যেখানে ভিন্ন জেসিন্ডা আরডার্ন

মাত্র ৩৭ বছর বয়সে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নারী সরকারপ্রধান হয়ে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছিলেন জেসিন্ডা আরডার্ন। ২০১৯ সালে ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলায় ৫১ জন নিহত হওয়ার পর তিনি নিউজিল্যান্ডের বন্দুক আইন সংস্কার করেন। একই বছরের ডিসেম্বরে নিউজিল্যান্ড উপকূলে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে ২২ জন মারা যাওয়ার পর আবারও তার সহমর্মিতা দেখা গিয়েছিল। 

বিশ্বব্যাপী ক্ষমতাসীনরা যখন আজীবন ক্ষমতায় থাকার নকশা আঁকেন, তখন এই গতিপথ থেকে একদমই ভিন্ন চরিত্রের জেসিন্ডা নিজের মতো করে মানুষের সেবা করতে পারছেন না বলে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে না পারার ব্যর্থতার দায় স্বীকারের পর ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে ১৯ জানুয়ারি আকস্মিক পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা। এ ঘোষণার পর আবেগী কণ্ঠে জেসিন্ডা বলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সাড়ে ৫ বছর কঠিন ছিল। আমিও একজন মানুষ। আমাকেও পদ থেকে সরে যাওয়া প্রয়োজন।

সংবাদ সম্মেলনে ৪২ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই গ্রীষ্মে, আমি শুধু একটি বছরের জন্য নয়, আরও একটি মেয়াদে দায়িত্বে থাকার জন্য বিভিন্ন উপায় খুঁজে বের করার আশা করেছিলাম। কারণ এ বছরের জন্য এটিই প্রয়োজন। তবে আমি তা করতে পারিনি। ...আমি জানি, এ সিদ্ধান্তের পর অনেক আলোচনা হবে। সিদ্ধান্তের পেছনের তথাকথিত সত্যিকারের কারণ নিয়ে কথা হবে।’

যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের মতামত বিভাগের সম্পাদক আন্দ্রেয়া পাপুকের মতে, মহামারি জেসিন্ডার মেধার পরীক্ষা নিয়েছে। বিশ্বের অন্যতম কঠোর লকডাউনের সঙ্গে ভাইরাসটি মোকাবিলায় কৃতিত্বের দাবিদার তিনি। জেসিন্ডার পদত্যাগের ঘোষণাকে তার ‘চারিত্রিক বিনয়ের প্রমাণ’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জেসিন্ডাকে অবশ্যই স্মরণ করা হবে। তবে তার সিদ্ধান্তকে সম্মান করা উচিত।

এটি রাজনীতি ও ব্যবসায় বৈচিত্র্য অর্জনের চ্যালেঞ্জগুলোরই প্রতিফলন। শুধু নারীদের সেখানে নিয়ে যাওয়া নয়, এটি তাদের ধরে রাখারও বিষয়। আমরা চাই, জেসিন্ডার মতো রাজনীতিবিদরা টিকে থাকুন। কারণ তারাই পারেন পরিবর্তন আনতে।’ 

জেসিন্ডার পদত্যাগের ঘোষণায় অবাক হয়েছেন বিশ্বের বহু মানুষ। তবে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেয়েছেন জেসিন্ডার নারী ভক্ত-অনুরাগীরা। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে জেসিন্ডার দর্শন, উদারতা ও দক্ষতা তাকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। তিনি অনেক নারীর আদর্শ। সবচেয়ে কম বয়সী নারী প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি সন্তান লালন-পালন করেছেন। 

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সন্তানের জন্ম দেওয়ার ঘটনা বেশ বিরল। জেসিন্ডার আগে মাত্র একজন নারীই প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে সন্তানের জন্ম দেন। তিনি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। এই দুই নারীকেই সন্তান পালন ও দেশ সামলানোর কঠিন কাজ একসঙ্গে চালিয়ে যেতে হয়েছে।

এই দুই দায়িত্ব একসঙ্গে পালন করতে গিয়ে হয়তো বেশ চাপে ছিলেন জেসিন্ডা। তবে তার পদত্যাগের পেছনে যে রাজনৈতিক কারণও রয়েছে, তা কিন্তু একেবারে স্পষ্ট। এমন সময় জেসিন্ডা পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন যখন নিউজিল্যান্ডের রাজনীতিতে প্রতিকূল হাওয়া বইছে। 

জীবনযাপনের বাড়তি খরচ ও অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় শঙ্কিত দেশটির মানুষ। এসবের জেরে তার জনসমর্থনও কমেছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে করা একটি জরিপে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের আগস্টের পর জেসিন্ডার জনপ্রিয়তা সবচেয়ে কমেছে। তার দল লেবার পার্টিরও জনসমর্থনে কিছুটা ভাটা পড়েছে।

নিউজিল্যান্ডের মানুষের ‘জেসিন্ডা প্রীতির’ কারণে একসময় তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠেছিলেন। তবে করোনা ভাইরাস মহামারির ধাক্কায় দেশবাসীর সঙ্গে তার সেই সম্পর্ক অনেকটাই তিক্ত হয়ে পড়ে। করোনার পর এখন অর্থনৈতিক সংকটের মুখে নিউজিল্যান্ড। এতে করে বেড়েছে জীবনযাপনের খরচ। গভীর হয়েছে সামাজিক বৈষম্য। 

বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে নিজের সম্মান ধরে রাখতেই হয়তো পদ ছেড়েছেন তিনি। জেসিন্ডা চাচ্ছেন না টালমাটাল এই অর্থনীতির কারণে পরবর্তী নির্বাচনে তাকে ও তার দলকে লজ্জাজনক পরাজয় মেনে নিতে হয়।

পদত্যাগের কারণ যদি এটাও হয়, তারপরও আজকের শক্তিশালী বক্তব্যের মাধ্যমে তা হয়তো অনেকটাই সামাল দিতে পেরেছেন জেসিন্ডা। তার ভাষ্য এটাই ছিল যে নিজের সক্ষমতার সীমাটা জানা সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটা মেনে নিয়েই নিজের সীমাবদ্ধতাকে সম্মান করতে হয়। তিনি বুঝিয়েছেন, নিজেকে সীমার বাইরে ঠেলে দিয়ে কোনো কাজই করা উচিত নয়। আর কারও যখন আর কিছুই দেওয়ার থাকে না, তখন দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোটাই শ্রেয়।

সমস্যা সব দেশেই থাকে। সরকারপ্রধানদের তা মোকাবিলাও করতে হয়। তবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জেসিন্ডা আরডার্নকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বলা যায়, করোনা মহামারি, ক্রাইস্টচার্চ শহরে মসজিদে হামলা ও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কথা। ১৯ জানুয়ারির পদত্যাগের ঘোষণায় জেসিন্ডা বলছিলেন, তাকে একের পর এক বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। 

তবে শেষ পর্যন্ত একজন রাজনীতিককে তার ব্যক্তিগত জীবনে কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, তা পদত্যাগ নিয়ে জেসিন্ডার বক্তব্যে উঠে এসেছে। এ সময় তার গলা কাঁপছিল। তিনি বলেন, ‘রাজনীতিকেরাও মানুষ। যতক্ষণ সম্ভব আমরা সবকিছু শুধু দিয়েই যাই। তারপর শেষ সময়টা চলে আসে। আমার জন্য এটা শেষ সময়। আমি জানি, এই দায়িত্বের জন্য আমাকে কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।’ এই ত্যাগই জেসিন্ডাকে অন্যদের থেকে ভিন্ন করেছে।

এদিকে নিউজিল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন ক্রিস হিপকিনস। বর্তমানে তিনি দেশটির পুলিশ, শিক্ষা ও জনসেবা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর তিনি দেশটির ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির নেতা নির্বাচনে মনোনীত একমাত্র প্রার্থী। ফলে তিনিই জেসিন্ডার উত্তরসূরি হতে যাচ্ছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী হতে আরও কিছু আনুষ্ঠানিকতা বাকি থাকবে ক্রিসের জন্য। কারণ আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি জেসিন্ডা আনুষ্ঠানিকভাবে গভর্নর জেনারেলের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন। এরপর গভর্নর জেনারেল রাজা তৃতীয় চার্লসের পক্ষে ক্রিসকে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //