ফ্রান্স ও জার্মানি: বন্ধু, না প্রতিযোগী?

অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে প্যারিসে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোন এবং জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের বৈঠকের দিকে তাকিয়ে ছিল পুরো ইউরোপ। পলিটিকোর প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই নেতা বৈঠকে একমত হয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ইউরোপকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।  

বৈঠকে তারা আরও আলোচনা করেন, যুক্তরাষ্ট্র তার ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্টের মাধ্যমে কর্পোরেটদের ওপর থেকে কর কমিয়ে দিয়ে এবং জ্বালানিতে ভর্তুকি দিয়ে নিজ দেশে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চাইছে। শুধু তাই নয়; এই আইনের মাধ্যমে মার্কিন ভোক্তাদের বলা হচ্ছে- তারা যেন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি করা ইলেকট্রিক গাড়ি কেনে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ইউরোপের গাড়ি বিক্রি করা অনেক কঠিন হয়ে যাবে। 

গত ২৬ অক্টোবর ফরাসি টিভি চ্যানেল ‘ফ্রান্স ২’ -কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ম্যাক্রোন বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) উচিত ইউরোপের ভোক্তারা যাতে ইউরোপে তৈরি জিনিস কেনে- এমন আইন প্রণয়ন করা এবং ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা করা। তিনি প্রশ্ন করেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই যখন নিজেদের বাজারকে সুরক্ষা দিচ্ছে, তখন ইইউর কেন মুক্তবাজার থাকবে? এক সপ্তাহ আগে জার্মান চ্যান্সেলরও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের নতুন আইন নিয়ে গভীরভাবে কথা বলতে হবে।

তবে পলিটিকো বলছে, ইইউ যদি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, তা হলে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে নতুন করে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। ইইউ কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ইইউ যে পদক্ষেপই নিক না কেন, সেটা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আইনের সঙ্গে যেতে হবে। ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে না ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ের মতো আবার বাণিজ্যযুদ্ধে পতিত হওয়া। 

তবে দুই দেশের এই একাত্মতা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি; বিশেষ করে জ্বালানি ও প্রতিরক্ষানীতির বিষয়ে ফ্রান্স ও জার্মানির বিরোধ এখনো পরিষ্কার। অক্টোবরে অনুষ্ঠিতব্য ফ্রাঙ্কো-জার্মান মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক হঠাৎ করেই আগামী বছরের জানুয়ারিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নিজস্ব স্বার্থ নিয়ে যখন ফ্রান্স ও জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষি করতে চাইছে, তখন সেই স্বার্থের দ্বন্দ্বই জার্মানি ও ফ্রান্সের সম্পর্কের মাঝে দাগ টেনেছে।

ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি সংকটের মাঝে জার্মানি গ্যাসের ওপরে ১৯৭ বিলিয়ন ডলারের ভর্তুকির ঘোষণা দিয়েছে। একইসঙ্গে ইইউয়ের সদস্য দেশগুলো যখন গ্যাসের মূল্যের ওপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার কথা বলেছে, তখন জার্মানি তা এড়িয়ে গেছে। এ ছাড়াও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রে সমঝোতা নিয়েও জার্মানির সঙ্গে ফ্রান্সের টানাপড়েন চলছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে জার্মানি তার সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করার ঘোষণা দিলেও তা ইউরোপীয় নেতাদের খুশি করতে পারেনি। কারণ এই বাজেট বৃদ্ধির সুবিধা পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপীয় বা ফরাসি অস্ত্র না কিনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘এফ-৩৫’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান এবং ‘প্যাট্রিয়ট’ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনছে জার্মানি। 

ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ইইউয়ের মূল চালিকাশক্তি হলো ফ্রান্স ও জার্মানি। এই দুই দেশের মাঝে বিরোধ ইইউয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। প্যারিসে দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকও বিশ্লেষকদের খুশি করতে পারেনি। জার্মান থিঙ্কট্যাঙ্ক ফ্রাঙ্কো জার্মান ইনস্টিটিউটের (ডিএফআই) ডেপুটি ডিরেক্টর স্টেফান সাইডেনডরফ বলেন, যদিও দুই দেশের মন্ত্রীর বৈঠকে বড় কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, তথাপি এই বৈঠক ইইউয়ের কর্মকাণ্ড ঠিকভাবে চলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৩ সালে প্রথম বৈঠকের পর থেকে ২০২২ সাল ছাড়া আর কখনই এই বৈঠক বাতিল করা হয়নি। 

যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্রনীতিতে নিজের ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং মনে করতে পারে যে, বাকিরা তাকে অনুসরণ করবে; কিন্তু ইউরোপের ব্যাপারটা আলাদা। এখানে কেউই অপরের কথা চিন্তা না করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ইইউয়ের সবচেয়ে বড় দুই দেশ

- ফ্রান্স ও জার্মানি আলোচনা করে একটা সমঝোতায় পৌঁছায়; যা বাকি ইউরোপীয় দেশগুলো অনুসরণ করে।   

জার্মানি জ্বালানিতে যে ভর্ভুকির ঘোষণা দিয়েছে, তা ফ্রান্সকে জানানোটা ছিল একটা সাধারণ ভদ্রতা; কারণ এতে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হবে। অপরদিকে স্পেনের সঙ্গে গ্যাস পাইপলাইনের একটা চুক্তি করেছে ফ্রান্স, যার মাধ্যমে বার্সেলোনা থেকে মার্সেই পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ হবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ফ্রান্স ও স্পেনের মাঝে আরেকটা প্রকল্প বাইপাস করা হলো, যা পিরেনিজ পর্বতের মাঝ দিয়ে ফ্রান্স হয়ে জার্মানি পর্যন্ত যেত। এ ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে জার্মানিসহ ন্যাটোর ১৫টি দেশ ইউরোপিয়ান স্কাই শিল্ড ইনিশিয়েটিভ (ইএসএসআই) নামে একটি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছায়। ফ্রান্সকে এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তবে ইতালির সঙ্গে ফ্রান্স যৌথভাবে ‘মামবা’ নামে একটা যৌথ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করছে।  

যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ফ্রান্স-জার্মানির দূরত্ব বৃদ্ধিতে ইন্ধন দিলেও বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মার্কিননীতি প্যারিস ও বার্লিনকে এক করছে। তবে বাণিজ্য ইস্যুতে এক হলেও ইইউয়ের সমন্বিত নীতি সহজ নয়। কারণ ইউরোপের এই দুই বড় দেশের স্বার্থ যে ভিন্নমুখী, তা দুই দেশের জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা নীতিতে পরিষ্কার। স্টেফান বলেন, জার্মানি চাইছে ইউরোপের ছোট দেশগুলোকে নিজের পক্ষে এনে ফ্রান্সকে বাইপাস করতে। অপরদিকে ফ্রান্স চাইছে, ফ্রান্সের নীতির সঙ্গে জার্মানি একমত পোষণ করে ইউরোপের মাঝে সহযোগিতা বৃদ্ধি করুক। ম্যাক্রোন পুরো ইউরোপের একটা বাজেট, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী এবং করব্যবস্থার ব্যাপারে বলছেন। 

বার্লিনের থিঙ্কট্যাঙ্ক জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের সিনিয়র ফেলো রনইয়া কেমপিন বলেছে, ম্যাক্রোন সর্বদাই ইইউয়ের বর্ধিতকরণের বিরোধিতা করেছেন। তিনি ইইউকে ফ্রান্সের প্রভাব বৃদ্ধির পদ্ধতি হিসেবে দেখেছেন। অপরদিকে জার্মানি মনে করেছে ইইউয়ের বর্ধিতকরণের মাধ্যমে ইউরোপে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে।  

যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্রনীতিতে নিজের ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং মনে করতে পারে যে, বাকিরা তাকে অনুসরণ করবে; কিন্তু ইউরোপের ব্যাপারটা আলাদা। এখানে কেউই অপরের কথা চিন্তা না করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //