ফিলিস্তিনিদের রক্তে ইসরায়েলের ক্ষমতায় ফের নেতানিয়াহু

ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু আবার দেশটির ক্ষমতার মসনদে বসতে যাচ্ছেন। গত ১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সুস্পষ্ট জয় পেয়েছে তার নেতৃত্বাধীন জোট। সবচেয়ে বেশি সময় দেশটির প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালনের রেকর্ডও তার ঝুলিতেই। নিজ দেশে ‘বিবি’ নামে পরিচিত ৭৩ বছর বয়সী এই নেতা এর আগে দুবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। 

নেতানিয়াহু প্রথমবার ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত এবং দ্বিতীয়বার ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তার সময়ে ইসরায়েল দুই রাষ্ট্র নীতি থেকে আক্ষরিক অর্থে সরে আসে, যা আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচিত হলেও তিনি কট্টরপন্থী অবস্থান থেকে সরে আসেননি।

বরং ফিলিস্তিনবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক অবস্থান আরও জোরদার করেছেন, কট্টরপন্থী জায়নবাদীদের সহযোগিতা দিয়েছেন, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখলীকরণ ও অবৈধ বসতি নির্মাণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। এই কট্টরপন্থী নেতা ফিলিস্তিনিদের হত্যা করাকেই নিজের ক্ষমতায় থাকার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এর ফলে আবার তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। আর এবার অতিকট্টরপন্থীদের সঙ্গে জোটবেঁধে এ কাজটা করেছেন তিনি।

দুর্নীতি ও অনিয়মের বেশ কয়েকটি অভিযোগের কারণে জনসমর্থন হারান নেতানিয়াহু। ফলে একটানা ১২ বছর ক্ষমতায় থাকার পর গত বছর নির্বাচনে হেরে যান তিনি। পরে ইয়ার লাপিদের মধ্যপন্থী দল ইয়েশ আতিদের সঙ্গে জোট করে সরকার গঠন করে ইয়েমিনা পার্টি; কিন্তু সম্প্রতি দেশটির প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট ও ইয়ার লাপিদের জোটে ফাটল দেখা দিলে আবার নির্বাচনের আয়োজন করা হয়।

ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটির প্রকাশিত সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টি ৩১টি আসন জিতেছে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী ইয়ার লাপিদের ইয়েশ আতিদ দল ২৪টি আসনে জয়ী হয়েছে। এ ছাড়া রিলিজিয়াস জায়নিজম পার্টি ১৪টি, ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি ১২টি, শাস দল ১১টি এবং ইউনাইটেড তোরাহ জুডাইজম দল আটটি আসন পেয়েছে।

সব মিলিয়ে নেতানিয়াহুর দল লিকুদ পার্টি এবং তাদের অতিডানপন্থী শরিক দলগুলো ১২০ সদস্যের ইসরায়েলি পার্লামেন্টে (নেসেট) মোট ৬৪টি আসন জিতেছে। বুথ ফেরত সমীক্ষায় বলা হয়েছিল- নেতানিয়াহুর ডানপন্থী ব্লক ৬১-৬২টি আসন জিতবে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী সপ্তাহেই নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হবে ইসরায়েলে। 

নেতানিয়াহুর এই জয়ের ফলে ইসরায়েলের রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান ঘটবে বলে মনে করা হচ্ছে। ২০১৯ সালে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ঘুষ, জালিয়াতি ও বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ উঠেছিল। সেই থেকে গত গত ৪ বছরে ইসরায়েলে পঞ্চমবার নির্বাচন হলো।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সব ডানপন্থী দল এক ছাতার নিচে একত্রিত করতে পারার কারণেই এই জয় পেলেন নেতানিয়াহু। সব ডানপন্থী দল এক জায়গায় হওয়ায়, ডানপন্থী ভোটও একত্রিত হয়েছে। নেতানিয়াহুর জোটে এবার বেশ কয়েকটি কট্টর ডানপন্থী দল যুক্ত হয়েছে। তাদের অন্তর্ভুক্তির প্রভাব দলে ও সরকারের নীতি-কৌশলে পড়বে বলেই বিশ্বাস বিশ্লেষকদের। তাই এবার তার বিষয়ে জোরালো আলোচনা চলছে। 

এবার নেতানিয়াহু ও তার জোটের মিত্ররা ইসরায়েলের বিচারব্যবস্থার সংস্কার চেয়েছেন। নির্বাচনের প্রচারের শুরুর দিন থেকেই তারা বিচারব্যবস্থার সংস্কার ইস্যুকে সামনে এনেছেন। নেতানিয়াহুর কট্টর ডানপন্থী জোট এবার বিচার বিভাগের রাজনীতিকরণ চান। তাদের দাবি- বিচারকদের নিয়োগ দেবে রাজনৈতিক নেতারা। নেতানিয়াহুর জোটের এই চাওয়া যদি পূরণ হয়, নিঃসন্দেহে সরকারের ভারসাম্য দুর্বল হবে। মূলত তার বিরুদ্ধে চলমান ফৌজদারি মামলার বিচার থেকে পালাতেই নেতানিয়াহু বিচার বিভাগের সংস্কার চান। সোজা কথায়- সরাসরি নিজে হস্তক্ষেপ করতে চান। কারণ তার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

এর আগে ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় নেতানিয়াহু চাননি পশ্চিম তীরে স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হোক। বিশ্লেষকদের ধারণা, তার কাছ থেকে এ প্রশ্নে কোনো পরিবর্তন আসবে না। নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ফিলিস্তিনে সংঘাত আরও বাড়বে। কারণ তার অতীত ইতিহাস তেমন ইঙ্গিতই দেয়। তার সঙ্গে এবার নতুন করে যুক্ত হয়েছে অতিকট্টর ডানপন্থী দলগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে বলে দিয়েছে, নেতানিয়াহুর জোট অংশীদারদের সম্পর্কে বাইডেন প্রশাসনের আপত্তি রয়েছে।

২০২০ সালের দিকে বাহরাইন, মরক্কো ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ইসরায়েলের যুগান্তকারী কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন নেতানিয়াহু। সেই সম্পর্কগুলোই নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন। কারণ ওই একটাই, অতিডানপন্থীদের সঙ্গে জোট।

নেতানিয়াহুকে অতিডানপন্থী শরিক রিলিজিয়াস জায়নিজম পার্টির সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে। এই দলের অন্যতম নেতা ইতামার বেন-গাভি ইসরায়েলের প্রয়াত অতিজাতীয়তাবাদী নেতা মীর কাহানের অনুগামী। মীর কাহানের সংগঠন ইসরায়েলে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র একে সন্ত্রাসবাদীগোষ্ঠী বলেছিল। খোদ বেন-গাভির বিরুদ্ধেও বর্ণবিদ্বেষে উসকানি দেওয়া, সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে সমর্থন করার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

বেন-গাভি ফিলিস্তিনের হেবরন শহরে বাস করেন। তিনি ইসরায়েলি চরমপন্থীদের রক্ষার জন্য আইন তৈরি করতে আগ্রহী। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি অধিগ্রহণকেও তিনি মনেপ্রাণে সমর্থন করেন। ইসরায়েল থেকে যারা ফিলিস্তিনে গিয়ে জোরপূর্বক বসতি স্থাপন করছেন, তাদের সমর্থন দেওয়ার অগ্রভাগে রয়েছেন বেন-গাভি। তাকে একসময় বন্দুক নিয়ে জেরুজালেমের শেখ জাররাহ এলাকায় ঘুরতে দেখা যেত। বেন-গাভির বিরুদ্ধে আরও একটি গুরুতর অভিযোগ- জেরুজালেমের টেম্পল মাউন্ট কমপ্লেক্স কেন্দ্র করে সংঘাত উসকে দিতে বেশ কয়েক বছর ধরেই চেষ্টা করেছেন তিনি।

টেম্পল মাউন্ট কমপ্লেক্স, যার আরেক নাম আল হারাম আল শরিফ এবং যেটি মুসলিম ও ইহুদি উভয় সম্প্রদায়ের জন্য পবিত্র স্থান; সেখানে সংঘাত সৃষ্টি হলে, তা দাবানলের মতো সারা ইসরায়েলে ছড়িয়ে পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। অথচ তাকে ইসরায়েলের পরবর্তী পুলিশমন্ত্রী হিসেবে মনে করা হচ্ছে আরেক অতিডানপন্থী বেজালেল স্মোট্রিচ নতুন সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হতে পারেন।

বিশ্লেষকদের ধারণা, আগেকার আর পরবর্তী নেতানিয়াহু সরকারের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকবে। অতিডানপন্থীদের জোটবদ্ধ রাখতে তাকে যেমন চরম উগ্রতা প্রদর্শনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে; তেমনি এই অতিকট্টরপন্থী, উগ্রবাদী জোট সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ও ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হওয়ার চ্যালেঞ্জও রয়েছে বিশ্ব, বিশেষত পশ্চিমাদের সামনে।

ইসরায়েলের নির্বাচন প্রসঙ্গে ফিলিস্তিনি স্বশাসন কর্তৃপক্ষের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মাদ সাতাইয়া বলেছেন, ‘নির্বাচনে চরম ডানপন্থী উগ্রবাদী ধর্মীয় দলের এগিয়ে থাকা শুধু সেখানে উগ্রবাদ উত্থানেরই প্রমাণ দেয়। আমাদের এই ধরনের কোনো আশা নেই যে, ইসরায়েলের নির্বাচন শান্তির জন্য কোনো মিত্রের জন্ম দেবে।’ নির্বাচনে নেতানিয়াহুর বিজয়ের ব্যাপারে ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এরইমধ্যে তার নীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। তার নীতি সবসময় একই ছিল এবং কখনো তা পাল্টাবে না। ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে তার নীতির কী প্রভাব পড়বে আমরা তা জানি।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘ইয়াইর লাপিদ ও নেতানিয়াহু- আমরা দুজনেরই পরিচয় জানি, তারা দুজন বরং ফিলিস্তিনিদের ওপরে অপরাধযজ্ঞ চালাতে প্রতিযোগিতা করে থাকেন। তাদের নির্বাচনী প্রচারের ক্ষেত্রে সবসময় ফিলিস্তিনি জনগণকে রক্ত দিয়ে মূল্য দিতে হয়েছে। ফলে ইসরায়েলের নির্বাচন আমাদের জন্য কোনো লাভ বয়ে আনে না বরং আমাদের ক্ষতি করে। ফিলিস্তিনিদের রক্ত তাদের সফলতার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //