চ্যালেঞ্জের মুখে লুলা

নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষে লুইজ ইনাসিও লুলা দ্য সিলভা ৫০ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হন। আর জইর বলসোনারো পেয়েছেন ৪৯ দশমিক ১ শতাংশ ভোট। ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি ব্রাজিলের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। সেই সঙ্গে এটি সমাজের বিভক্তিকেই তুলে ধরছে। 

নির্বাচনে জয়ের পর আগামী ১ জানুয়ারি থেকে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ৭৭ বছর বয়সী লুলা দায়িত্ব পালন শুরু করবেন। তাকে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সংকট, আমাজনের বনভূমি ধ্বংস এবং শক্তিশালী ও ক্ষুব্ধ ডানপন্থীদের মোকাবিলা। সেই সঙ্গে দারিদ্র্য, আবাসন ও আমাজনের মতো ইস্যুর সঙ্গে ব্রাজিলীয়দের মধ্যে সৃষ্ট বিভেদও দূর করতে হবে তাকে।

বলসোনারো সরকারের আমলে দেশটির ৩ কোটির বেশি মানুষ চরম খাদ্যসংকটে পড়েছে, দরিদ্র হয়েছে ১০ কোটি মানুষ। আমাজন উজাড়ে বলসোনারোর নীতি ব্রাজিলকে সমালোচিত করেছে বিশ্বজুড়ে। এসব সংকট কাটিয়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় এসেছেন লুলা।

নির্বাচনে জয়ের পরের ভাষণেও দারিদ্র্য মোকাবিলাকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন লুলা। ‘মানুষ না খেয়ে থাকবেন’ তা কোনোভাবেই মানতে পারবেন না বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। লুলা বলেন, ‘আমাদের দেশ বিশ্বে খাদ্য উৎপাদনে তৃতীয় হওয়ার পরও লাখ লাখ শিশু, নারী ও পুরুষ না খেয়ে থাকছেন। এটি হতে পারে না। ব্রাজিলের প্রত্যেকটি মানুষ প্রত্যেকটা দিন যাতে তিনবেলা খেতে পান, তা নিশ্চিত করা আমাদের কর্তব্য।’

তবে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের উপায় ও অর্থায়ন নিয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি লুলা। করোনা মহামারি পরবর্তী দুরবস্থা কাটিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট লাঘবের চ্যালেঞ্জ কতটা দক্ষ হাতে মোকাবিলা করতে পারেন লুলা, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।

২০০৩ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব সামলেছেন লুলা। ওই সময় তার সরকারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক নীতি লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করেছিল। এবারও তিনি সেই নীতিই অব্যাহত রাখবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা মহামারিপরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থায় লুলার পক্ষে আগের মতো সাফল্য পাওয়া কঠিন হতে পারে। এ ছাড়া কংগ্রেসে বলসোনারোর সমর্থকদের জোর বাধার সম্মুখীন হতে পারেন তিনি।

দেশবাসীকে সাধ্যের মধ্যে আবাসন সুবিধা এবং গ্রাম পর্যায় বিদ্যুৎ ও পানির সুব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বামপন্থী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা লুলা। তবে সবার জন্য সাধ্যমতো আবাসন খুব সহজ নয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, লুলার উদারনীতি উচ্চাভিলাষে পর্যবসিত হতে পারে। 

সংকটে আমাজন

২০১৯ সালে বলসোনারো ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ক্রমাগত আমাজন বন ধ্বংসের হার বাড়তে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, বন উজাড় ও অগ্নিকাণ্ডের কারণে আগের দশকের চেয়ে ২০১৯ ও ২০২০ সালে কার্বন নিঃসরণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। গত বছর আমাজনের প্রায় ১০ লাখ হেক্টর এলাকা আগুনে পুড়ে যায়।

‘পৃথিবীর ফুসফুস’খ্যাত আমাজন বনাঞ্চল সুরক্ষার বিষয়ে নির্বাচনী প্রচারে জোর দিয়েছিলেন লুলা। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের সামনে তাই আমাজনের ক্ষত সারিয়ে তোলা বড় চ্যালেঞ্জ। এমন অবস্থায় লুলার সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে, পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত আমাজন জঙ্গলকে সুরক্ষিত করার দায়িত্ব নিতে হবে তাকে।

আমাজন জঙ্গলের আয়তন প্রায় ৫৫ লাখ বর্গকিলোমিটার। ব্রাজিলের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় বেশিরভাগ এলাকা, কলম্বিয়া, পেরুসহ দক্ষিণ আমেরিকার ৯টি দেশে বিস্তৃত এই বন। তবে এই জঙ্গলের প্রায় ৬০ শতাংশ ব্রাজিলে। গত দুই দশকের বেশির ভাগ সময়জুড়ে দেশটিকে আদিবাসীদের ভূমি সংরক্ষণ, অবৈধভাবে বন উজাড়কারীদের ওপর ধরপাকড়, কী পরিমাণ বন ধ্বংস হচ্ছে, তা আরও বেশি করে পর্যবেক্ষণ করতে দেখা গিয়েছিল।

বলসোনারোর সময়ে ক্রমাগত আমাজন জঙ্গল ধ্বংসের হার বাড়তে দেখা গেছে। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্রাজিলের পরিবেশ সুরক্ষাজনিত পদক্ষেপগুলো কমিয়ে ফেলেন, বিজ্ঞান ও পরিবেশগত সংস্থাগুলোতে খরচ কমিয়ে দেন, পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের বরখাস্ত করেন এবং আদিবাসীদের ভূমির অধিকার নড়বড়ে করে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। বন উজাড় করে এসব এলাকা কৃষি জমিতে পরিণত করা হয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, বন উজাড় ও আগুনের কারণে আগের দশকের তুলনায় ২০১৯ ও ২০২০ সালে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের হার দ্বিগুণ হয়েছে। সবশেষ একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছর আমাজন জঙ্গলের প্রায় ১০ লাখ হেক্টর এলাকা আগুনে পুড়ে গেছে।

সেপ্টেম্বরে বনে আগুনের মাত্রা এতটাই বাড়ে যে, তা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৯ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০২১ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত বলসোনারোর শাসন মেয়াদের প্রথম তিন বছরে আমাজন জঙ্গলের ৩৪ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা উজাড় হতে দেখা গেছে।

এ সময় আগের ৩ বছরের তুলনায় ৫২ শতাংশ বেশি বন এলাকা উজাড় হয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট দাবানলে ধ্বংস হওয়া বন এলাকাকে বাদ দিয়ে এ হিসাব করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১০-২০১৮ সালে গড় কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন হারের তুলনায় ২০১৯ সালে ৮৯ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ১২২ শতাংশ বেড়েছে।

লুলা নির্বাচনী প্রচারে বারবারই আমাজন জঙ্গলের সুরক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। তবে আগের অবস্থা আর এখনকার অবস্থা এক নয়। এখন আমাজন রক্ষা করাটা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং।

অস্থিতিশীল অর্থনীতি

লুলা এমন সময় ক্ষমতা গ্রহণ করছেন, যখন ব্রাজিলের ৩ কোটির বেশি মানুষ তীব্র মাত্রার অনাহারে ভুগছে, আর দারিদ্র্য সীমার মধ্যে আছে দেশটির ১০ কোটি মানুষ। তবে ক্ষমতা গ্রহণের আগেই দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে কাজ শুরু করেছেন তিনি। এরইমধ্যে দুজন অর্থনীতিবিদকে নিয়োগ দিয়েছেন। তারা হলেন- পেরিসো আরিদা ও আন্দ্রে লারা রেসেন্ডে। দুজনই নব্বইয়ের দশকে ব্রাজিলের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলছে, আরিদা ও লারার পাশাপাশি গুইহার্মি মেলো নামে আরেক অর্থনীতিবিদকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এর আগে লুলার বামপন্থী থিঙ্কট্যাংকের অর্থনৈতিক প্রস্তাবের খসড়া তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গুইহার্মি। তবে লুলার মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী কে হবেন, তা এখনো জানা যায়নি। 

বিভক্ত সমাজ

মানুষের মধ্যে এই বিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে, লুলাই দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ক্ষমতায়িত করতে পারেন এবং সমাজের প্রান্তিক অংশে একটি বিশদ পরিসরের মৈত্রী জোট বাঁধতে পারেন। তবে তার জন্য ডানপন্থীদের গভীর ঐক্যের মুখে বামপন্থী ও মধ্যপন্থীদের উপদলকে এক ছাতার তলায় আনা সমান জরুরি।

বিবিসির বিশ্লেষক ব্রুনো ফেরেরা গার্সেজ জানান, লুলা বেশি ভোট পেয়েছেন ব্রাজিলের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র উত্তরাঞ্চলে, আর তরুণতর ভোটার ও নারীদের মধ্যেও তার সমর্থক ছিল বেশি। অন্যদিকে বলসোনারোর রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল ব্রাজিলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বের অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল ব্রাজিলিয়ানদের মধ্যে। তারা সামাজিকভাবে রক্ষণশীল ও খ্রিস্টান ডানপন্থী, গোঁড়া গর্ভপাতবিরোধী এবং জাতীয় পরিচয়ের রাজনীতির সমর্থক।

লুলা পপুলিস্ট নেতা নন। তিনি সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কাজ করেন। তার বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা জীবন সম্পর্কে তার বোধকে রক্ষণশীল হতে দেয়নি। একটি গাড়ি কারখানার শ্রমিক হিসেবে তিনি পেশাজীবন শুরু করেছিলেন এবং ঘটনাক্রমে শ্রমিক ইউনিয়নের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ওই সময় তিনি স্বৈরাচারী শাসনের নির্যাতনকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন।

ওই সময়ই তিনি ইউনিয়নগুলোকে একটি রাজনৈতিক শক্তিতে রূপ দেন। পপুলিস্টদের বিপরীতে তিনি রাজনৈতিক জোট গড়ায় এবং রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ১৯৮৯ সাল থেকে কার্যত প্রতিটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।

একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, একজন মানুষ বামপন্থী নাকি ডানপন্থী তা দিয়ে তিনি তাকে বিচার করেন না। তিনি ওই ব্যক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণটিকে ‘বন্ধু বানানো’র পক্ষে। তবে বাস্তবতা হলো- বলসোনারো পরাজিত হলেও তিনি যে সামাজিক বিভক্তি, উগ্রবাদী চেতনার প্রতিনিধিত্ব করেন, সেগুলো কিন্তু পরাজিত হয়নি। ব্রাজিলে ডানপন্থীরা বেশ কয়েকটি গ্রুপে বিভাজিত। আর এর সবগুলোই উদারনীতির ঘোর বিরোধী। ধর্ম, জাতীয়তাবাদ যেখানে মিলেমিশে রয়েছে।

ঐতিহ্যবাহী ক্যাথলিকবাদ সেখানে হ্রাস পাচ্ছে এবং উগ্র ইভাঞ্জেলিকালিজম সে জায়গা দখল করছে। এই উগ্র চেতনার নাগরিকেরা শহুরে এলাকা থেকে তাদের মতাদর্শ গ্রামাঞ্চলে সঞ্চারিত করেছে। প্রতিটি সমাজের মতো ব্রাজিলেও এখন লিঙ্গ ও জাতিগত পরিচয়ের ইস্যুতে ক্রমবর্ধমান মেরুকরণ হচ্ছে। ইতিবাচক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া অভিজাতদের মধ্যে স্পষ্ট।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //