ইরানে ড্রোন হামলা: আঞ্চলিক উত্তেজনায় নতুন মাত্রা

ইরানের মধ্যাঞ্চলীয় শহর ইসফাহানের একটি ‘ওয়ার্কশপে’ গত ২৮ জানুয়ারি ড্রোন হামলা চালানো হয়। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মোট তিনটি ড্রোন কারখানায় হামলা করে; এর মধ্যে দুটিকে ভূপাতিত করা হয়। একটি ড্রোন বহনকৃত বোমা কারখানার উপর ফেলতে সক্ষম হয়। তবে এতে কারখানার ছাদের উপর সামান্য ক্ষতি ছাড়া তেমন কিছু হয়নি। 

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানের টেলিভিশনে কারখানার ছাদের ভিডিও প্রকাশ করে হালকা ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরা হয় এবং একই সঙ্গে ড্রোনের ধ্বংসাবশেষ দেখানো হয়; যেগুলো বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত ড্রোনের সদৃশ। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ‘ইরনা’ জানায়, ড্রোনগুলো ‘কোয়াড কপ্টার’; এগুলো সাধারণত স্বল্প দূরত্ব থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে চালানো হয়। অর্থাৎ এই ড্রোন ইরানের বাইরে থেকে উড়ে আসেনি।

যদিও এখন পর্যন্ত কেউ হামলার দায় স্বীকার করেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ বলেছে, ইসরাইল এই হামলা করেছে। অনেকেই ধারণা করছেন, ইসফাহানের এই কারখানায় খুব সম্ভবত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের যন্ত্রাংশ প্রস্তুত করা করা। 

২০২২ সালের অক্টোবরে আটক কয়েক ব্যক্তির বক্তব্য ইরানের টেলিভিশনে প্রকাশ করা হয়; এই আটক ব্যক্তিরা কুর্দি বিদ্রোহী গ্রুপ ‘কোমালা’র সদস্য, যারা ইসরায়েলের ইন্টেলিজেন্স সংস্থা মোসাদের ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং তারা ইসফাহান শহরে সামরিক স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা করছিল।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এবং ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে এমন ঘটনার গুরুত্ব বেড়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ইরানের কুর্দি বংশোদ্ভূত নারী মাহসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পুরো ইরানজুড়ে চলছে সহিংসতা।

আর ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে সুইসাইড ড্রোন সরবরাহ করায় ইরানকে নিয়ে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা এবং পারমাণবিক প্রকল্পে কাজ করা গবেষকদের হত্যার জন্য অনেকেই ইসরায়েলকেই দায়ী মনে করছেন। 

ইরানের সরকার পারমাণবিক প্রকল্পে ইউরেনিয়াম এনরিচমেন্ট বাড়িয়ে ৬০ শতাংশ করার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ইরানবিরোধী বক্তব্য যেমন বেড়েছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের যৌথ মহড়ার পরিধিও বেড়েছে। এখানে আজারবাইজানের অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ।

কারণ আজেরবাইজান ইরানের প্রতিবেশী দেশ এবং ইসরায়েলের সঙ্গে আজারবাইজানের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। ইরানিরা বার বার অভিযোগ করছে, ইসরায়েলি ইন্টেলিজেন্স আজারবাইজানকে ব্যবহার করে ইরানের অভ্যন্তরে হামলা চালাচ্ছে। 

ইসফাহানে ড্রোন হামলার একদিন আগেই তেহরানে আজারবাইজানের দূতাবাসে হামলা হয়। আজারবাইজানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ২৭ জানুয়ারি সকাল ৮টায় এক ব্যক্তি স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের মাধ্যমে দূতাবাসে হামলা করে।

এতে দূতাবাসের নিরাপত্তাপ্রধান নিহত ও আরও দুজন নিরাপত্তারক্ষী আহত হন। সোশ্যাল মিডিয়া টেলিগ্রামে প্রকাশ করা ভিডিওতে দেখা যায়, এক ব্যক্তি দূতাবাসের মুখে গাড়ি পার্কের পর হঠাৎ করেই বন্দুক নিয়ে হামলা চালায়। পরে দূতাবাসের কর্মকর্তারা তাকে ধরে ফেলে।

ভিডিওতে কোনো শিশুকে দেখা না গেলেও তেহরানের পুলিশপ্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হোসেইন রাহিমি বলেন, আক্রমণকারী ব্যক্তি দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে দূতাবাসে এসেছিলেন। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা ছিল ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কলহ। তবে আজারবাইজানের বিবৃতি বলছে, এই ঘটনা মোটেই পারিবারিক কলহ ছিল না।

ঘটনার অনেক আগে থেকেই ইরানের অভ্যন্তরে আজারবাইজান-বিরোধী কর্মকাণ্ডের ফলে আজারবাইজানের পক্ষ থেকে তেহরানে তাদের দূতাবাসের নিরাপত্তা বৃদ্ধির দাবি জানানো হয়। ইরান সেই দাবি আমলে না নেওয়ায় এখন আজারবাইজান দূতাবাসের কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

তেহরানে হামলার কয়েক ঘণ্টার পরেই বাকুতে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত জর্জ ডিক এক টুইটার বার্তায় বলেন, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্টের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হিকমাত হাজিইয়েভের সঙ্গে তার অতিগুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। তেহরানে আজেরি দূতাবাসে হামলার আগে থেকেই আজারবাইজান-ইরান সম্পর্কে উত্তেজনা চলছিল। ২০২০ সালে নাগোর্নো-কারাবাখের যুদ্ধের সময় আজারবাইজান অভিযোগ করে, ইরান আর্মেনিয়াকে জ্বালানি ও অন্যান্য সহায়তা দেয়।

অপরদিকে তেহরান দুশ্চিন্তায় রয়েছে, আজারবাইজান তাদের নাখচিভান ছিটমহলকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করতে যে করিডোর আর্মেনিয়ার কাছে দাবি করছে, সেটি ইরানের সঙ্গে আর্মেনিয়া ও রাশিয়ার স্থলযোগাযোগ ব্যবস্থাকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। এছাড়াও ইরানের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ জাতিগতভাবে আজেরি হওয়ায় তা তেহরান ও বাকুর মাঝে দড়ি টানাটানির কারণ হয়েছে। 

তেহরানে আজারবাইজান দূতাবাসে হামলার পর আজারবাইজানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইরানের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে বলা হয়, এই ঘটনার ফলে দুই দেশের সম্পর্কে আরও চাপ বাড়বে। গত বছরের নভেম্বরে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভ এক অনুষ্ঠানে বলেন, তার সরকার দেশ ও দেশের বাইরে সব আজেরির সেক্যুলার জীবনযাত্রা রক্ষার চেষ্টা করবে; এমনকি ইরানের অভ্যন্তরে যে আজেরিরা রয়েছে তাদেরকেও। আলিইয়েভ ইরানের অভ্যন্তরের আজেরিদের ‘আজারবাইজানের জনগণ’ বলে আখ্যা দেন। 

আজেরি দূতাবাসে হামলার পর তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু এক টুইটার বার্তায় বলেন, আজারবাইজান কখনো একা নয়। ঐতিহাসিকভাবেই আজারবাইজান তুরস্কের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধে আজেরিদের বিজয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল তুরস্ক ও ইসরায়েল। তুরস্ক আবার আঞ্চলিকভাবে ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বী।

ইরান সব সময়ই অভিযোগ করে আসছে, আজারবাইজান ইরানের অভ্যন্তরের আজেরিদের মাঝে বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাকে উসকে দিচ্ছে। একই সঙ্গে ইরান সন্দেহ করে, ইরানের অভ্যন্তরে ইসরায়েলের ইন্টেলিজেন্স কাজ করতে আজারবাইজানকে ব্যবহার করছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের ইসফাহান অস্ত্র কারখানায় হামলা মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে দিল নিঃসন্দেহে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //