চীনের বেলুনকাণ্ড ও সম্ভাব্য ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ

যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমায় চীনের তৈরি বিশাল বেলুনের প্রবেশ ঘিরে ব্যাপক আলোচনা চলছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বেলুনটি প্রথম ২৮ জানুয়ারি প্রায় ৬০ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে আলাস্কার আকাশে প্রবেশ করে। এর তিন দিন পর কানাডার আকাশসীমায় চলে গেলেও ৩১ জানুয়ারি তা আবার যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে।
এরপর ৫ ফেব্রুয়ারি আটলান্টিক মহাসাগরের উপরে বেলুনটি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ভূপাতিত করা হয়। মার্কিন কর্মকর্তারা এটিকে ‘গোয়েন্দা’ বেলুন বলে জানিয়েছেন। আর চীন বলছে, বেলুনটি ছিল আবহাওয়ার তথ্য সংগ্রহের জন্য তৈরি; যা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে চলে যায়। 

সিএনএনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, বেলুনটি ভূপাতিত করার আগে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অত্যন্ত সংবেদনশীল’ সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনার ওপর দিয়ে উড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডোর এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক ইয়াইন বয়েড বলেন, বেলুনটি খুব সম্ভবত আবহাওয়ার তথ্য সংগ্রহ করছিল না। কারণ আবহাওয়া বেলুনের আকৃতি অনেক ছোট হয়। আর এটি বিশ্বাস করা কঠিন যে, চীন আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি বাতাসের তাপমাত্রা বা চাপ মাপার চেষ্টা করবে।  

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সাবেক কর্মকর্তা ট্রেসি ওয়াল্ডার বলেন, এই বেলুন ছবি তোলার জন্যে পাঠানো হয়নি। কারণ চীনের বেশকিছু গোয়েন্দা স্যাটেলাইট রয়েছে, যেগুলো হাই রেজোলিউশনের ছবি তুলতে পারে। এই বেলুন হয়তো ইলেকট্রনিক সিগন্যালস ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ করছিল। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে তেজস্ক্রিয়তা কতটুকু বা আকাশ প্রতিরক্ষা রাডারের কর্মকাণ্ড কেমন।

আর এগুলো জানতে হলে স্যাটেলাইটের চাইতে আরও কম উচ্চতায় উড়তে হবে। মার্কিন সেনাবাহিনীর সাবেক জেনারেল ব্যারি ম্যাকাফরে বলেন, এটা নিঃসন্দেহে গত ৫০ বছরের মধ্যে চীনা ইন্টেলিজেন্সের সবচেয়ে ‘গোঁয়ার’ কর্মকাণ্ড। তার ধারণা, চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা এ বিষয়ে জানেন না। আবার এটাও হতে পারে, চীনের সামরিক বাহিনীর উপর রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ নেই।

তিনি আরও মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র নিঃসন্দেহে সামরিক দিক থেকে চীনের চেয়ে বহু এগিয়ে রয়েছে। এখানে তাইওয়ানের সামরিক সক্ষমতা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে রয়েছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের সামরিক শক্তি এবং অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনে নতুন করে ৯টি সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের চুক্তি করেছে; যার মাধ্যমে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের কৃত্রিম দ্বীপভিত্তিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধক তৈরি হবে। কাজেই চীন মারাত্মক কোনো ভুল না করলে যুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা নেই। 

ট্রেসি বলছেন, গোয়েন্দা সংস্থাতে তিনি চীনা ইন্টেলিজেন্স ঠেকাতে কাজ করেছেন; কিন্তু কখনোই চীনের এহেন খোলামেলা কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেননি। সাধারণত চীন খুব সন্তর্পণে কাজ করে, সহজে তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সিআইএর সাবেক প্রধান লিয়ন প্যানেট্টা বলেন, বেলুনের ধ্বংসাবশেষ থেকে যদি বুঝতে পারা যায় যে, এটা কী ধরনের তথ্য সংগ্রহ করছিল এবং আকাশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল কিনা, তাহলে বোঝা যাবে এটা যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে গোয়েন্দাবৃত্তির জন্যই এসেছিল কিনা।

আর যদি মার্কিন সামরিক নেতৃত্ব বুঝেই থাকে, বেলুনটি একটা গোয়েন্দা বেলুন, তাহলে এটাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনার উপর দিয়ে উড়তে দেওয়া উচিত হয়নি। বরং এটাকে আরও আগেই ভূপাতিত করা উচিত ছিল। এছাড়া চীন কীভাবে কাজটা করেছে, তা নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা হলেও তারা কেন এ কাজ করেছে, সেটা নিয়ে খুব কমই কথা হচ্ছে।

চীন নিঃসন্দেহে জানত, যুক্তরাষ্ট্র এটা খুঁজে পাবে এবং এর প্রত্যুত্তর দেবে। তারা হয়তো বার্তা দিতে চাইছিল, যুক্তরাষ্ট্র যদি চীনের উপরে গোয়েন্দাবৃত্তি করে, তাহলে চীনও যুক্তরাষ্ট্রের উপরে গোয়েন্দাবৃত্তি করতে সক্ষম। কারণ যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিতভাবেই চীনের সীমানার খুব কাছ দিয়ে গোয়েন্দা বিমান ওড়ায় এবং চীন এই কর্মকাণ্ডকে মোটেই ভালো চোখে দেখে না। 

এসব বেলুনে গুপ্তচর ক্যামেরা ও রাডার সেন্সরের মতো আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করা সম্ভব। আর নজরদারিতে এমন বেলুন ব্যবহার করার কিছু সুবিধা আছে। প্রধানতম সুবিধা হলো, এটি কম ব্যয়বহুল ও ড্রোন বা স্যাটেলাইটের চেয়ে মোতায়েন করা তুলনামূলক সহজ। আবার বেলুনের ধীরগতির কারণে লক্ষ্যস্থলের আকাশে এটি বেশি সময় অবস্থান করে ধীর-স্থিরভাবে নজরদারি চালাতে পারে। অন্যদিকে স্যাটেলাইটের ক্ষেত্রে, এর যাত্রাপথ একেবারে সুনির্দিষ্ট।

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের সাবেক ডিরেক্টর জেনারেল মাইকেল ক্লার্ক বলেন, এই বেলুনের মাধ্যমে চীন এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইন্টেলিজেন্স পাবে না, যা তারা এখন পাচ্ছে না। বরং দেখতে হবে যে, এর মাধ্যমে চীনের বার্তাটা কী ছিল। তার ধারণা, কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনে যে ঘাঁটি তৈরির চুক্তি করেছে, এটি সেটিরই প্রত্যুত্তর।

মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব অ্যান্টনি ব্লিংকেন বেলুনের ঘটনাকে একটা ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ কর্মকাণ্ড বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং তার বেইজিং সফর বাতিল করেছেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে ইচ্ছুক নয়। তবে ব্লিংকেনের বেইজিং সফর বাতিল দেখিয়ে দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র বেলুন ইস্যুটি ব্যবহার করতে চাইছে। 

মাত্র কিছুদিন আগেই ফিলিপাইনে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ঘাঁটি তৈরির যে ঘোষণা দিয়েছে, সেটিকে তারা চীনের অসন্তুষ্ট হওয়ার কোনো কারণ হিসেবেই দেখে না। আবার মার্কিন গোয়েন্দা বিমান যখন নিয়মিতভাবেই চীনের কাছাকাছি ঘুরে বেইজিংকে অস্বস্তির মাঝে ফেলছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চীনের বেলুনের অবাঞ্ছিত প্রবেশকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো হচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হয়। যা চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যের দিকেই নির্দেশ করে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //