আইএমএফের ঋণ

সাময়িক স্বস্তি হলেও সংকট মিটবে না

সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ার ব্যর্থতার খেসারত হিসেবে সংকট গভীর হয়েছে। সংকটে ঋণ দরকার ঠিকই। কিন্তু তার চেয়েও বেশি দরকার এখন সংস্কার পদক্ষেপ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এই ধারের টাকা সাময়িক স্বস্তি দিলেও সংকটের গভীরতা এত বেশি যে এই ঋণে তা মেটানো কঠিন বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা।

তাদের বিশ্লেষণ, আর্থিক ব্যবস্থাপনা এখন গভীর সংকটে। তবে আইএমএফের ঋণে সরকার যে লাভ আশা করছে, তা হলো অন্য উন্নয়ন সহযোগীরাও ঋণ দিতে চাইবে। তথাপি আমাদের দরকার ঋণের পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে সুসংহত করা। 

এদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) ঋণের বিষয়টি পর্যালোচনায় বলছে, রাজস্ব খাতে আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চলতি বছরের লক্ষ্যমাত্রার অতিরিক্ত ৬৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় করতে হবে। এর পরের বছরগুলোতে এই আয় আরও বাড়াতে হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাঠামোগত সংস্কার ও মানসিকতার বদল করা না গেলে আইএমএফের শর্ত মেনে রাজস্ব খাতের সংস্কার বাস্তবায়ন করা সরকারের জন্য কঠিন হবে। এমনকি বড় ধরনের সংস্কার না হলে আসন্ন কিস্তি বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যা অতীতে হয়েছে বলে মনে করেন পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর।

প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, বাংলাদেশ যে এবারই প্রথম আইএমএফ থেকে ঋণ নিচ্ছে তা নয়। ছোট-বড় মিলিয়ে সংস্থাটি থেকে এর আগে ১২ বার ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালে সদস্য হওয়ার পর আইএমএফ থেকে প্রথম ঋণ নেওয়া হয় ১৯৭৪ সালে। ২০১২ সালে নেয়া সর্বশেষ ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার। সেটাই ছিল আইএমএফের কাছ থেকে নেওয়া সর্বোচ্চ ঋণ। 

এরপর ১৯৮০ থেকে ৯০ সময়ে ঋণ নেওয়া হয় পাঁচবার। ১৯৯০ সালে নেওয়া ঋণের বিপরীতে আইএমএফের শর্তের মধ্যে অন্যতম ছিল মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) চালু করা। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান তা সফলভাবেই কার্যকর করেছিলেন। বাণিজ্য উদারীকরণসহ ব্যাংক খাতের সংস্কারের শর্তও ছিল তখন। 

এর ফলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বাড়তে থাকে এবং আসতে থাকে বিদেশি বিনিয়োগ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানিও বাড়তে থাকে। ১৯৯১-২০০২ সময়ে আইএমএফ থেকে বাংলাদেশকে কোনো ঋণ নিতে হয়নি। তবে পরের বছর অর্থাৎ ২০০৩ সালেই নিতে হয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান কমিয়ে আনার শর্ত ছিল তখন। লোকসানি পাটকলগুলোও বন্ধ করা হয়েছিল তখন।

আদমজী পাটকলও বন্ধ করা হয়েছিল। আবার প্রায় এক দশক পর ২০১২ সালে সাত কিস্তিতে একশ কোটি ডলার আইএমএফ থেকে নেওয়ার চুক্তি করে বাংলাদেশ। অন্যতম শর্ত নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়ন করা। এ আইন করতে দেরি করায় শেষের দুই কিস্তি আটকেও দিয়েছিল আইএমএফ।

এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এনবিআরকে বর্তমান লক্ষ্যমাত্রার অতিরিক্ত ৬৫০ বিলিয়ন বা ৬৫ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে। পরের অর্থবছর, ২০২৪-২০২৫ সালের জুনে সমাপ্ত বছরে বর্তমান বছরের লক্ষ্যমাত্রা থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করতে হবে এক হাজার ৩৮৩ বিলিয়ন টাকা বা এক লাখ ৩৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

আইএমএমের ঋণ কর্মসূচির সর্বশেষ বছর, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এনবিআরকে বর্তমান লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অতিরিক্ত আরও দুই হাজার ৩৪০ বিলিয়ন টাকা বা দুই লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে। উল্লেখ্য, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে।

আইএমএফের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, বর্ধিত ঋণ সহায়তা (ইসিএফ), বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) ও রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ)-এ তিন ধরনের ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ। বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতায় থাকা বা রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি করা দেশগুলোকে প্রদত্ত ইসিএফের অধীনে ঋণ পাওয়া যাবে একশ কোটি ডলারের বেশি। এসব হলো সুদবিহীন।

অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে দীর্ঘ সময় ধরে আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতা থাকা দেশগুলোয় বিতরণকৃত ইএসএফের আওতায় পাওয়া যাবে ২১৫ কোটি ডলার। জলবায়ু পরিবর্তন-করোনা ভাইরাসের মতো দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কষ্টসহিষ্ণু নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশকে দেওয়া আরএসএফ থেকে পাওয়া যাবে ১৩০ কোটি ডলার।

তিন পর্যায়ের গড় ঋণের সুদ হার হবে প্রায় ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। প্রথম এশীয় দেশ হিসেবে আরএসএফ তহবিল থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্ত ঋণ পরিশোধে ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ সময় পাওয়া যাবে ২০ বছর এবং ইসিএফ ও ইএফএফের ঋণ আলাদা আলাদা গ্রেস পিরিয়ডে পরিশোধ করা যাবে ১০ বছরে।

ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারসহ বিভিন্ন মহল বলছে, দ্বিতীয় কিস্তি যোগ করলে আগামী এক বছরে আইএমএফ থেকে পাওয়া যাবে মোট একশ কোটি ডলারের মতো। এই অর্থ কি সংকট কাটানোর জন্য যথেষ্ট? তবে আইএমএফের এই ঋণ দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষার পাশাপাশি সরকারের গৃহীত সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়ক হবে।

এছাড়া রাজস্ব খাত সংস্কার করলে সামাজিক খাত, উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ব্যয় বাড়াতে হবে। ঋণের যথাযথ ব্যবহারের জন্য নীতি ও রাজস্ব প্রশাসনে সংস্কার করতে হবে। রাজস্ব সংস্কার হলে সরকারি অর্থায়ন, বিনিয়োগ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা উন্নত হবে। এতে সরকারের ব্যয় সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা বাড়বে এবং শাসন ব্যবস্থা উন্নত হবে। অর্থ ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় মনোযোগ দিতে হবে। 

বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে। আর এতে উৎসাহিত হচ্ছে হুন্ডি। এগুলো বন্ধে সরকার কতটা আন্তরিক, তার ওপর নির্ভর করবে সংকট কত কম সময়ে দূর হবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের কথাও ভুলে গেলে চলবে না। সংকট যতটা গভীর, আইএমএফের এ ঋণ তার সমাধান পুরোপুরি দিতে না পারলেও সমাধানের পথে অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারবে। এই ঋণ বাংলাদেশকে বিপদের মুখে একটি ভরসার ছায়া দিয়েছে। কিন্তু এই ঋণে পাওয়া অর্থ খরচের বিষয়ে পেশাগত দক্ষতা ও রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি জরুরি।

এই ঋণ পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হবে রিজার্ভ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক সংকটের কারণে ডলার সংকট বাড়ছে। এ অবস্থায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং চাপে থাকা অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। তবে আগামী কিস্তিগুলো পেতে আইএমএফের দেওয়া সংস্কার প্রস্তাবগুলো কার্যকর করতে হবে। এজন্য অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি কমাতে হবে এবং মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি যাতে না কমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

সিপিডির ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা এখন গভীর সংকটে। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে না পারার ব্যর্থতার খেসারত হিসেবে এই সংকট তৈরি হয়েছে। আইএমএফের এই ধারের অর্থ সাময়িক স্বস্তি দিলেও সংকটের গভীরতা এতটাই বেশি যে, ধার করে তা মেটানো কঠিন। আমাদের ঋণ দরকার। তবে তার চেয়েও এখন বেশি দরকার সংস্কার। 

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হানের মতে, ব্যাপকভাবেই আর্থিক ব্যবস্থাপনা এখন গভীর সংকটে। ঠিক সময়ে ঠিক পদক্ষেপ নিতে না পারার ব্যর্থতার খেসারত হিসেবে এ সংকট তৈরি হয়েছে। ঋণ দরকার, তার চেয়েও বেশি দরকার এখন সংস্কার। প্রবাসী আয় যা আসছে তা হয়তো দেড় গুণ করা সম্ভব, যদি আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে অর্থ আনার পথ বের করা যায়। আইএমএফের ঋণে একটা অবশ্য লাভ সরকার আশা করছে, সেটা হচ্ছে এখন অন্য উন্নয়ন সহযোগীরাও ঋণ দিতে চাইবে। তবে বেশি ঋণের পরিবর্তে বরং অভ্যন্তরীণ আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে সুসংহত করা।

ড. আহসান সম্প্রতি আনুষ্ঠানিক এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ওই পরিমাণ রাজস্ব আদায় করা খুবই কঠিন। তবে এর কোনো বিকল্প নেই। বড় ধরনের সংস্কার সম্পন্ন না হলে আসন্ন কিস্তি বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যা অতীতে হয়েছে। সংস্কার না হলে অর্জিত তো হবেই না বরং ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও কমে যেতে পারে। গত ৫ বছরে প্রতিবছর একটু একটু করে এটা কমেছে। অন্য দেশে করহার বাড়িয়ে এটা আদায় সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে করহার এমনিতেই বেশি। তাই এখানে সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //