পেলোসির আর্মেনিয়া সফরের গুরুত্ব কতটুকু

যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি গত ১৮ সেপ্টেম্বর আজারবাইজান ঘুরে এসেছেন। তার এই সফরের সময়টা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; কারণ এর কিছুদিন আগে ১৩-১৪ সেপ্টেম্বর আজারবাইজান তার প্রতিবেশী দেশ আর্মেনিয়ার সঙ্গে দুদিনের একটা সীমান্ত যুদ্ধ শেষ করেছে। 

সফরকালে তিনি সাম্প্রতিক যুদ্ধকে আর্মেনিয়ার উপর আজারবাইজানের ‘বেআইনি ও মারাত্মক হামলা’ বলে উল্লেখ করেন; যদিও উভয় পক্ষই এই যুদ্ধ শুরুর জন্য অপরপক্ষকে দায়ী করেছে। আজারবাইজানের হামলায় প্রায় ২০০ মানুষ নিহতের ঘটনায় কঠোর নিন্দা জানান তিনি। পেলোসি যখন এই কথাগুলো বলছিলেন, তখন তার পাশে ছিলেন আর্মেনিয়ার পার্লামেন্টের স্পিকার আলেন সিমোনিয়ান; যিনি আজারবাইজানের সঙ্গে সামরিক দ্বন্দ্বে রাশিয়ার সহয়তা না পাওয়ায় নাখোশ হয়েছেন। রুশ বার্তা সংস্থা ‘ইন্টারফ্যাক্স’ বলছে, আলেন এর আগের সপ্তাহে রুশদের সঙ্গে সামরিক চুক্তিকে গুলি করতে না পারা পিস্তলের তুলনা করেছেন; যা কিনা দরকারের সময়ে কাজে লাগে না।

উল্লেখ্য, অর্থোডক্স খ্রিষ্টান আর্মেনিয়া রাশিয়ার অনেক পুরনো বন্ধু এবং রাশিয়ার সঙ্গে আর্মেনিয়ার সামরিক চুক্তি রয়েছে- আর্মেনিয়ার উপর সামরিক হামলা হলে রাশিয়ার সরাসরি হস্তক্ষেপ করার কথা। এর আগে গত আগস্টেই ৮২ বছর বয়সী পেলোসি তার রাজনৈতিক জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তাইওয়ান সফর করে চীনকে ক্ষেপিয়েছেন। এখন তার আর্মেনিয়া সফরকে অনেকেই দেখছেন রাশিয়ার একটা পুরনো বন্ধুকে ওয়াশিংটনের দিকে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা হিসেবে; বিশেষ করে মস্কো যখন ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত। 

পেলোসি বলেন, আজারবাইজান যে এই যুদ্ধ শুরু করেছে, সে ব্যাপারে কথা বলা প্রয়োজন। তার এই কথায় আজারবাইজানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, আজারবাইজানের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন ও অন্যায্য অভিযোগ তিনি করেছেন, তা মেনে নেওয়া যায় না। এই ঘটনা আর্মেনিয়ার সঙ্গে আজারবাইজানের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। পেলোসি সবসময়ই আর্মেনিয়াঘেঁষা একজন রাজনীতিবিদ বলে পরিচিত। আর তিনি তার সফরসঙ্গী হিসেবে তেমনই কংগ্রেস সদস্যদেরকে নিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, বিবৃতিতে আরও বলা হয়, পেলোসি ন্যায়ের কথা বললেও আজেরি এলাকা আর্মেনীয়রা যে প্রায় ৩০ বছর ধরে দখলে রেখেছিল এবং আজেরিদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ চালানো ছাড়াও তাদেরকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করেছিল, সে বিষয়ে তিনি কিছুই বলেননি। পেলোসির বক্তব্যে ওই এলাকায় শান্তির পরিবর্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে।

এদিকে ‘রয়টার্স’ মনে করিয়ে দিচ্ছে, পেলোসি যেভাবে আজারবাইজানকে যুদ্ধের জন্য দায়ী করেছেন, তা ওয়াশিংটনের অফিসিয়াল বক্তব্যের বিপরীতে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন এক বার্তায় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং পরবর্তী সময় ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভকে ফোন করে অস্ত্রবিরতি বাস্তবায়ন করার অনুরোধ করেন এবং আলোচনার মাধ্যমে আর্মেনিয়ার সঙ্গে সমস্যার সমাধান করার কথা বলেন। 

আজারবাইজানের রাজধানী বাকুর থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার অব অ্যানালিসিস অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স’-এর ফরিদ শাফিইয়েভ বলেন, পেলোসি আর্মেনিয়ায় এসেছেন মূলত আসন্ন মধ্যবর্তী নির্বাচনে আর্মেনীয়দের সমর্থন পেতে। ক্যালিফোর্নিয়াতে তার নির্বাচনী এলাকায় আর্মেনীয়দের প্রভাব যথেষ্ট। অপরদিকে ইয়েরেভানের থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রিজিওনাল স্টাডিজ সেন্টার’-এর ডিরেক্টর রিচার্ড জিরোগোসিয়ান বলেছেন, ককেশাসে মার্কিনিদের ফোকাস বৃদ্ধি শুধু ভূরাজনৈতিক কারণে নয়, আদর্শিক কারণেও। এটা শুধু রাশিয়ার কারণে নয়, আর্মেনিয়ার কারণেও। পেলোসির সফর হয়তো মার্কিন নীতিতে পরিবর্তনের একটা শুরু। 

আফগানিস্তানে মার্কিনদের অবস্থানের সময় আজারবাইজান যুক্তরাষ্ট্রের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু হিসেবে কাজ করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আজারবাইজানের কাছের বন্ধু হলো তুরস্ক। ২০২০ সালে আর্মেনিয়ার সঙ্গে ৪৪ দিনের যুদ্ধে জয়ের পেছনে আজারবাইজানকে সহায়তা দিয়েছিল তুরস্ক। অপরদিকে রাশিয়া ককেশাস এলাকাকে তার নিজের উঠান মনে করে থাকে। আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের সীমানায় যুদ্ধবিরতি পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব হলো রুশ শান্তিরক্ষী বাহিনীর। তবে ২০১৮ সালে ‘ভেলভেট রেভ্যুলেশন’-এর মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ানের সরকারকে পশ্চিমারা গণতান্ত্রিক উত্থানের ফলাফল হিসেবেই দেখেছে। পেলোসি তার সফরের সময় আর্মেনিয়ার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা স্মরণ করিয়ে মার্কিন সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেন। 

‘পলিটিকো’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভানে পেলোসির সফরের সময়ে অনেকেই প্রকাশ্যে রাশিয়াবিরোধী বার্তা দেয়। কেউ কেউ পুতিনের ছবি সংবলিত বিলবোর্ড নামিয়ে ফেলে। রুশ সাংবাদিকদেরও হেনস্তা হতে হয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। আর্মেনীয়দের মাঝে অনেকেই মনে করা শুরু করেছে যে, রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব আর্মেনিয়াকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। অপরদিকে আজারবাইজান তুরস্কের সহায়তায় দিনে দিনে শক্তিশালী হচ্ছে। এমতাবস্থায় অনেকেই ওয়াশিংটনের দিকে ঝুঁকতে চাইছে। 

প্রায় তিন দশক আর্মেনিয়ার সঙ্গে সামরিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও ২০২০ সালের যুদ্ধের পর থেকে আজারবাইজান তার নিজস্ব সামরিক সক্ষমতার ব্যাপারে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। সেপ্টেম্বরের দুদিনের যুদ্ধ আজারবাইজানকে একটা ধারণা দিয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে রুশরা আর্মেনিয়াকে রক্ষায় কতটুকু ভূমিকা নিতে পারে।

বর্তমান অস্ত্রবিরতির উপর কেউই আস্থা রাখতে পারছে না। আজারবাইজান যখন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করছে এবং তুরস্কের সহায়তায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) গ্যাস রপ্তানির মাধ্যমে ভূরাজনীতিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চাইছে, তখন আর্মেনিয়রাও অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝোঁকার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, আর্মেনিয়ার সঙ্গে আজারবাইজানের দুদিনের যুদ্ধ এবং পেলোসির আর্মেনিয়া সফর ককেশাসে আরেক দফা উত্তেজনার দ্বার উন্মুক্ত করল। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //