ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানির সমঝোতা কি স্বস্তি আনবে

গত ২২ জুলাই ইস্তাম্বুলে তুরস্ক ও জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ইউক্রেনের আটকে পড়া খাদ্যশস্য বিশ্বের বাজারে রপ্তানি করার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা হয়। এই সমঝোতা অনুযায়ী চার মাসের জন্যে ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানি করা সম্ভব হবে। ইউক্রেনের বন্দরগুলোতে অনেকগুলো জাহাজ প্রায় ৫ লাখ টন শস্য ও ভোজ্যতেল নিয়ে অপেক্ষা করছে। 

বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, প্রথমত এই সমঝোতার ফলে ইউক্রেন শস্য বিক্রি করে অতি দরকারি অর্থ পাবে; দ্বিতীয়ত এই শস্য দুনিয়ার সবচাইতে দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলগুলোতে সরবরাহ করা যাবে; তৃতীয়ত এটা ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে প্রথম কূটনৈতিক পদক্ষেপ। অনেকেই এই চুক্তিকে বিশাল একটা বিজয় হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল ‘একে পার্টি’ এবং ওয়াশিংটনে জো বাইডেনের মার্কিন প্রশাসন এই পদক্ষেপকে বৈশ্বিক মানবতার জন্য একটা বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখতে চাইছে। তবে অনেকেই এই সমঝোতাকে দ্রুত সফল হিসেবে দেখানোর ব্যাপারে প্রশ্ন তুলছেন। 

সমঝোতার ঠিক আগে আগেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) রাশিয়ার উপর অবরোধের ব্যাপ্তিকে পরিবর্তন করেছে। ১৪ জুলাই মার্কিন বাণিজ্য দপ্তর খাদ্যশস্য, কৃষি যন্ত্রপাতি, ওষুধ ও মেডিক্যাল যন্ত্রপাতির উপর থেকে অবরোধ তুলে নেয়। এর পাঁচ দিন পর ইইউ কিছু ব্যাংকের উপর থেকে অবরোধ সরিয়ে নেয়, যারা রাশিয়ার সঙ্গে খাদ্যশস্য, সার ও অন্যান্য কৃষিজ দ্রব্যের বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত।

ব্রাসেলসভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, ২৩ জুলাই ইউক্রেনের ওডেসা বন্দরে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা দেখিয়ে দিচ্ছে, এই শস্য রপ্তানির সমঝোতাকে রাশিয়া তার যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দেখতে চায় না। আর এই সমঝোতায় রাজি হওয়ার পুরস্কার হিসেবে জাতিসংঘ রাশিয়ার সঙ্গে আলাদাভাবে আরেকটা চুক্তি করেছে, সেই মোতাবেক রাশিয়াও তার শস্য ও রাসায়নিক সার পশ্চিমা অর্থনৈতিক অবরোধ এড়িয়ে বিশ্ব বাজারে বিক্রি করতে পারবে। ক্রেমলিন এই চুক্তিকে রাশিয়ার জন্য একটা বড় বিজয় হিসেবেই দেখছে। 

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক দ্য আটলান্টিক কাউন্সিলের এক লেখায় ইউক্রেনের পার্লামেন্ট সদস্য ওলেকসি গোঞ্চারেঙ্কো বলছেন, এই সমঝোতার পরও সবাইকে রুশ ‘ব্ল্যাকমেইল’ মোকাবিলা করতেই হবে। তার মতে, যদি পশ্চিমারা হুমকি দেয় যে, শস্য রপ্তানি বন্ধ করে দিতে চাইলে পশ্চিমারা কৃষ্ণ সাগরের রুশ নৌবহরকে ধ্বংস করে দেবে, শুধু তাহলেই রাশিয়া হয়তো এই সমঝোতাকে বাস্তবায়িত হতে দেবে। তিনি ইউক্রেনের জন্য পশ্চিমাদের আরও অস্ত্র সরবরাহের মাঝেই শস্য রপ্তানির সমুদ্রপথ খোলা রাখার সমাধান দেখছেন।

কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের এক লেখায় রুশ বিশ্লেষক আলেক্সান্দ্রা প্রোকোপেঙ্কো বলছেন, এই সমঝোতা রাশিয়ার জন্য অনেক সুবিধা বয়ে আনলেও রাশিয়া বুঝিয়ে দিচ্ছে, একটা বিষয়ে ছাড় দেওয়ার অর্থ এই নয় যে, তারা পুরো ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্র নিজেদের অবস্থানকে নরম করেছে। মস্কো যে কোনো সময়েই এই সমঝোতা থেকে বের হয়ে যেতে পারে। তবে অবরোধকে বাইপাস করার মাধ্যমে রাশিয়া তার নিজস্ব কৃষি খাতের জন্য যন্ত্রপাতি আমদানির চেষ্টা করতে পারে। ২০২১ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার ৭৫ শতাংশ কৃষি যন্ত্রপাতি জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস থেকে আসত। 

গবেষণা সংস্থা গ্রো ইন্টেলিজেন্সের জ্যেষ্ঠ গবেষক জনাথন হাইন্স বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেন, প্রথম জাহাজে করে লেবাননে যে ২৬ হাজার টন ভুট্টা রপ্তানি করা হয়েছে, তা প্রকৃতপক্ষে দুই কোটি টন শস্যের তুলনায় নিতান্তই তুচ্ছ। তুচ্ছ পরিমাণ সরবরাহের অর্থ হলো এর ফলে বিশ্বের বাজারে খাদ্যশস্যের মূল্য কমে যাচ্ছে না; অথবা বৈশ্বিক খাদ্য সমস্যার সমাধানও দ্রুত হচ্ছে না। আর ইউক্রেনে আটকে পড়া বেশিরভাগ শস্যই হলো জীবজন্তুর খাবার; মানুষের খাবার নয়। এই পরিস্থিতি আফগানিস্তান ও সোমালিয়ার মতো অঞ্চলের মানুষের ক্ষুধাকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দেবে। ওই অঞ্চলের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতির কারণে খাদ্য ও জ্বালানি মানুষের সামর্থ্যরে বাইরে চলে গেছে। মানবাধিকার সংস্থা মার্সি কোর বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আটার মূল্য ২০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ১৫০ মিলিয়ন ডলারের ঋণের উপর ভর করে দেশটা ৬ থেকে ৯ মাসের জন্য শস্য কিনছে। ইউক্রেনের শস্য রপ্তানি কোনো চ্যারিটি নয়। কাজেই মানবিক চাহিদা নয়, বরং যেখানে ভালো মূল্য পাওয়া যাবে, সেখানেই এই শস্য বিক্রি হবে। এ কারণেই প্রথমে শস্য পাওয়াটা নির্ভর করবে মানবিকতার উপর নয়, বরং ব্যবসায়িক স্বার্থের উপর। 

ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়েই শস্য রপ্তানির সমঝোতা থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ এড়ানোর সুবিধা নিতে চাইছে; কেউই এখানে চ্যারিটি করছে না। অপরদিকে আইসিজির বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, তুরস্কের ক্ষমতাসীন ‘একে পার্টি’ আশা করছে- ২০২৩ সালের নির্বাচনের আগে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানির সমঝোতা তাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে।

তবে অন্যরা মনে করছে, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান পররাষ্ট্রনীতির সফলতা দেখিয়ে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা থেকে মানুষের দৃষ্টি সড়াতে চাইছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ তাদের নিজ অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে রাশিয়াকে ছাড় দিয়েছে। কিন্তু যেহেতু এই সমঝোতার কারণে খাদ্যশস্যের আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা এখনই দূরীভূত হয়ে যাচ্ছে না এবং রাশিয়া যেহেতু এই সমঝোতার দীর্ঘমেয়াদি নিশ্চয়তা দেয়নি, তাই যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের জন্য এখনই উল্লসিত হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। অপরদিকে দরিদ্র দেশগুলোর জনগণের সামনে ব্যাপক মূল্যস্ফীতির চাপ ও ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের মাঝে কৃষ্ণ সাগরের শস্য রপ্তানির সমঝোতা খুব কমই স্বস্তি বয়ে আনবে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //