সেপায় ভর করে বাড়ছে ভারত- ইউএইর বাণিজ্য

ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) মধ্যে স্বাক্ষরিত বাণিজ্য চুক্তির এক বছরের মধ্যেই দেশ দুটির মধ্যকার বাণিজ্য বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। তেলবহির্ভূত এ বাণিজ্য প্রায় ৫ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছায়।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বৈদেশিক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ড. থানি আল জেইউদি বলেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।’

গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ১০ হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে ভারত ও ইউএই। কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা) চুক্তির পর আরব আমিরাতে ভারতীয় পণ্য বিশেষ করে পোশাক, গহনা ও রত্নের রপ্তানি বেড়েছে। করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে গহনার ব্যবসায় ব্যাপক ধস নামে। তবে নতুন এ চুক্তি সেই খাত পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রাখে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর ভারতের বিশ্বব্যাপী তৃতীয় ব্যবসায়িক অংশীদার আরব আমিরাত। ২০১৯-২০ সালে ভারত ও আরব আমিরাতের

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ৫ হাজার ৯০০ কোটি ডলার হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। পরে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারি ছড়িয়ে পড়ার কারণে ২০২০-২১ সালে সেটা ৪ হাজার ৩৩০ কোটি ডলারে নেমে আসে।

আল জেইউদি তার লিংকডইন পোস্টে বলেন, ‘সেপা একটি যুগান্তকারী চুক্তি, যা দ্রুতবর্ধনশীল দেশগুলোর মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও চীনের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি চতুর্থ অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। সমান্তরালভাবে, আমরা একটি মধ্য শক্তি, একটি উদ্ভাবন কেন্দ্র, একটি বিশ্ববাজার ও বিশ্বের একটি প্রবেশদ্বার হিসেবে আমাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করছি।’

ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পাদিত চুক্তিটি কার্যকর হয় গত মে মাস থেকে। সেপা সুবিধার মধ্যে রয়েছে বর্ধিত বাজারে প্রবেশ, শুল্ক ছাড়, সহজ কাস্টমস পদ্ধতি, স্পষ্ট ও স্বচ্ছ নিয়ম এবং নিয়মভিত্তিক প্রতিযোগিতা। ২০২১ সালে উভয় দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রায় ৪৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এতে ভারতের রপ্তানি ছিল ১৭ বিলিয়ন ডলার, আমদানি ২৬ বিলিয়ন ডলার।

চুক্তির অধীনে ২০২২ সালের প্রথম নয় মাসে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ৩ হাজার ৮৬০ কোটি ডলার, যা ২০২০ সালের একই সময়ের অর্জিত বাণিজ্য বাবদ আয়ের প্রায় দ্বিগুণ। চুক্তিটি বাস্তবায়নের পর থেকে প্রথম আট মাসে বাণিজ্য বেড়েছে ৩০ শতাংশ, যা একক আর্থিক বছরে উভয় দেশকেই ৮ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের বাণিজ্যের সুযোগ করে দিয়েছে।

ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল বলেছেন, ভারতের রপ্তানিকারকদের একটি বড় অংশের জন্য ভালো রুট ইউএই এবং এখন তারা পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের কিছু অংশে পৌঁছতে সক্ষম হবে। ভারত বর্তমানে যুক্তরাজ্য, ইইউ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইসরায়েলের মতো আরও অনেক দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার জন্য আলোচনা করছে। মনে করা হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে এই চুক্তি বাকি চুক্তিগুলোকে গতি দেবে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত জয়ন্ত দাশগুপ্ত বলেন, ‘গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের সদস্যরা অর্থাৎ জিসিসিও একই ধরনের সিইপিএ চুক্তি করতে চায়। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর, জিসিসির সঙ্গেও আলোচনা ত্বরান্বিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং এটি সম্পূর্ণ হবে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে যদি এটি ঘটে তবে উপসাগরীয় সব দেশে প্রবেশাধিকার পাবে ভারত।

এই চুক্তির পর ভারত থেকে রপ্তানি হওয়া পণ্যের প্রায় ৯০ শতাংশের ওপর আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেয় আরব আমিরাত। ইউএই বর্তমানে ভারত থেকে আসা পণ্যের উপর ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করে। ভারতের রত্ন ও গহনা, বস্ত্র, চামড়াজাত পণ্য, খাদ্য পণ্য, কৃষি ও চিকিৎসা পণ্য শিল্প- এই চুক্তির কারণে আমদানি শুল্ক হ্রাস হয়েছে এবং পশ্চিম এশিয়ায় বাজার পেতে লাভবান হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর বলেন, ইউএই ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার, দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজারও। অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে বেশি ভারতীয় নাগরিক বসবাস করেন। অর্থাৎ আমরা মানুষের কথা বলি অথবা ব্যবসার বিষয়ে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তিনি আরও জানান, জ্বালানি বাণিজ্য বিনিয়োগ অব্যাহত আছে। এর সঙ্গে মহাকাশ, শিক্ষা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, স্বাস্থ্য ও স্টার্টআপ যুক্ত হয়েছে। দুই দেশের এই সম্পর্ক শুধু একটি পরিবর্তনশীল বিশ্বে টিকে থাকার জন্য নয়; বরং একটি পরিবর্তনশীল বিশ্বকে রূপ দিতে চায়।

সেপা চুক্তিটি মূলত সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাণিজ্য কৌশলের একটি অংশ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির পক্ষ থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে, চুক্তিটির মাধ্যমে দেশটি এর জিডিপিতে ১ দশমিক ৭ শতাংশ বা ৮৯০ কোটি ডলারে যোগ করবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ১ দশমিক ৫ শতাংশ বা ৭৬০ কোটি ডলার রপ্তানি বাড়াবে।

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কেন্দ্র ক্রমেই স্থানান্তর হচ্ছে দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে। সে ক্ষেত্রে ভারত-ইউএই চুক্তির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। সরকারি তথ্যানুসারে চলতি মাসের শুরুতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের তেলবহির্ভূত বৈদেশিক বাণিজ্য রেকর্ড ৬০ হাজার ৭১০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি দুবাইয়ে উন্মোচিত হয় ইউএই-ভারত বিজনেস কাউন্সিল চ্যাপ্টার। এটির লক্ষ্য ব্যবসায়িক ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতার উন্নতি এবং দক্ষতা আদান-প্রদান ও বাজারগুলোয় প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা।

এদিকে ভারত-সংযুক্ত আরব আমিরাত বিজনেস কাউন্সিলের চুক্তি (সিইপিএ) হয়েছে। এর অংশ হিসেবে সেই দেশে ভারতের প্রথম বাণিজ্য ইউনিট চালু হয়, যার মাধ্যমে ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে বাণিজ্য আরও প্রসারিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। আগামী দিনে দুই দেশের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য চুক্তি প্রসারিত করার সংকল্প রয়েছে। আরব আমিরাত থেকে ভারত ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নতুন বিনিয়োগ আনবে বলেও দাবি করেছে। এই ব্যবসায়িক ইউনিটের অফিস আবুধাবিতে কাজ করবে।

সিইপিএ স্বাক্ষরের একটি সফল বছর উপলক্ষে ১৭ ফেব্রুয়ারিই ভারতীয় দূতাবাস, আবুধাবি, ভারতের কনস্যুলেট জেনারেল দুবাই ও দুবাই চেম্বার্সের সহযোগিতায় ফেডারেশব অব ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি একটি বিশেষ ব্যবসায়িক ইভেন্টের আয়োজন করেছিল। অনুষ্ঠানে ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ২০০টিরও বেশি নেতৃত্বস্থানীয় শিল্প অংশগ্রহণ করে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //