তার অনেকটাই নষ্ট হতে বসেছে।

কিছুদিন আগে সরকার সমর্থক এবং বিরোধী বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়েছে। দেশটিতে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের উপর নাটকীয় নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। সুতরাং যে প্রশ্নটি উঠছে তা হলো এই অবস্থা থেকে উত্তরণ কীভাবে সম্ভব?

এখন শ্রীলঙ্কার বকেয়া বৈদেশিক ঋণ ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি, যার সবচেয়ে বড় অংশ (প্রায় ৪৭ শতাংশ) বাজার থেকে ধার করা হয়েছে। এর বেশিরভাগই আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ডের (আইএসবি) মাধ্যমে, আর বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় দাঁড়িয়েছে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সামান্য বেশি। দেশটি যে তার সব ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হবে, তা ক্রমেই আরও অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। এদিকে শ্রীলংকার এই সংকট ভারতকে কেন প্রভাবিত করবে তার তিনটি প্রাথমিক কারণ রয়েছে: চীন, বাণিজ্য এবং সম্ভাব্য রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা।

শ্রীলঙ্কা ভারতের প্রতিবেশী দেশ। দিল্লি ও কলম্বোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য ও উন্নয়নমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রশ্নে কয়েক বছর ধরে কিছুটা অবহেলা লক্ষ করা গেছে বলে মনে হচ্ছে। ফলে বেইজিং প্রভাবশালী বিদেশি খেলোয়াড় হিসেবে উঠে এসেছে। বিষয়টি এই ঘটনা থেকেই স্পষ্ট যে, ২০১৫ সাল থেকেই চীন ওই দেশের শীর্ষ একক ঋণদাতা এবং প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় উৎস। এমনকি বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও শ্রীলংকা ভারতের চেয়ে চীন থেকে বেশি আমদানি করেছে।

চীন সম্পর্কে ভারতের উদ্বেগ শ্রীলঙ্কায় চীনা বিনিয়োগের প্রকৃতি এবং এই সংকটের প্রেক্ষাপটে এর অর্থ কী হতে পারে তা থেকে উদ্ভূত। রাজনৈতিক ‘কিকব্যাক’-এর বিনিময়ে পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ এবং পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের প্রশ্নে প্রয়োজনীয় স্বচ্ছতার অভাবের জন্য প্রায়শই সমালোচিত শ্রীলংকায় চীনা বিনিয়োগগুলো; কিন্তু ঋণের ন্যায্যতা প্রমাণ করতে পারেনি। অর্থাৎ সেগুলো থেকে যে ধরনের স্থানীয় কর্মসংস্থান বা রাজস্ব প্রত্যাশিত ছিল তার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে প্রায়শই শ্রীলঙ্কা সরকার ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে এবং তার বিনিময়ে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থিত হাম্বানটোটার মতো বন্দর বা শহরাঞ্চল চীনকে হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা চীনা বিনিয়োগের বিনিময়ে জমি ইজারা দিয়েছে। যেমন- পোর্ট সিটি অব কলম্বো প্রকল্পের ক্ষেত্রে বেইজিং ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের বিনিময়ে ১০০ হেক্টরের বেশি জমি নিয়েছে। এ ধরনের ব্যবস্থার মাধ্যমে চীন সে দেশে ক্রমশ বেশি করে পা রাখার জায়গা পেয়েছে। এখন অর্থনৈতিক সংকট আরও বাড়তে থাকায় শ্রীলঙ্কা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থিত বন্দর শহরগুলোতে তার আরও বেশি ভূমির নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার কিছু ব্যস্ততম শিপিং রুটের সান্নিধ্যের কারণে এই অঞ্চলে বৃহত্তর চীনা উপস্থিতি ভারতের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষ করে ভারত দ্বীপরাষ্ট্রটিকে তার ‘প্রভাব ক্ষেত্র’-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করে।

স্বল্পমেয়াদে আসন্ন সংকটের কারণে কলম্বো বন্দরের স্বাভাবিক কাজকর্মে যে কোনো বড় ব্যাঘাত ভারতের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হবে। কারণ সেখান দিয়ে ভারতের ৩০ শতাংশের বেশি কনটেইনার ট্রাফিক যাতায়াত করে এবং ৬০ শতাংশ ট্রান্স শিপমেন্ট সেখানেই হয়। শ্রীলঙ্কা ভারতীয় রপ্তানির একটি প্রধান গন্তব্য এবং দেশটি ভারত থেকে বার্ষিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য ক্রয় করে। অর্থনৈতিক সংকট আরও গভীর হলে ভারতীয় রপ্তাানিকারকদের উপর তার বড় প্রভাব পড়বে এবং তাদের পণ্যের বিকল্প বাজার খুঁজে বের করতে হবে। বাণিজ্য ছাড়াও রিয়েল এস্টেট, উৎপাদন, পেট্রোলিয়াম পরিশোধন ইত্যাদি ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কায় ভারতের যথেষ্ট বিনিয়োগ রয়েছে, যা সবই সংকটের কারণে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

সরকারি কর্মকর্তাদের ধারণা, এই সংকট চলতে থাকলে দুই হাজারের বেশি ‘অর্থনৈতিক শরণার্থী’ ভারতে চলে আসতে পারে এবং এটি ভারতের জন্য একটি বড় উদ্বেগের কারণও এ মুহূর্তে। বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও ভূ-রাজনীতির পাশাপাশি বর্তমান সংকট থেকে উদ্ভূত তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও ভারতের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হতে পারে। গত কয়েক সপ্তাহে বহু মানুষ শ্রীলঙ্কা থেকে ভারতে পালিয়ে এসেছেন। শরণার্থীদের সংখ্যায় কোনো উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি জননিরাপত্তা ও শরণার্থী পুনর্বাসনের বিষয়ে রাষ্ট্রের উদ্বেগের কারণ হতে পারে। সাধারণ সম্পদের ব্যবহার নিয়ে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে। তা ছাড়া এর থেকে তামিল-সিংহলি দ্বন্দ্বের (শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধের দিনগুলো থেকে) প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা থাকবে এবং ভারতে এর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কাও থাকবে। অতএব, ভারতকে নিজের স্বার্থেই শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের দ্রুত অবসান নিশ্চিত করতে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে।

যাদের কাছে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বেশি ঋণ রয়েছে এমন দেশের তালিকায় চীন ও জাপানের পরেই তৃতীয় স্থানে আছে ভারত। কাজেই এই প্রয়োজনের সময়ে দ্বীপরাষ্ট্রটিকে তার আর্থিক প্রতিশ্রুতি পূরণে সহায়তা করার ক্ষেত্রে ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাকে অবশ্যই শ্রীলংকাকে ঋণ পরিশোধের কিস্তি কিছুকাল স্থগিত রাখার সুযোগ দিতে হবে। অথবা ঋণ পুনর্গঠনের বিকল্প বিবেচনা করতে দিতে হবে। এটি কলম্বোকে শুধু খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির মতো মানুষের তাৎক্ষণিক চাহিদা মেটানোর জন্য তার সীমিত রাজস্ব বরাদ্দ করতেই সাহায্য করবে না, বরং দেশটির নেতৃত্বের মধ্যে কিছু অতি প্রয়োজনীয় সদিচ্ছা তৈরিতেও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। ফলে কোনো না কোনোভাবে বছরের পর বছর ধরে বিপুল চীনা বিনিয়োগের প্রভাব ক্ষুণ্ণ করা সম্ভব হবে। তা ছাড়া ঋণ পুনর্গঠনের কথা বিবেচনা করার জন্য শ্রীলঙ্কার অনুরোধ চীন প্রত্যাখ্যান করার পটভূমিতে এই ধরনের পদক্ষেপ ওই দেশের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব সাদরে গ্রহণ করার সম্ভাবনা রয়েছে। 

দীর্ঘ মেয়াদে, ভারতকে দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রয়োজনীয় যে কোনো সহায়তা প্রদানের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যেহেতু চীনের উপর শ্রীলঙ্কার নির্ভরতা হ্রাস করাই ভারতের স্বার্থসম্মত, তাই দ্বীপরাষ্ট্রটিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করতে অবদান রাখতে হবে। বর্তমানে এখানে শুরু করার জন্য একটি ভালো জায়গা হবে দিল্লি ও কলম্বোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ। এর অর্থ হলো দুই দেশের মধ্যে বৃহত্তর বাণিজ্যভিত্তিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করার জন্য চুক্তির কিছু মূল অন্তর্ভুক্তির শর্তাবলি নিয়ে পুনরায় আলোচনার সুযোগ রয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে এই মুহূর্তে সংকট যাতে আরও খারাপ জায়গায় না পৌঁছায় তার জন্য ভারতকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //