ক্ষমতা পোক্ত করতে ফিলিস্তিনি নিধনযজ্ঞে নেতানিয়াহু

ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে কট্টরপন্থি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব আরও সংঘাতময় হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। চলতি বছরের প্রথম মাসেই দুপক্ষের সহিংসতায় আট শিশুসহ ৩৫ জনের বেশি ফিলিস্তিন এবং সাত ইসরায়েলি নিহত ও আহত হয়েছেন আরও অনেকেই।

এর পেছনে রয়েছে কট্টরপন্থি জোটকে দেওয়া ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর প্রতিশ্রুতি এবং ফিলিস্তিনি রক্তে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নিজের অবস্থান পোক্ত করার পুরনো বাসনার প্রতিফলন।

নেতানিয়াহুর মূল মিত্রদের মধ্যে বেশিরভাগই ধর্মীয় জায়নবাদী পার্টিসহ অতিজাতীয়তাবাদী পশ্চিম তীরের বসতি স্থাপনকারী। এ কট্টরপন্থি সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে- পশ্চিম তীরের বসতি সম্প্রসারণকে তারা অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে রাখবে; হয়েছেও তা-ই। অতিজাতীয়তাবাদী মিত্রদের সঙ্গে জোটগত চুক্তির অংশ হিসেবে দখলকৃত অঞ্চলকে সংযুক্ত করার কথা নেতানিয়াহুর।

এ ছাড়া নেতানিয়াহু অবৈধভাবে নির্মিত কয়েক ডজন চেকপয়েন্টকে বৈধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে দখলদারিত্ব বাড়ানো এবং তাদের রক্তে নিজের আখের গোছানোর কাজটা পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর থেকে নেতানিয়াহু করে যাচ্ছেন। আর এ কাজে পশ্চিমা শক্তিকে বরাবরের মতোই তিনি পাশে পাচ্ছেন।

সরকারের শপথ নেওয়ার একদিন আগে (৫ জানুয়ারি) প্রকাশিত জোটগত চুক্তিতে দেখা যায়, ধর্মীয় কারণে এলজিবিটিকিউ বা সমকামীদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক ভাষা সমর্থন করার পাশাপাশি, অতি-কট্টর পুরুষদের জন্য উপবৃত্তিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সেই সঙ্গে বিচার বিভাগের ওপর ইসরায়েলি পার্লামেন্ট নেসেটের হস্তক্ষেপের ক্ষমতা দেওয়ার কথাও রয়েছে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে। কট্টরপন্থিরা ক্ষমতায় এসেই সে পথে হাঁটতে শুরু করে।

এর বিপরীতে সরকারের নতুন এসব পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সরব কয়েক হাজার মানুষ গত ৭ জানুয়ারি থেকে বিক্ষোভ করছেন। তারা নেতানিয়াহুর পাশাপাশি উগ্র ডানপন্থি হিসেবে পরিচিত বিচার বিষয়ক নতুন মন্ত্রী ইয়ারিভ লেভিনের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। সরকারের নতুন নীতি অনুযায়ী, বিচারকদের নিয়োগ হবে পার্লামেন্টের অধীনে। এতে ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্ট আরও দুর্বল হয়ে পড়বে এবং নেসেটের অধীনস্থ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নেতানিয়াহু। ওই বছর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর চলতি বছরে নিরঙ্কুশ সমর্থন নিয়ে আবারও ক্ষমতায় ফিরেছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণ, বিশ্বাসভঙ্গ ও জালিয়াতির অভিযোগ বিচারাধীন রয়েছে। 

তিনি এসব অভিযোগ অস্বীকার করলেও এ অভিযোগ প্রমাণের অনেক তথ্য-প্রমাণ বিচার বিভাগের হাতে রয়েছে বলে দাবি বিরোধীদের। আর এজন্যই বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করাটা নেতানিয়াহুর জন্য অপরিহার্য। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত নিজেকে বাঁচাতেই অতিকট্টরপন্থিদের নিয়ে সরকার গঠন করে বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজেকে দায়মুক্তি দিতে চাচ্ছেন নেতানিয়াহু। আর এ কাজে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যখন বিরোধের মুখে পড়ছেন, তখন এ থেকে বের হতে তিনি ফিলিস্তিনি নিধনযজ্ঞের ঢাল ব্যবহার করছেন। 

নেতানিয়াহুর ফিলিস্তিনি হত্যায় বরাবরের মতোই পশ্চিমা সমর্থন ছিল সুস্পষ্ট। গত ২৬ জানুয়ারি জেনিনে ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি বাহিনী যে হত্যা অভিযান চালায়, তাতে ৯ ফিলিস্তিনি নিহত হন। এর প্রতিবাদে সেদিনই জেরুজালেমে এক ফিলিস্তিনি কিশোর ৭ ইসরায়েলিকে হত্যা করে। এটি গত কয়েক বছরে পশ্চিম তীরে এক দিনে সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা।

এ ঘটনার যে প্রতিক্রিয়া বিশ্বনেতারা দেখিয়েছেন, তাতেই ফিলিস্তিনের প্রতি যে আর তাদের তেমন আগ্রহ নেই, তা স্পষ্ট। দখলদার বাহিনীর মাসজুড়ে হামলা নিয়ে একটি কথাও ওই নেতারা বলেননি; কিন্তু ফিলিস্তিনি কিশোরের হামলা নিয়ে তাদের তীব্র প্রতিক্রিয়া ছিল। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বন্দুক হামলার ঘটনাকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ আখ্যা দিয়ে ‘ঘৃণিত’ এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। জেরুজালেমে বন্দুক হামলাকে ‘সভ্য বিশ্বের বিরুদ্ধে আক্রমণ’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র অটল বলেও জানিয়েছেন।

ইইউয়ের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল জেরুজালেমে বন্দুক হামলাকে ‘ভয়াবহ সন্ত্রাসী’ হামলা আখ্যা দিয়ে এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ টুইটারে, এই ঘটনাকে ‘ঘৃণামূলক’ হামলা উল্লেখ করে এর নিন্দা জানিয়েছেন।

জার্মান চ্যান্সেলর ওলফ শলৎস বলেন, ‘ভয়াবহ’ হামলা তাকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছে। ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি টুইটারে সমবেদনা জানিয়ে লিখেছেন, এ ঘটনায় ইউক্রেন গভীরভাবে ব্যথিত। হতাহতদের মধ্যে একজন ইউক্রেনীয় ছিলেন। ইসরায়েল হোক বা ইউক্রেন; সহিংসতার কোনো জায়গা নেই।

এদিকে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস জেনিনে ইসরায়েলের অভিযানকে বর্বরোচিত হামলা বলে উল্লেখ করেছেন। জেনিনে ৯ ফিলিস্তিনি নিহতের ঘটনায় তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছেন তিনি। তবে ঢাল-তলোয়ারহীন এ নেতার কথা যেমন ইসরায়েল বা পশ্চিমাদের কাছে গুরুত্ব পায় না; তেমনি ফিলিস্তিনিদের কাছে তিনি প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছেন। আর সেই সঙ্গে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের পথও প্রায় রুদ্ধ হয়ে পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। 

দীর্ঘদিন ধরে চলমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের সংকট নিরসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্তই ছিল দুই পক্ষের জন্য আলাদা দুটি রাষ্ট্র। আর এই দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের তত্ত¡টি এসেছিল ১৯৯৩ সালে অসলো শান্তি আলোচনার মাধ্যমে এবং দুপক্ষই তাতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এখন অনেকটাই বদলে গেছে এবং এক সময়ে ইসরায়েলের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক ছিল এমন কয়েকটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এখন ইসরায়েলের মিত্রশক্তিতে পরিণত হয়েছে।

আবার অসলো শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী যুক্তরাষ্ট্র সবসময় দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বের কথা বললেও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে আনার পর ওই তত্ত্ব কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন অনেকে। 

যুক্তরাষ্ট্র যেদিন জেরুজালেমে দূতাবাস উদ্বোধন করছিল সেদিন গাজা পরিণত হয়েছিল এক রক্তাক্ত প্রান্তরে। সেদিন গাজায় ৫৮ জন নিহত আর আহত হয় আরও প্রায় তিন হাজার। বিশ্লেষকদের মতে, দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্ব কোনো সমাধান হয়ে উঠতে পারেনি।

কারণ এক পক্ষই সেখানে শাসন করে, নিয়ন্ত্রণ করে, ক্ষমতাচর্চা করে করে, সিদ্ধান্ত নেয়। আর এক পক্ষের শাসনে সমাধান আসে না। আসে শোষণ। এ তত্ত্বের যেসব শর্ত আছে সেগুলো কখনোই কার্যকর হয়নি। আবার যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইসরায়েল এখন আরব দেশগুলোর সঙ্গে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কে আবদ্ধ।

আর এতে ওই আরব দেশগুলোর মুখও বন্ধ। আঞ্চলিক মিত্রদের হারিয়ে মাহমুদ আব্বাসের ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতে যেমন দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্ব অকার্যকর হয়ে পড়েছে; তেমনি সংঘাত হয়ে উঠেছে অবধারিত।

জেরুজালেমে জাতিসংঘের দূত টর ওয়েনেসল্যান্ড সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলোতে বাড়তে থাকা সহিংসতা পরিস্থিতিকে ‘খাদের কিনারায়’ নিয়ে গেছে। এই রক্তক্ষয় বন্ধে ‘বলিষ্ঠ’ কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ দরকার বলে মনে করেন তিনি।

ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন কমে আসার কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার বিষয়েও সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘ দায়িত্ব নিতে পারে না, আমরা ফিলিস্তিন শাসন করতে পারি না।’

ইসরায়েলে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ফিলিস্তিনের নেতৃত্ব নিয়ে জটিল পরিস্থিতির মধ্যে কূটনৈতিক পরিবেশ সেখানে এখন কঠিন বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবে শান্তি প্রক্রিয়া মরে গেছে এমন কথাও বলতে নারাজ ওয়েনেসল্যান্ড। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলে যে সরকারই থাকুক, রামাল্লায় যে কর্তৃপক্ষই থাকুক, এখনই এ অবস্থা থেকে বের হয়ে এসে আলোচনার সময়।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //