তুরস্ক-গ্রিস উত্তেজনা কোন দিকে

গত ১৩ সেপ্টেম্বর তুরস্কের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সমুদ্রে ডুবে পাঁচ শিশুসহ ছয় অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। তুর্কি কোস্টগার্ড এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা লেবানন থেকে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করছিল। এছাড়া আরও ৭৩ জনকে তুর্কিরা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। 

লেবানন থেকে রওনা হয়ে তুরস্কের উপকূলের কাছে গ্রিক মালিকানায় থাকা রোডস দ্বীপের কাছে এসে তারা জ্বালানি নেওয়ার চেষ্টা করে। তুর্কিরা বলছে, অভিবাসীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে গ্রিক কোস্টগার্ড তাদের কাছে যায় ঠিকই; কিন্তু তাদেরকে চারটা লাইফ বোটে তুলে দিয়ে তুর্কি উপকূলের কাছে ছেড়ে দেয়। তবে গ্রিক কোস্টগার্ড এক বিবৃতিতে এই ঘটনাটা পুরোপুরিভাবে অস্বীকার করে। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ব্যাপারে তুরস্ক ও গ্রিসের নীতি সাংঘর্ষিক অবস্থানে থাকায় তা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে চাপের মাঝে ফেলেছে। 

এর মাত্র দুদিন আগে গ্রিক কোস্টগার্ড ইজিয়ান সাগরের তুর্কি দ্বীপ বজকাদার ২০ কিলোমিটার দূরে আন্তর্জাতিক সমুদ্রে একটা তুর্কি পরিবহন জাহাজকে লক্ষ্য করে গুলি করে। গ্রিক কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা তুর্কি দ্বীপ বজকাদার প্রায় ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে গ্রিক দ্বীপ লেসবসের কাছাকাছি জাহাজটাকে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখে সাবধান করার জন্য গুলি ছোড়ে। যেহেতু ইজিয়ান সাগর দিয়ে যাওয়া অনেক জাহাজেই ইউরোপ অভিমুখে যাওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীরা থাকে, তাই তারা অনেক সময়েই সন্দেহজনক মনে হলে জাহাজের উপর নজরদারি করে থাকে। 

আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তুরস্কের কথায়- গ্রিকরা ইজিয়ান সাগরের ক্রিট দ্বীপে রাশিয়া নির্মিত ‘এস-৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করে তুর্কি যুদ্ধবিমানগুলোকে হুমকির মাঝে রাখছে; যা গ্রিকরা অস্বীকার করেছে। এছাড়াও গ্রিক যুদ্ধবিমানও ইজিয়ান সাগরে তুর্কি যুদ্ধবিমানকে হুমকি দিয়েছে। তুরস্ক এও অভিযোগ করেছে, গ্রিকরা তুরস্কের কুর্দি বিদ্রোহী গ্রুপ পিকেকের সদস্যদেরকে গোপনে সামরিক ট্রেনিং দিচ্ছে; যা তারা গ্রেপ্তার হওয়া পিকেকে সদস্যদের কাছ থেকে জানতে পেরেছে। অপরদিকে গ্রিকরা বলছে, ইজিয়ান সাগরে গ্রিসের মালিকানায় থাকা রোডস এবং কস দ্বীপের মতো দ্বীপগুলো পর্যটন শিল্পের জন্যে গ্রিসের কাছে গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু সেই দ্বীপগুলো যেখানে গ্রিক মূল ভূখণ্ড থেকে অনেক দূরে, সেখানে সেগুলো তুরস্কের মূল ভূখণ্ড থেকে মাত্র পাঁচ থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। গ্রিকরা এই দ্বীপগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইছে।

গত ৩ সেপ্টেম্বর তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়েপ এরদোয়ান গ্রিক বিমানের তুর্কি আকাশসীমানা লঙ্ঘনের অভিযোগ করে বলেন, যদি গ্রিকরা ইজিয়ান সাগরে তুর্কি বিমানকে হুমকি দিতে থাকে, তাহলে গ্রিকদেরকে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। অপরদিকে গ্রিক প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিতসোতাকিস বলেন, তুর্কি প্রেসিডেন্টের বক্তব্য মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। তবে তিনি উত্তেজনা হ্রাসে তুর্কি নেতার সঙ্গে আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক। তিনি ইঙ্গিত দেন, অক্টোবরে ইইউয়ের বৈঠকে হয়তো এরকম একটা সুযোগ তৈরি হতে পারে।     

সপ্তাহখানেক আগে গ্রিক সরকার ন্যাটো, ইইউ ও জাতিসংঘের কাছে চিঠি দিয়ে তুর্কি আগ্রাসী মনোভাবের নিন্দা জানাতে অনুরোধ করে। চিঠিতে আশঙ্কা করা হয়, এহেন পরিস্থিতি সামরিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে। গ্রিকরা তাদের সমর্থন পাচ্ছে ফ্রান্সের কাছ থেকে। গ্রিক সিটি টাইমসের এক খবরে বলা হচ্ছে যে, গ্রিক প্রধানমন্ত্রী মিতসোতাকিস প্যারিস সফর করার সময় ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর কাছ থেকে সমর্থন পান। ১২ সেপ্টেম্বর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ম্যাক্রোঁ বলেন, তুরস্কের বিবৃতি ও কর্মকাণ্ড একবারেই অগ্রহণযোগ্য এবং পাশাপাশি তিনি গ্রিসের সঙ্গে ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতার ব্যাপারে সন্তোষ প্রকাশ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রান্স গ্রিকদেরকে ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান সরবরাহ করেছে এবং নৌবাহিনীর জন্য ফ্রিগেট দিচ্ছে; সঙ্গে ঋণ সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে।  

দুই ন্যাটো সদস্য দেশের মাঝে উত্তেজনা ন্যাটোর ঐক্যের মাঝেও প্রশ্ন তুলেছে। ন্যাটোর অফিশিয়াল টুইটার বার্তায় ১৯২২ সালে দখলদারি গ্রিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভের শততম বার্ষিকীতে তুরস্ককে অভিনন্দন জানানোর পর গ্রিকরা প্রতিবাদ করে। ফলস্বরূপ ন্যাটো সেই বার্তা মুছে ফেললে তুর্কিরা নাখোশ হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, দুই ন্যাটো সদস্যের দ্বন্দ্ব মোটেই সুবিধা বয়ে আনবে না। আর ইজিয়ানের দ্বীপগুলোর উপর গ্রিসের সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে কোনো প্রশ্নই নেই। সাবেক মার্কিন সহকারী প্রতিরক্ষা সচিব জিম টাউনসেন্ড ‘ভয়েস অব আমেরিকা’কে বলেছেন, এই মুহূর্তে দুই দেশের উত্তেজনা নিরসনে কারও মধ্যস্থতার প্রয়োজনে দেশ দুটির কেউ যদি নিজেদের পক্ষ সমর্থনে ন্যাটোকে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়, তাহলে ন্যাটোর ঐক্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আর এই অনৈক্যকে মস্কো ব্যবহার করতে চাইবে। 

ন্যাটোর সাবেক সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা মার্কিন জেনারেল ফিলিপ ব্রিডলাভ বলেন, যদিও দুই দেশের উত্তেজনা নতুন নয়, তথাপি তুরস্কের নেতৃত্ব দেশটাকে এমন একটা দিকে নিয়ে যেতে চাইছে, যা কিনা বর্তমানে দুই দেশের সম্পর্ককে আবারও টানাপড়েনের মাঝে ফেলেছে। তবে যেহেতু দুই দেশেরই সামনে নির্বাচন, তাই উত্তেজক কথাগুলো হয়তো কিছুটা হলেও অভ্যন্তরীণ জনগণকে টার্গেট করে বলা হচ্ছে। 

দুই দেশের সাম্প্রতিক নির্বাচন এই দ্বন্দ্বে ইন্ধন জোগালেও তুরস্ক ও গ্রিসের দ্বন্দ্ব তাদের জন্মকাল থেকেই। ইজিয়ান সাগরের প্রায় সবগুলো দ্বীপই পশ্চিমারা গ্রিসকে বিভিন্ন সময়ে দিয়েছে। যে কারণে ইজিয়ান সাগরের প্রায় পুরোটাই গ্রিসের হাতে; যা নিয়ে তুরস্ক গ্রিসের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে তুরস্ক পশ্চিমাদের জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আজকে ততটা নয়। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয়রা তুরস্ককে সামরিক প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখতে পারছে এবং গ্রিসের পক্ষও নিতে পারছে।

ফ্রান্স ইতোমধ্যেই তুরস্ককে ব্যালান্স করতে গ্রিসকে সামরিক সহায়তাও দিচ্ছে। অপরদিকে রাশিয়ার উপর পশ্চিমা অবরোধের মাঝেও দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছে তুরস্ক। ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝেও ন্যাটোর সদস্যদেশগুলোর সাংঘর্ষিক লক্ষ্য সংস্থার ঐক্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //